মতামত

অর্থনীতি ঠিক পথে আছে তো?

দেশের রাজনীতি নিয়ে, নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষ খুব বেশি না ভাবলেও তারা দুর্ভাবনায় আছে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে। আমেরিকার ভিসানীতি, স্যাংশন ইত্যাদি নিয়েও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তবে বাজারে গিয়ে প্রতিদিন যে মানুষের মাথা গরম হয়ে উঠছে, তা অস্বীকার করা যাবে না।

Advertisement

মূল্যবৃদ্ধির এই ধারা যদি আরও দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকে তাহলে পরিণতি কি হবে তা কি কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারবেন? অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য থেকে মনে হয় না তিনি খুব বিচলিত আছেন। ৮ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, কিছু সমস্যায় আমরা আছি। রিজার্ভ নিয়ে অনেকে কথা বলে- আমি বলছি রিজার্ভ নিয়ে অত চিন্তার কিছু নেই। আমার গোলায় যতক্ষণ খাবার আছে ততক্ষণ চিন্তা করি না।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা চাওয়া একটাই, একটাই স্বপ্ন, যেটা আমার বাবা এ দেশের মানুষকে নিয়ে দেখেছিলেন। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা আর তাদের জীবন মান উন্নত করা। আজ পর্যন্ত যতটুকু করতে পেরেছি ভবিষ্যতের জন্য যেন সেটা স্থায়ী হয় চলমান থাকে, সেটাই আমার একমাত্র দাবি সবার কাছে। দিনরাত পরিশ্রম করে আজকে বাংলাদেশকে যে জায়গায় নিয়ে এসেছি তাঁর থেকে বাংলাদেশ যেন কিছুতেই পিছিয়ে না যায়।’

দেশের প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনার জন্য তাঁর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘ফসল ফলাবো নিজের খাবার নিজেরা খাব, কেনাকাটা বা খরচ না হয় আমরা একটু কমই করব।’প্রধানমন্ত্রীর এই আশাবাদ দেশের মানুষের মনে কতটা বিস্তৃত হচ্ছে, প্রশ্ন সেটাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা রকম মত-মন্তব্যের ছড়াছড়ি। কেউ কেউ মনে করেন, গণতন্ত্রের নাজুক অবস্থা, ভোটের গণতন্ত্র নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে মাথাব্যথা নেই। এমনকি মফঃস্বলের প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক মনে করেন, গণতন্ত্র দরকার মির্জা ফখরুলের, ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের এবং যারা লেখালেখি করেন, তাদের। যে মানুষ ক্ষমতায় যেতে চায় না এবং যার মতামত প্রকাশ করার কোনো জায়গা নেই, গণতন্ত্র দিয়ে তিনি কী করবেন? বিরোধীদলের প্রতি নির্যাতন-নিপীড়নের ব্যাপারেও সাধারণ মানুষ কি খুব বিচলিত?

Advertisement

তবে গ্রামাঞ্চলে যাদের সঙ্গে কথা বলা যায় তাদের অনেকেই বলেছেন, সংসার চালাতে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে এবং কোথাও কোথাও তারা স্থানীয় পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর আচরণে ক্ষুব্ধ, কেউ কেউ তাদের হয়রানিরও শিকার হয়েছেন। তারা বলেছেন, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য কী অবস্থায় থাকে তার ওপর নির্ভর করবে, তারা কাকে ভোট দেবেন। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি তাদের এখনও আস্থা রয়েছে। আবার কোথাও কোথাও মানুষ এটাও বলছেন যে আগামী নির্বাচনে বর্তমান এমপি আবারও দাঁড়ালে তারা নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন না।

এগুলোই যদি গ্রামবাংলার মানুষের প্রকৃত ভাবনা হয়ে থাকে তাহলে এগুলো তো আওয়ামী লীগের জন্য সতর্কবার্তাও বটে। কারণ দ্রব্যমূল্য না কমলে এবং নির্বাচনের মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে সতর্ক না হলে আওয়ামী লীগকে সমস্যায় পড়তে হবে।

