ভ্রমণ

ঘুরে আসুন সারিঘাটের কাশবনে

মুহম্মদ রাসেল হাসান

Advertisement

শরতের কাশফুল সবাইকে মুগ্ধ করে। রাজধানীতে বাস করে শরতকে সেভাবে উদযাপন করতে না পারলেও কাশফুল বিলাস করবো না তা কি হয়? কেরানীগঞ্জে আমার তিন বান্ধবীর বাসা। তাদের কাছ থেকে জানতে পারি কেরানীগঞ্জের সারিঘাট নামক স্থানে আমার প্রিয় ফুল কাশের বন আছে।

শুনেই আরও কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নিলাম আমরা আগামীকাল সেখানে ঘুরতে যাচ্ছি। সারারাত টানটান উত্তেজনা সবার মনেই। কারণ দুপুরেই যাচ্ছি প্রিয় শুভ্র ফুলের বনে। পরদিন দুপুর সাড়ে বারোটায় বেড়িয়ে পড়লাম। চাঁনখারপুল থেকে বাসে করে যাত্রাবাড়ির মোড়ে নেমে বন্ধু তানভীরের সঙ্গে এক হই।

আরও পড়ুন: ফেনী ভ্রমণে যেসব স্থান ঘুরে দেখতে ভুলবেন না  এরপর রিকশায় করে জুরাইন, পরে সিএনজি করে পুস্তকলা ব্রিজের কাছে নেমে, একটু হেঁটে ইকুরিয়া থেকে রিকশা করে বেয়ারি বাজারে যাই বিথীদের সঙ্গে মিলিত হতে। নেমে দেখলাম আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে বিথী ও নায়িম। এসময় চলে এলো সোহানা। তারপর বিথী আমাদের নিয়ে চলছে।

Advertisement

একটু এগোতেই দেখলাম মৃদু বাতাসে সম্ভাষণ জানাচ্ছে মনোরম কাশবন। হাঁটতে হাঁটতে বন পেরিয়ে বিথী হঠাৎ একটি বাসায় নিয়ে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিথীর ঘরে ঢুকেই দক্ষিণপাশের জানালা দিয়ে চোখে পড়লো আরেকটি কাশবন। বিকেলের নরম রোদের সোনালিচ্ছটা পড়েছে ফুলের ডগায়।

বাতাসে কাশবন একবার বুক দেখাচ্ছে, আরেকবার পিঠ দেখাচ্ছে। পশ্চিম পাশের জানালায় চোখ পড়তেই আরও দ্বিগুণ মুগ্ধতায় চোখ নিবদ্ধ হয়ে থাকে আমার খেয়ালের অগোচরে। এদিকেও হালকা হাওয়ায় আলতো করে দুলছে কাশবন। এ যেন স্বর্গের মাঝখানে বাসা।

আরও পড়ুন: একদিনের ট্যুরে কুমিল্লায় গিয়ে কী কী দেখবেন? 

এরপর বিথী কয়েক প্রকার মজাদার খাবার বানিয়ে নিয়ে এলো। সবার মতো আমিও খেলাম। তবে বেশি খেলাম বাতায়ন দিয়ে আসা শরতের বাতাস আর পান করলাম কাশবনের আমোঘ সুধা। এরপর বাসার সামনের কাশবন অতিক্রম করে বিথী সারিঘাটের কাশবনে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের হলো।

Advertisement

প্রথমে এই বনের দিকে আসার সময় ভেবেছিলাম এটিই বোধ হয় কাঙ্খিত সারিঘাট। তবে বিথী নিয়ে গেল আরও সুন্দর এক স্থানে, জায়গাটি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জস্থ বেয়ারি বাজার এলাকা। মনুরবাগ এলাকায় আছে বান্ধবী কান্তার। তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা হেঁটে তার বাসার দিকে যাচ্ছি।

একটু এগিয়ে হাতের ডানে একটি কাশবন, এরপর বামে মোড় নিতেই সোজা আরেকটি কাশবন। পুনরায় ডান দিকে মোড় নিলে আরেকটি কাশবন দেখতে পেলাম। মনে হচ্ছে এই মাঝারি ধরনের কাশবনগুলো কারো নজর কাড়ছে না। তবে প্রত্যেকটি কাশবন আমার হৃদয়ের কড়ায় নাড়া দিচ্ছে।

