ফিচার

সামাজিক ট্যাবু প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য বড় বাধা

কন্যা সন্তান জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা অসন্তুষ্ট মন নিয়ে মেয়ের নামে একটি ডিপিএস খুলে ফেলেন। কারণ তাকে বিয়ে দিতে হবে এই টাকা দিয়ে। এরপর যখন ঐ কন্যার বয়স বারো কি তেরো হলো আর অমনি বাবা দিশেহারার মতো পাত্র খুঁজতে লাগলেন। যেন কন্যাকে কোনো রকমে পাত্রস্থ করতে পারলেই তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচেন। পরিসংখ্যান বলছে, এখনো প্রায় ৪৪ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার। বাল্য বিবাহের ফলে ১৪-১৫ বছরেই একজন নারীর গর্ভে বাচ্চা চলে আসছে। ফলে অনেক সময়ই দেখা যায় মা অথবা সন্তান জন্মের সময়ই মৃত্যুবরণ করছে। অথবা অপুষ্ট অবস্থায় মা ও সন্তান জটিলতার পথে বেড়ে উঠছে। এসব প্র্যাকটিস আমাদের একটি স্বাস্থ্যহীন জাতিতে পরিণত করছে।

Advertisement

সাধারণজ্ঞান হতেই মা-বাবার বোঝা উচিত, বাল্যবিবাহের প্রজনন স্বাস্থ্যগত কী জটিলতা তৈরি করছে। মানবিক জীব হিসেবে মা-বাবাকে সন্তানের ভবিষ্যৎ দুঃখ-কষ্টের কথা মাথায় রাখলে তাদের নিজেদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব হয়ে যায়। মা-বাবা মনে করেন ছেলে সন্তান জন্ম নিলে আমাকে উপার্জন করে খাওয়াবে। কিন্তু বর্তমান হচ্ছে উল্টোটা; কন্যা সন্তানই বরং এখন মা-বাবাকে বৃদ্ধ বয়সে খাওয়া-পড়ার দায়িত্ব নিচ্ছে। পরের ঘরে গিয়েও তারা এখন দায়িত্বটা পালন করছে। সমাজের চর্তুদিকে তাকালেই অহরহ তা দৃশ্যমান হয়। অন্যদিকে ছেলে সন্তান ১৭ বছর হলেই বিয়ে করে মা-বাবাকে আলাদা করে দিচ্ছে। কারণ সে নিজেই তার ইনকাম দিয়ে চলতে পারে না; মা-বাবাকে কীভাবে দেখবে। ১৭ বছরের একটি ছেলে আবার সন্তানেরও বাবা হয়ে যাচ্ছে। অপুষ্ট বাবা-মায়ের ঘরে অপুষ্ট সন্তানের আগমনে নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছে। হাসপাতালে গেলে লক্ষ্য করবেন অপুষ্ট সন্তান কোলে নিয়ে মা এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। জীবনের যাঁতাকলে পড়ে অপরিণত মা-বাবা ৪০ বছরেই বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটা একটি জৈবনিক দুষ্ট চক্র তৈরি করছে।

বাংলাদেশে এখনো প্রায় ৬০ শতাংশ সন্তান গর্ভে আসে অপ্রত্যাশিতভাবে। না চাইলেও মা-বাবার প্রজনন শিক্ষা না থাকার কারণে এ ঘটনাগুলো ঘটছে। অপ্রত্যাশিত সন্তান মানেই অসময়ের সন্তান, অপুষ্ট সন্তান। এটা কোনো পরিকল্পনার ফল ছিল না। আমি মনে করি বিবাহের পূর্বে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে কিছু পড়ালেখা ও জ্ঞানী মানুষের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ফেসবুক, ইউটিউব, গুগল থেকেও আমরা এগুলোর বিষয়ে সাধারণজ্ঞানটুকু জানতে পারি। বিবাহ করার সঙ্গে সঙ্গে সন্তান না নিয়ে একটু বুঝে-শুনে, অভিজ্ঞতা অর্জনের পরে সন্তান নিলে ভালো হয় বলে আমি মনে করি। প্রচলিত ট্যাবুমূলক কথা, ওঝা-কবিরাজের কথা শুনে কাজ করা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। মুরুব্বিরা অনেক উপদেশ দিয়ে থাকেন। এগুলোর অনেক কিছু হয়তো ভালো। কিন্তু অনেক কিছুই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। নব দম্পতিকে যৌনজীবন সম্পর্কে যেমন জানা দরকার; তেমনি জন্ম নিয়ন্ত্রণের বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় পদ্ধতি সম্পর্কে জানা আবশ্যক। অন্যথায় জটিলতার মুখোমুখি হওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না।

