ডেঙ্গুর প্রকোপ যখন চরমে তখন দেখা দিয়েছে স্যালাইনের সংকট। প্রাণঘাতী এ রোগের চিকিৎসায় ফ্লুয়িড ম্যানেজমেন্ট জরুরি হলেও স্যালাইনের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা। খুচরা বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই স্যালাইনের। সংকট কাটাতে বাজারে অভিযান, সরাসরি স্যালাইন কেনার মতো নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ অবস্থায়ও সরকারিভাবে যে স্যালাইন উৎপাদন করতো জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, সে স্যালাইনের উৎপাদন বন্ধ প্রায় সাড়ে তিন বছর। সম্প্রতি নানা আলোচনা-সমালোচনার পর ফের উৎপাদনে ফেরার চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য শুরু হয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ। তবে ঠিক কবে নাগাদ এ স্যালাইন পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি।
Advertisement
প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হওয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি দামেই স্যালাইন কিনে তা হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করছে এসেন্সিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড। জনগণকেও চড়া দামে কিনতে হচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানির স্যালাইন। যেখানে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ৫০০ এমএল ২২ টাকায় সরবরাহ করতো সেখানে বেসরকারি কোম্পানিগুলো একই স্যালাইন ১০০-১৫০ টাকায় বিক্রি করে। সমালোচনা রয়েছে, কোম্পানিগুলোকে ব্যবসার একচেটিয়া সুযোগ করে দিতেই বন্ধ করা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন।
উৎপাদন কার্যক্রম শুরুর জন্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা এসেছে। এবার পুরো প্রতিষ্ঠান ডব্লিউএইচও’র গাইডলাইন অনুযায়ী নতুন করে তৈরি করা হবে। ভবনের সংস্কার শেষ হলে আশা করছি ৬ মাসের মধ্যেই উৎপাদনে যেতে পারবো।
সরেজমিনে মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের স্যালাইন উৎপাদন কারখানা পরিদর্শনে দেখা গেছে, বিদ্যুতের কারখানায় সংযোগ বন্ধ। ধুলা-কালির আস্তরণ পড়ে রয়েছে মেশিনগুলোতে। পুরো ভবনের অবস্থাই রুগণ। এর মাঝে চলছে মূল কলামগুলোর কিছু মেরামতের কাজ। স্টোররুমে গিয়ে দেখা গেছে, সর্বশেষ উৎপাদিত স্যালাইনের প্রায় ৫০ হাজার ব্যাগ পড়ে রয়েছে। কয়েকটি অফিস রুমে কর্মকর্তারা আছেন। তারা প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করছেন।
Advertisement
২০২০ সালের ১৫ জুন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক নোটিশে বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ও বিপণন। স্যালাইন উৎপাদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) অনুযায়ী ঔষধ প্রশাসনের শর্তযুক্ত একটি লাইসেন্স রয়েছে। এর মাঝে মৌলিক কিছু শর্ত ভঙ্গ হচ্ছিল বলে বাতিল করে দেওয়া হয় লাইসেন্স।
এ প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে ২০ লাখ স্যালাইন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সর্বশেষ যখন বন্ধ করা হয় সে বছরও ১২ লাখ স্যালাইন উৎপাদন হয়েছিল। এ সংকটের সময় কারখানা চালু থাকলে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারতো।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যেদিন থেকে লাইসেন্স বাতিল করা হয় সেদিন থেকেই বন্ধ উৎপাদন। লাইসেন্সে যেসব শর্তের কথা বলা ছিল তার মধ্যে একটি ছিল স্যালাইন উৎপাদনের কার্যক্রম একই তলায় হতে হবে। সেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় তলা মিলিয়ে চলছিল উৎপাদন কার্যক্রম। পুরো ভবনে প্রয়োজন ছিল এইচব্যাক সিস্টেম। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও জীবাণুমুক্ত রাখা হয় এ সিস্টেমের মাধ্যমে, যা ছিল না। ছিল না কোনো উন্নতমানের স্টোরেজ ব্যবস্থা। এখন এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন>> ‘১০০ টেকার স্যালাইন কিনলাম চারশ টেকা দিয়া’
Advertisement
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের স্যালাইন বিভাগের কেমিস্ট হেলাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, এখানে বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি এসএসের তৈরি ও অত্যাধুনিক মানের। এ কারণে যন্ত্রগুলো একেবারে নষ্ট হওয়ার শঙ্কা নেই। যন্ত্রপাতিগুলো সার্ভিসিং করা হলে সেগুলো আবারও সচল করা সম্ভব। আগে নিচতলা ও দ্বিতীয় তলা মিলিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালিত হতো। নতুন যে নকশা করা হয়েছে তাতে সম্পূর্ণ উৎপাদন কার্যক্রম নিচতলায় নামিয়ে আনা হবে। অফিস রুমগুলো অন্য তলায় সরিয়ে নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, স্যালাইনে থাকে লবণাক্ততা। এতে ভবনের রঙ এবং দেওয়ালের