এটা ঠিক যে, আওয়ামী লীগের জন্য দ্রব্যমূল্যের চাইতেও বড় কনসার্ন হচ্ছে বর্তমান ক্ষমতাসীন নেতাদের কারো কারো প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষুব্ধতা। বাংলাদেশের সার্বিক বাস্তবতায় সাধারণভাবে একজন সৎ ও যোগ্য ক্ষমতাসীন নেতার পক্ষেও তাঁর এলাকার ভোটার, সমর্থক, কর্মীবাহিনী, নানা স্তরের নেতা- সবার সন্তুষ্টি দীর্ঘদিন ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব। তার ওপর অনেক নেতার কার্যক্রমই বরং নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। মনে করা হচ্ছে, বিএনপি নির্বাচনে না এলে আওয়ামী লীগ প্রতিটি আসনে দলীয় বিকল্প নেতাদেরও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করবে, যাতে নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদি তাই করা হয়, তাহলে অবশ্য আশার কথা, এই বিকল্প প্রার্থীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয়ী গ্রুপ হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে বলে কারো কারো ধারণা।

অবশ্য আশার কথা, সরকারের পক্ষে বলার লোকও দেশে অনেক আছে। অনেকে সরকারের ওপর সন্তষ্ট এই কারণে যে, স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে, এছাড়াও বড় বড় খুনের ঘটনায় বিচার হচ্ছে। দেশে জঙ্গিদের ঘাঁটি তছনছ করে দেওয়া হয়েছে, দুর্নীতিতে দেশ এক নম্বর হচ্ছে না, গরিব মানুষের সংখ্যা কমেছে। ভ্যান রিকশা চালক, শ্রমিকসহ সকল শ্রেণির আয় বেড়েছে। রিকশার সর্বনিন্ম ভাড়া ২০ টাকা। দশ বছর আগে ১০ টাকা দিয়ে রিকশায় যে পথ পাড়ি দেওয়া যেত এখন ঐ পথের ভাড়া ৩০ থেকে ৪০ টাকা হয়েছে।

Advertisement

সাধারণ লেবার ৬০০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না, একজন কাজের বুয়া বিভিন্ন বাসায় কাজ করে মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করে। একজন উবার চালক ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা আয় করে প্রতিদিন। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের দাম পাচ্ছেন। জনগণের খরচ এবং সময় বাঁচাতে সরকার মেট্রোরেল রেল, এক্সপ্রেস ওয়ে, দ্রুত গতির ট্রেনসহ আট লেন, দশ লেন সড়ক তৈরি করছে। পাতাল রেল, আশুলিয়ায় থেকে পুরো এক্সপ্রেস ওয়ে চালু হলে, গাজীপুর বিআরটিএ চালু হলে সুফল পাওয়া যাবে।

কর্মসংস্থান বেড়েছে, উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। আগের দিনের মতো এক ধারার ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। অনলাইনের কল্যাণে লাখ লাখ নতুন নতুন কাজ এবং ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। পৃথিবীর সব দেশেই এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশের থেকে বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের দাম সহনশীল।

 

গ্রামাঞ্চলে যাদের সঙ্গে কথা বলা যায় তাদের অনেকেই বলেছেন, সংসার চালাতে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে এবং কোথাও কোথাও তারা স্থানীয় পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর আচরণে ক্ষুব্ধ, কেউ কেউ তাদের হয়রানিরও শিকার হয়েছেন। তারা বলেছেন, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য কী অবস্থায় থাকে তার ওপর নির্ভর করবে, তারা কাকে ভোট দেবেন।

 

দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে গণমাধ্যমে যেসব খবর ছাপা হয় বা হচ্ছে তা আবার খুব আশা জাগানিয়া নয়। মহামারি করোনা এবং পরে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে সৃষ্ট অস্থিরতার ধাক্কা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও লেগেছে। ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ ধাক্কা কাটিয়ে উঠলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তার প্রতিফলন নেই। বরং দেশে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক আগের চেয়ে আরও দুর্বল হয়েছে।