আরও পড়ুন: পাহাড়ি খাবারের স্বাদ নিন দীঘিনালার ‘জুমঘর’ রেস্তোরাঁয় 

এরপর কিছুটা হেঁটে আমরা একটি অটোতে চড়ে বসলাম। পথিমধ্যে চোখের পলকে আরও দুটো কাশবন দেখলাম। একটুপর মামা বললেন, ‘চলে এসেছেন আপনারা।’ যথারীতি আমরা নামলাম। দেখলাম আমাদের বহুল কাঙ্ক্ষিত বিস্তৃত কাশবন। বনটি এতই বড় যে, এর শুরু দেখা গেলেও কিনারা দেখা যাচ্ছে না।

রাস্তা ও কাশবনের মাঝে একটি লেক। রাস্তা থেকে লেকের উপর দিয়ে কাশবনের ধারে একটা রেস্টুরেন্টের বারান্দা অবধি একটি ঝুলন্ত ব্রিজের ন্যায় কিছু দিয়ে দর্শনার্থীর জন্য সুবিধা ও শোভাবর্ধনে তৈরি করা হয়েছে। লেকে অসংখ্য ছোট ছোট ডিঙি নৌকা। মাঝিরা ‘মামা, আমার নৌকায় আসেন’ বলে বলে প্রত্যেকেই চিৎকার করে স্বল্প টাকায় চড়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন।

তবে আমরা যখন পৌঁছেছি, তখন বিকাল বিদায় নিতে শুরু করেছে, আসার সময় হয়েছে আজকের গোধূলির। কাজেই সন্ধ্যার আগেই নীড়ে ফেরার তাড়া আছে বান্ধবীদের। তাই আমরা আজকের প্রাণকেন্দ্র কাশবনের দিকেই যাচ্ছি। লেকের স্বচ্ছ জলে কাউকে কাউকে গোসল করতে দেখলাম।

আরও পড়ুন: হিমছড়ির নতুন পর্যটন স্পট 

এই চোখ জুড়ানো জায়গাটির অবস্থান দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের আইন্তা সারিঘাটে। জানা যায়, কাশবনের এলাকাটিকে স্থানীয়রা সারিঘাট নামে নামকরণ করেছেন। অতঃপর আমরা প্রবেশ করলাম কাশবনে। আকাশে উড়ছে সাদা মেঘের ভেলা, নিচে নৃত্য করছে শুভ্র ফুলের বন।

ভাবলাম সূর্য মামা প্রস্থানের আগে কয়েকটি ছবি তুলে নিই। ছবি তুলতে তুলতে একসময় দেখলাম, ছবি আঁধার হয়ে আসতে শুরু করেছে। কারণ আবিষ্কার করতে বনের মাঝে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। দেখি, বনের মাঝখানটিতে সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু পতিত হয়ে ফুলবন আরো কঠিন মায়াবী হয়ে উঠেছে। সাদার উপর স্বর্ণের দানা যেন চকচক করছে। হাত বুলাচ্ছি কয়েকটি কাশফুলে।

তুলোর মতো নরম ফুলগুলো, অমায়িক স্নিগ্ধ ও পরম সুন্দর। পুরো বনে শখানেক মানুষ হতেই পারে। বেশিরভাগই তরুণ-তরুণী। পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরিহিত এই তারণ্য কাশবনের শোভাকে আরও বাড়িয়ে তুললো। কাশফুলের সঙ্গে সঙ্গে সেসব তরুণীদের দীঘল কেশও দুলতে দেখা গেল। আকাশে চোখ রাখতেই চোখের সামনে ডুব দিল সূর্যের চিহ্নটুকু।

