চার্লস ব্যাবেজ আধুনিক কম্পিউটারের জনক হলে, অ্যাডা লাভলেস হচ্ছেন আধুনিক কম্পিউটারের জননী। চার্লস ব্যাবেজের সঙ্গে আধুনিক কম্পিউটার তৈরিতে তারও অবদান রয়েছে। যদিও তার নাম খুব বেশি মানুষ জানেন না। একজন সাধারণ নারী থেকে হয়ে উঠে ছিলেন কম্পিউটার বিজ্ঞানী। তিনিই প্রথম নারী কম্পিউটার বিজ্ঞানী।
Advertisement
পুরো নাম অ্যাডা অগাস্টা কিং। তবে তিনি পরিচিত ছিলেন অ্যাডা লাভলেস নামে। লাভলেস মূলত বিয়ের পর তার পরিবর্তীত বংশনাম। তাকে ডাকা হতো কাউন্টেস অব লাভলেস নামে। অ্যাডা ছিলেন একজন দুর্দান্ত গণিতবিদের পাশাপাশি, অ্যাডা ছিলেন নামকরা কবি, বিশ্লেষক ও দার্শনিক। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ধারণার একজন প্রবর্তক মনে করা হয় তাকে। তবে অ্যাডার জন্ম এবং যেসময়ে তিনি প্রোগ্রামিং নিয়ে ভেবেছেন সেসময় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন নারীর কম্পিউটার বিজ্ঞানী হয়ে ওঠা ছিলো আকাশকুসুম ভাবনা ছাড়া আর কিছুই নয়!
অ্যাডা লাভলেসের জন্ম ১৮১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন অগাস্টা অ্যাডা বায়রন। অ্যাডা লাভলেসের বাবার নাম বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি লর্ড বায়রন। তাকে বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি লর্ড বায়রনের কন্যা হিসেবে না হলেও, পৃথিবীর প্রথম প্রোগ্রামার হিসেবে তার সুখ্যাতি আছে। অ্যাডা গাণিতিক সংশয়গুলোকে কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলতেন অধিকাংশ সময়। তার এসব কাজকে অনেকে ‘পোয়েটিকাল সায়েন্স’ বলেও অভিহিত করেছেন।
আরও পড়ুন: বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় যেসব স্থান
Advertisement
তার ছেলেবেলা কেটেছে নানির কাছে। যদিও তার বাবা-মা দুজনেই বেঁচে ছিলেন। তার লালন-পালনের দায়িত্ব নেন বৃদ্ধ নানী। কয়েক বছর পর তিনিও অ্যাডাকে ছেড়ে পরপারে চলে যান। পরবর্তীতে অ্যাডা বিভিন্ন আয়াদের কাছে বড় হন। আলাদা থাকলেও অ্যাডার মা ইসাবেলা মেয়ের পড়ালেখার বিষয়ে মনযোগী ছিলেন।
বিশেষ করে গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। ১০ বছর বয়সেই তিনি ডায়েরি ঘেটে অ্যাডার মাঝে সুপ্ত সাহিত্য প্রতিভা আবিষ্কার করেন। তবে তার বিশ্বাস ছিল সাহিত্য চর্চা মানুষকে নৈতিকভাবে দুর্বল করে ফেলে। ১৭ বছর বয়সেই অ্যাডার ভাগ্য পাল্টে দেওয়ার মতো এক ঘটনা ঘটে। তখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের লুকেসিয়ান অধ্যাপক ছিলেন কম্পিউটারের জনক বলে পরিচিত চার্লস ব্যাবেজ। তিনি জানতে পারেন বিখ্যাত কবি লর্ড বায়রনের মেয়ে অ্যাডা বায়রন গণিতে সব শিক্ষার্থীর চেয়ে সেরা।
তখন চার্লস ব্যাবেজ ‘ডিফারেন্স ইঞ্জিন’ নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি অ্যাডাকে নিজের গবেষণার সহযোগী হিসেবে পাওয়ার ইচ্ছের কথা জানান। অ্যাডা সেদিন যেন স্বর্গে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন! ব্যাবেজের এই আমন্ত্রণের সূত্রে পূর্বের চেয়ে অনেক গাঢ় হয়ে ওঠে মা-মেয়ের সম্পর্ক। অ্যাডা লাভলেস ১৮৩৩ সালের ৫ জুন ইংল্যান্ডে চার্লস ব্যবেজের সঙ্গে দেখা করেন
ডিফারেন্স ইঞ্জিন দেখার পর অ্যাডার কাজের প্রতি উৎসাহ ও জানার ইচ্ছে আরও প্রবল হয়ে ওঠে। এরপর তিনি বিভিন্ন যন্ত্রের কলাকৌশল বুঝতে বিভিন্ন কলকারখানায় যাওয়া শুরু করেন। এর মধ্যে ‘জ্যাকার্ড লুম’ নামক একটি বস্ত্রবুনন যন্ত্র অ্যাডার জন্য অত্যন্ত সহায়ক হয়।
Advertisement