গর্ভে আসা অপ্রত্যাশিত সন্তান নিয়ে মা-বাবা অনেক সময় চরম বিপদে পড়েন। তারা গর্ভপাত ঘটাতে চান। এগুলো ধর্মীয়ভাবেও বড় পাপের কাজ আবার মায়ের মৃত্যু ঝুঁকিও থাকে অনেক বেশি। এসময় ক্লিনিকগুলো সুযোগ বুঝে ঐ দম্পতির নিকট হতে অনেক টাকা হাতিয়ে নেন। জানাজানি হলে সমাজেও হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়। অসচেতন যৌনজীবনও পরিবারের সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে। অনেক অপরিণত ছেলে-মেয়েরা শারীরিকভাবে নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন এবং দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হচ্ছে যা পরিবারকে ভাঙনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যৌন চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই স্বাস্থ্যগত দিকটি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। সময়-অসময়ের কথা চিন্তা না করে, শারীরিক সক্ষমতা বিবেচনা না করে স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গম জীবন অনেক সময়ই কষ্ট ডেকে আনে। ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক জীবন মেনে চললে রোগব্যাধি কম হয় এবং পরিশ্রম করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আর যখন শারীরিক সুস্থতা বেশি থাকে তখন তার দক্ষতা যেমন বৃদ্ধি পায়; তেমনি সৎ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার মনোবলও তৈরি হয়।

Advertisement

শহরে ও গ্রামের প্রতিটি ওয়ার্ডেই একজন স্বাস্থ্যকর্মী আছে। আমরা অনেকে হয়তো তাকে চিনিই না। এই স্বাস্থ্যকর্মী বা পরিবার পরিকল্পনা কর্মীর দায়িত্ব হচ্ছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দেওয়া। তারা পুরোপুরি এটা করেন না বলেই কেউ তাদের চেনেন না, জানেন না। পরিবার পরিকল্পনা কর্মী গ্রামের নারীদের কাছে গিয়ে পরিকল্পিত পরিবার বিষয়ে পরামর্শ সেবা প্রদান করবেন। এমনকি তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরবরাহ করবেন। কিন্তু ট্যাবু বা লজ্জার কারণে অনেক নারী তাদের নিকট খুলে অনেক কিছু বলেন না। ফলে যা হওয়ায় তাই হয়ে যায়। অনেক স্বামী কম আনন্দ পাবেন বলে নিজে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে স্ত্রীকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল সেবনে বাধ্য করেন। অনেক নারীর স্বাস্থ্যের সঙ্গে এই পিল সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। ফলে ওজন বেড়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, অবসাদ ও অলসতা বৃদ্ধি পাওয়া সহ নানান শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।

কোন পদ্ধতি সঠিক ও বাস্তবসম্মত তা পরিবার পরিকল্পনা কর্মীর সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। সন্তান গর্ভে আসার সঙ্গে সঙ্গেই নিয়মিত চেক-আপ করা জরুরি। এজন্য ওয়ার্ড স্বাস্থ্যকর্মী, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন মাতৃস্বাস্থ্য কেন্দ্রের শরণাপন্ন হওয়া আবশ্যক। এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হবে। সন্তান সম্ভবা মায়ের ওজন, রক্তচাপ, রক্তে সুগার, হিমোগ্লোবিন রেফারেন্স লেভেলে আছে কি না এ বিষয়টা সর্বদা চেক-আপ করাতে হবে।

এছাড়া সন্তান নেওয়ার আগে স্বামীর কিছুটা হলেও আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করা জরুরি। যেমন: চেক-আপ, ওষুধ ক্রয়, এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া, প্রয়োজনে সিজার করানো ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে টাকাটা জরুরি হয়ে পড়ে। সন্তান জন্মের পরে সন্তানের পাশাপাশি মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য একবার হলেও গাইনোকলজিস্টের শরণাপন্ন হওয়া দরকার। আমাদের দেশে সন্তান প্রসবের পরে অনেক মায়ের মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয়। ঘুম কমে যায়, খেতে পারে না, ওজন কমে যায়, বুকে দুধ আসে না ইত্যাদি বিষয় খেয়াল করা দরকার। অনেক মা বুকের দুধ সন্তানকে খাওয়াতে চায় না। এতে সন্তান যেমন চিরদিনের জন্য স্বাস্থ্যহীন হয়ে যায় তেমনি মায়ের ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। অনেক শিশু মায়ের বুকে দুধ পায় না। কীভাবে দুধ বাড়ানো যায় তা অবশ্যই জেনে রাখতে হবে। কারণ মায়ের বুকের দুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে না পেলে শিশু সারাজীবনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে যায়।

বন্ধ্যাত্ব বর্তমান সমাজে একটি ভয়াবহ ব্যাধি। ৩৫ বছরের পরে আমাদের দেশের নারীদের গর্ভে সন্তান আসতে চায় না। আসলেও অনেকের ক্ষেত্রে নানা ঝুঁকি তৈরি করে। রাসায়নিক ভেজালযুক্ত খাবার বন্ধ্যাত্বের অন্যতম প্রধান কারণ। নির্ভেজাল খাবার গ্রহণ করার চেষ্টা করতে হবে সব সময়। শহরে এ সমস্যাটা দূর করা কঠিন। ভার্চুয়াল লাইফ আমাদের যৌনজীবন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের অপূরণীয় ক্ষতি করছে। রেডিয়েশন রশ্মি ও পর্নচিত্র আমাদের সেক্স হরমোন কে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এতে দাম্পত্য জীবন যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি সন্তান জন্মদান, লালন-পালন করাও জটিল হয়ে পড়ছে। মোদ্দাকথা, ধর্মীয় জীবনের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক জীবনের মিল রেখে প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করলে জীবন সহজ ও সরল হয়।

Advertisement

কেএসকে/জিকেএস