আস্তরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ভবনের বয়স খুব বেশি না হলেও দেখতে রুগণ। এ পরিস্থিতিতে ভবন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার বদলে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর পিডব্লিউডি ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। এরপরও স্বাস্থ্য সেবায় গুরুত্ব থাকায় ২০২০ সাল পর্যন্ত কার্যক্রম চলমান থাকে প্রতিষ্ঠানটির। পরিত্যক্ত ঘোষণা করায় আর কোনো উন্নয়নমূলক কার্যক্রম করা হয়নি। ফলে ডিজিডিএ যখন পরিদর্শনে আসে তখন ভবনটির অবস্থা ছিল আরও ভগ্ন। সব মিলিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে ইনস্টিটিউটের স্যালাইন উৎপাদন বিভাগের সুপারিনটেনডেন্ট মমিনুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, উৎপাদন কার্যক্রম শুরুর জন্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা এসেছে। এবার পুরো প্রতিষ্ঠান ডব্লিউএইচও’র গাইডলাইন অনুযায়ী নতুন করে তৈরি করা হবে। ভবনের সংস্কার শেষ হলে আশা করছি ছয় মাসের মধ্যেই উৎপাদনে যেতে পারবো।
আরও পড়ুন>> আইভি স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে ১০ গুণ, সংকটের আশঙ্কা
তিনি আরও জানান, ৬ কোটি টাকা গত বছর পাওয়া গেছে। তা দিয়ে ভবনের কলাম এবং আস্তর সংস্কারের কাজ শুরু করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির একটি সূত্র জানায়, ভবনের আয়ু বাড়াতে ভবনের উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান। এছাড়া বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ নতুন করে ঠিক করা হচ্ছে। কারখানা সচল করার জন্য করা হয়েছে নতুন লে আউট। তবে মূল কার্যক্রম শুরু হবে লে আউট অনুযায়ী যেসব কাজ করতে হবে সেগুলোর বাজেট পেলে। এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞ দল কারখানা পরিদর্শন করেছে। এখন মূল কাজের বাজেট পেলেই উৎপাদনের মূল প্রস্তুতি নেওয়া যাবে। সেটি কবে নাগাদ হবে তা নিশ্চিত নয়।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মো. নাসির উদ্দিন জানান, এ প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে ২০ লাখ স্যালাইন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সর্বশেষ যখন বন্ধ করা হয় সে বছরও ১২ লাখ স্যালাইন উৎপাদন হয়েছিল। এ সংকটের সময় কারখানা চালু থাকলে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারতো।
আরও পড়ুন: ভারত থেকে বেনাপোলে এলো ৫০ হাজার ব্যাগ স্যালাইন
তখন যে লোকবল ছিল তারা কোথায়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তখনকার সময়ে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রাতিষ্ঠানিক লোকবল ছিল ৯০ জন। তাদের সঙ্গে সহকারী এবং কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় ২০০ শতাধিক লোক এখানে কাজ করতো। যারা ছিলেন তাদের মাঝে অনেকে সরকারি চাকরির নিয়মে অবসরে গেছেন। অনেকে গেছেন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে। কিছু লোকবল প্রাতিষ্ঠানিক অন্য কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত।
কিছু ফার্মাসিটিউক্যাল কোম্পানির প্রভাবে বন্ধ হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি, এমন অভিযোগের সত্যতা আছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে বন্ধ হওয়ার সুযোগ নেই। তখনকার সময়ে যে ভবনটিতে উৎপাদন চলছিল সেটি একেবারেই ভগ্ন অবস্থায় ছিল। এটাকে নতুন করে সংস্কার করা খুবই প্রয়োজন ছিল। যে কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে তারা কয়েক বছর ভবনটি পরিদর্শন করছিল। তাদের পক্ষ থেকে শর্ত পূরণ করতে বলা হলেও তখন সেসব শর্ত পূরণ করা হয়নি।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে বন্ধ হওয়ার সুযোগ নেই। তখনকার সময়ে যে ভবনটিতে উৎপাদন চলছিল সেটি একেবারেই ভগ্ন অবস্থায় ছিল। এটাকে নতুন করে সংস্কার করা খুবই প্রয়োজন ছিল। যে কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে তারা কয়েক বছর ভবনটি পরিদর্শন করছিল। তাদের পক্ষ থেকে শর্ত পূরণ করতে বলা হলেও তখন সেসব শর্ত পূরণ করা হয়নি।
আরও পড়ুন: ফার্মেসিতে স্যালাইন সংকট প্রকট, বিপাকে ডেঙ্গুরোগীরা
যেসব কারণে লাইসেন্স বাতিল হয়েছিল তা পুনরায় অর্জনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, লাইসেন্স ছাড়া প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যেতে পারবে না। আমাদের বর্তমানে লাইসেন্স অর্জনের পূর্বশর্ত হচ্ছে একটি লে আউট বা ডিজাইন তৈরি করা। ডিজিডিএ’র গাইডলাইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে করা একটি টিম প্রতিষ্ঠানটির নতুন লে-আউট পাস করেছে। সিনিয়র সচিব, জনস্বাস্থ্য বিভাগের সচিবরা এটি পরিদর্শন করে গেছেন। শর্ত পূরণে কী করতে হবে, কী ব্যবস্থা নিলে প্রতিষ্ঠানটি চালু করা যাবে তা আমরা লিখিত জানিয়েছি।
এএএম/এমএইচআর/এসএইচএস/এমএস