জ্যাকার্ড লুম যন্ত্রটি পরিচালিত হতো এক প্রকার পাঞ্চকার্ডের মাধ্যমে। এই যন্ত্রে নির্দিষ্ট পাঞ্চকার্ড প্রবেশ করালে নির্দিষ্ট ধরনের বয়ন পরিচালিত হতো। এ ব্যাপারটিকে তিনি যন্ত্রের প্রতি নির্দেশনা তথা ‘মেশিন কোড’ হিসেবে অভিহিত করেন। তখন থেকেই প্রোগ্রামিংয়ের ধারণা মাথায় ঘুরতে থাকে অ্যাডার।
এরই মধ্যে তখনকার অন্যতম সেরা গণিতবিদ সমারভিলের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তার হাত ধরেই জটিল সব গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে শুরু করেন অ্যাডা। তবে ১৮৩৫ সালে আর্ল অব লাভলেস, উইলিয়াম কিং কে বিয়ে করেন অ্যাডা বায়রন। ১৮৩৬-৩৯ সালের মধ্যে তিন সন্তানের মা হন। তাদের পরিচর্যায় ব্যস্ত অ্যাডা বেশ পিছিয়ে পড়েন গাণিতিক জগত থেকে।
আরও পড়ুন: হেলিপ্যাডে ‘এইচ’ লেখা থাকে কেন?
কিন্তু কিছুই যেন অ্যাডাকে গণিত থেকে দূরে রাখতে পারেনি। সব ব্যস্ততার পাশাপাশি লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যাপক বিখ্যাত গণিতবিদ ডি মরগানের সঙ্গে উচ্চতর সব গাণিতিক সমস্যা সমাধানের কাজ শুরু করলেন। জটিল কম্পিউটার অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন এর ধারণা উপস্থাপন করেন। কম্পিউটারের ইতিহাসে এটি ছিল একটি বৈপ্লবিক অধ্যায়। তবে অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের ধারণা সে সময়ের সাপেক্ষে এত অগ্রসর ছিল যে অধিকাংশের জন্যই তা বোধগম্য হচ্ছিল না।
কোনো এক লুইজি মেনাব্রিয়া নামক ফরাসি ব্যক্তি ব্যাবেজের লেকচার এবং অন্যান্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে রচনা করলেন ‘দ্য স্কেচ অব চার্লস ব্যাবেজ'স অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন’। বইটি ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন অ্যাডা। তার অনুবাদ এতটাই প্রাঞ্জল ছিলো যে, ব্যাবেজ তাকে অনুপ্রেরণা দেন। পরবর্তীতে দুই বছরের মধ্যে বইটির দ্বিতীয় ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করেন অ্যাডা। তার অসংখ্য বীজগাণিতিক উপায় যোগ করেন তার নোটগুলোতে।
অ্যাডা পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার অ্যালগরিদম রচনা করেন। বার্নোলি সংখ্যার এই অ্যালগরিদমের জন্যই অ্যাডা লাভলেসকে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার। তবে শুধু প্রোগ্রামিং এর মধ্যেই তার নাম আবদ্ধ করে ফেললে তার সঙ্গে অবিচার করা হবে। এই যুগের আধুনিক কম্পিউটারের ধারণা প্রবর্তনে ব্যাবেজের পাশাপাশি অ্যাডার ভূমিকাও অপরিসীম।
চার্লস ব্যাবেজ আর অ্যাডা লাভলেস যখন দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছেন কম্পিউটার বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিপ্লব ঘটাতে, তখন পিছুটান হয়ে আসে অ্যাডার স্বাস্থ্য। যুগান্তকারী অ্যালগরিদম রচনার কিছুকাল পরই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তিনি বেশ কয়েক বছর যাবত জরায়ুর ক্যানসারে ভোগেন। যদিও তখনকার অনুন্নত চিকিৎসাবিজ্ঞান তার রোগ সঠিকভাবে নির্ণয়ই করতে পারেনি।
তার অবস্থা দিন দিন অবনতি দেখে ডাক্তাররা তার উপর গ্যালেনের ‘রক্তক্ষরণ’ পদ্ধতিও প্রয়োগ করে। তাতেও কাজ হয়নি। ১৮৫২ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। জরায়ুর ক্যান্সার এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মাত্র ৩৬ বছর বয়সেই মারা যান তিনি। প্রতিবছর অক্টোবরের দ্বিতীয় মঙ্গলবার অ্যাডা লাভলেস দিবস পালন করা হয় সারাবিশ্বে।
সূত্র: ডেইজ অব দ্য ইয়ার, কম্পিউটার হিস্টোরি
কেএসকে/এমএস