৪৮ বিলিয়ন ডলারে ওঠা রিজার্ভ কমে এখন ২১ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। টানা কমছে প্রবাসী আয়। গতি নেই রপ্তানি আয়ে। ফলে ডলারের সংকট কাটেনি, বরং দাম আরও বেড়েছে। কড়াকড়িতে কমে গেছে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি। স্থবিরতা এসেছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে। লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণও। অন্যদিকে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে মূল্যস্ফীতি। সব মিলে সার্বিক অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়ছে।

রিজার্ভ কমতে থাকায় চলমান এই সংকট সামাল দিতে ঋণের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হয় সরকার। দাতা সংস্থাটি থেকে বিভিন্ন শর্তে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অনুমোদনও মিলে, যার প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার গত ফেব্রুয়ারিতে ছাড় করা হয়। এই ঋণ পাওয়ার পর দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো যে আশা করা হয়েছিল, বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই। ফলে এই ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় যথাযথ নীতি নেওয়া হয়নি। এর ফলে সংকট কাটিয়ে ওঠার বদলে আরও বেড়েছে বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি মনে করেন, আমার যদি অসুখ হয় এবং আমি যদি সঠিক ওষুধ গ্রহণ না করি, চিকিৎসা যদি না করি, তাহলে আমার শরীরটা তো আরও খারাপের দিকে যাবে। আমাদের অর্থনীতির বেলায় সেটিই হয়েছে। সংকট উত্তরণে করণীয় প্রসঙ্গে তার পরামর্শ হলো, আমরা স্বল্পমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি। যার মধ্যে একটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে। সুদহার বাড়িয়েছে। এটা ধাপে ধাপে আরও বাড়াতে হবে। বাজেটের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেওয়া কমাতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারকে ভালোভাবে সাশ্রয়ী হতে হবে। বিদেশি ঋণ পেতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, একদিকে আমাদের অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে অস্থিরতা ও ঝুঁকি বেড়েছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য এখন আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দোহাই দিলে হবে না। কারণ বিশ্বের অন্যান্য দেশ সংকট ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছে। আমাদের এখানে তার প্রতিফলন নেই। এর পেছনে একটাই কারণ, আমরা যে মডেলে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছি, তা প্রথাগত মডেল না। নিজেদের মতো করে অর্থাৎ ‘অপ্রথাগত’ নীতিতে মোকাবিলা করতে গিয়ে কাঙ্খিত ফল মেলেনি।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অর্থনীতিতে চাপ ক্রমে বাড়ছে। এক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই অন্যতম কারণ। আমাদের যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা নজরদারি-খবরদারি করবে, সেসব প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ও সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির শুরুটা বৈশ্বিক কারণে হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের অন্যান্য দেশে তা কমে এলেও দেশে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এটা শুধু ব্যাংকিং খাতকে দুর্বল করছে না, বিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সুশাসন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, সরকারি বিভিন্ন সেবা প্রদানের মান বৃদ্ধি- এ বিষয়গুলোকে যদি এখনই আমরা গুরুত্ব না দেই, তাহলে কিন্তু এটা আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমাবে এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেবে। পাশাপাশি সামনে নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে সেটাও ভাবনার বিষয়। কোনো ধরনের অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির প্রভাব সর্বপ্রথম অর্থনীতিতেই পড়বে। তাই এ রকমটি যেন না হয় সেদিকটিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা আমাদের নিতে হবে। দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা যারা ভাবেন, সেই অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ সরকারকে নিতে হবে। ‘আমরা যা করছি তাই ঠিক’- এই মনোভাব পরিহার করতে হবে। তেলা মাথায় তেল দেওয়ার নীতি অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

০৯ অক্টোবর, ২০২৩লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।

এইচআর/জিকেএস