আরও পড়ুন: টাঙ্গন নদীর ধারের কাশফুলের রাজ্যে ছুটছেন সবাই 

কাশবন ছেড়ে যেন যেতে চাচ্ছিলনা এই রবি মামা। এসময় কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে উপস্থিত হলো নেহাও। আমি একটু পায়চারি করতে লাগলাম। আরো চোখ মেলে দেখতে লাগলাম কাশবনের প্রগাঢ় রূপ৷ দেখার পিপাসা যেন বেড়েই চলেছে। ওরা বললো, আসো নাগরদোলায় চড়ি। এই আনন্দ থেকেও বঞ্চিত হওয়া সমীচীন নয়।

তাই ছয়জন উঠে পড়লাম। নাগরদোলা যখন ঘূর্ণির সর্বোচ্চ শৃঙ্গে উঠে তখন কাশবনটা অনেক উঁচু থেকে দেখা যায়। সে কি অপরূপ রূপ! আর প্রত্যেকবার যখন ঘূর্ণিকালে আমরা ভরশূন্য হয়ে পড়ি বান্ধবীরা তখন আনন্দ ও ভয়ে চিৎকার মেরে ওঠে। পুরো নাগরদোলাতে আমরাই ঘুরছি। কাশবন থেকে সকলে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।

ফলে আলাদা আনন্দ হচ্ছে। এরপর নেমে ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে ফুসকা নিল সবাই। আমি এর ফাঁকেও আবার বনের ভেতর ঢুঁ মেরেছিলাম। ওরা ঢেকে আনলো। ওদের দু’জনের প্লেট থেকে দুটো নিয়ে আবার তাকিয়ে রইলাম স্বর্গের দিকে। এসময় সোহানা বললো, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমাকে কদমতলী পৌঁছাতে হবে।’

আরও পড়ুন: মিরসরাইয়ের ‘রূপসী’ ঝরনা 

নেহা কিছুক্ষণ থাকতে চাইলো, আমারও ইচ্ছে ছিল। কিন্তু থাকলেও কাশবনের সুধা পান করে তৃপ্তি মিটবে কি না কে জানে। এবার আমরা বিগত ম্রিয়মাণ আলোতে, আঁধারের মাঝে বিদায় জানালাম সারিঘাটের কাশবনকে। এরপর চেপে বসলাম সিএনজিতে। একে একে ওরা নেমে গেল। আমি কাশবনের ছবি মানসপটে নিয়ে চলতে থাকলাম বেগম বাজারের উদ্দেশ্যে।

কীভাবে যাবেন?

প্রথমে যাত্রাবাড়ি যাবেন। এখান থেকে লেগুনায় ১০টাকা ভাড়া দিয়ে জুরাইন রেলগেইট যাবেন। সেখান থেকে ১০ টাকায় পোস্তাগলা ব্রিজের ওপারে যাবেন। পোস্তাগলা ব্রিজ থেকে সিএনজি দিয়ে ১০ টাকা ভাড়ায় সারিঘকট যাবেন।

আরও পড়ুন: যান্ত্রিক শহর ছেড়ে সমুদ্র-পাহাড়-প্রকৃতির বুকে 

কখন যাবেন ও কী খাবেন? মন ভরে দেখতে চাইলে দুপুরে চলে যাওয়া ভালো। ছুটিরদিনে ভিড় বেশি থাকে। বেশকিছু টং দোকান আছে। দোকানে আলুর চপ, সিঙারা জাতীয় খাবার আছে। কাশবনের মধ্যে ফুসকা, আচার ও হাওয়ায় মিঠাইয়ের ভ্রাম্যমান দোকানও আছে।

নাগরদোলা প্রতিজন ৩০টাকা করে খরচ পড়বে।

নৌকাভ্রমণ: প্রতি ঘণ্টায় ১৫০-২০০টাকা লাগে। আগে দামাদামি করে নেওয়া ভালো।

সতর্কতা

জলাশয়টির গভীরতা অনেক বেশি। লাইফ জ্যাকেট পড়ে নেওয়া ভালো। এখানে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। পানিতে ও কাশবনে প্লাস্টিক বা বর্জ্য ফেলা কাম্য নয়।

লেখক: তরুণ কবি ও প্রতিষ্ঠাতা: বইবন্ধু পাঠাগার।

জেএমএস/জিকেএস