এস এম মাছুম বিল্লাহ
Advertisement
মন উতলা হয়ে উঠলো। ভ্রমণের জন্য কোথায় যাওয়া যায়? তখনই মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথা, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া’। আমি একজন প্রকৃতি প্রেমিক। তাই পাহাড়, সমুদ্র, মাঠ, মেঠোপথ আমাকে খুব টানে। এর আগেও পাহাড় দেখতে গিয়েছিলাম সিকিম। তাই ১০ সেপ্টেম্বর কিছু ভ্রমণপিপাসু মানুষের সঙ্গে কক্সবাজার ও সাজেকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।
আমাদের যাত্রা শুরুর দিন মেঘলা আকাশ। বিকেল ৩টার দিকে রওয়ানা করি। কক্সবাজার বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত একটি নৈসর্গিক সৌন্দর্যময় দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। অবিচ্ছিন্ন প্রকৃতি বালুময় সমুদ্রসৈকত, যা ১২০ কিলোমিটার বিস্তৃত। ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪১৪ কিলোমিটার। এটি বাংলাদেশের বড় পর্যটন কেন্দ্র। রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক ও আকাশপথে যাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রেললাইনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। হয়তো কিছুদিনের মধ্যে চালু হবে আশা করা যায়। এখানে প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসেন। এখানে রয়েছে সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর এবং সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন। এক সময় কক্সবাজার ‘প্যানোয়া’ নামেও পরিচিত ছিল; যার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘হলুদ ফুল’। আমরা ছয়জন রাত ১টায় বহুল কাঙ্ক্ষিত কক্সবাজার এসে পৌঁছলাম। হোটেলে পৌঁছে লাগেজ রেখে যে যার মতো রাতেই কলাতলি বিচে চলে গেলাম। সাগরের বিশালত্ব আর গর্জন শুনে নিজের বহুল প্রতীক্ষিত সৈকত দেখে অস্থির মনটাকে শান্ত করলাম।
Advertisement
আরও পড়ুন: অপরূপ সৌন্দর্যের আরেক নাম বাওয়াছড়া
আমরা কেউ ভুল করিনি গভীর রাতে সমুদ্রের পানিতে পা ভেজাতে। কিছুক্ষণ থেকে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। সকালের অপেক্ষায় এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টায় কখন যে সকাল হয়ে গেল টের পাইনি কেউ। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কোনোমতে নাস্তা শেষ করে ফটোগ্রাফার নিয়ে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ফটোগ্রাফার যেভাবে খুশি; সেভাবেই তার মনমতো আমাদের ছবি তুলছেন। আমরা পানিতে বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে লাফাতে লাগলাম।
সাগরে যাবো আর সামুদ্রিক মাছ খাবো না, তা কি হয়? মাছ খেলাম, ডাব খেলাম, ঘোড়ার পিঠে উঠলাম, সমুদ্রের পাড়ে বাইকে ঘুরলাম। এখানকার পরিবেশ এবং আবহাওয়া অসাধারণ। উপরে বিশাল নীল আকাশ, নিচে সুবিশাল সাগর। সাগরে বড় বড় ঢেউ আমাদের আনন্দিত ও পুলকিত করছে। আনমনে কবির একটি লাইন মনে পড়ে গেল, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে,/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।’
টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক, যা বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে কক্সবাজারের কলাতলি সৈকত থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বর্তমানে পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়ক; যার এক পাশে পাহাড় আর অন্য পাশে নীল জলরাশি। আমরা যখন গাড়ির দরজা খুলে মেরিন ড্রাইভ ধরে চলতে থাকি; তখন এক অসাধারণ অনুভূতি ছুঁয়ে যায় মন। মৃদু হাওয়া আর সাগরের গর্জন; প্রকৃতির মায়া ভরা দৃশ্য মনমুগ্ধকর একটি পরিবেশ। কিছু দূর যেতে না যেতে বড় বড় ডাব খেতে ভুল করিনি, সেটাও স্বাদে পরিপূর্ণ। ক্ষুধায় পেটের ভেতর গর্জন শুরু হয়ে গেল। পরে কোরাল মাছ আর ভর্তা দিয়ে খেয়ে নিলাম দুপুরের খাবার। ওইদিনই রওনা দিলাম খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে।
Advertisement
আরও পড়ুন: মহামায়ায় গিয়ে যা দেখবেন
খাগড়াছড়ি ও সাজেক ভ্যালিআমাদের দেশের আরেক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাজেক। সাজেক হলো ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে মেঘের ভেলার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগের আরেক মুগ্ধকর অনুভূতি। আকাশ যদি মেঘলা হয় তাহলে তো কথাই নেই। মনে হবে আপনার রুমের বেলকনিতে মেঘ এসে অপেক্ষা করছে, আপনাকে ডাকছে। আমার মনে হয় রূপকথার মেঘের চাদর আমাকে নিতে এসেছে, এই সৌন্দর্য, যা সমুদপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উপরে।
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক আসার পথে প্রাকৃতিক পরিবেশ, উঁচু-নিচু পাহাড়ের ভাঁজ, দূর পাহাড়ের হাতছানি, শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে যে প্রকৃতি সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে তা মনমুগ্ধকর। আমার মনে হয়েছে মেঘ, পাহাড়, সমুদ্র, বাতাস, গাছপালা ওরা যেন একে অপরের ভাই, বন্ধু। ওরা কী যেন বোঝাতে চাচ্ছে। মনে হয় ওদেরও নিজস্ব একটি ভাষা আছে, যা আমি অনুভব করলেও বোঝাতে পারবো না।
এই পথে আমাদের যাত্রা শুরু ১২ সেপ্টেম্বর বিকেলে কক্সবাজার থেকে। নিজস্ব পরিবহনে রাস্তার দুই ধারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা খাগড়াছড়ি এসে পৌঁছাই। আসতে গভীর রাত হয়ে যায়। রাত ১২টার পরে আর যাওয়া যাবে না এ পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে, আপাতত যাত্রা এ পর্যন্ত। আমরা খাগড়াছড়িতে একটি হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে আবার রওয়ানা দিই। নিয়ম অনুযায়ী বেলা ১১টার শিডিউলে যাত্রা করে সাজেকে পৌঁছলাম। আগেই নির্ধারিত ‘অবকাশ ইকো কটেজে’ উঠে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চের জন্য হোটেল মনটানায় এলাম। সাদা ভাতের সঙ্গে বাম্বু চিকেন, লাউয়ের সবজি, ডাল আর স্পেশ্যাল হলুদ ফুলের সালাদ দিয়ে পেটপুরে খেয়ে নিলাম।
আরও পড়ুন: একদিনেই কীভাবে ঘুরে আসবেন মহামায়া লেক থেকে?
কেউ বিশ্রাম নিতে কটেজে, কেউ চারপাশটা ঘুরে দেখলাম। বিকেলে সবাই বের হই রইলুইপাড়া, হামারিপাড়া এবং কংলাকপাড়া দেখতে। তিন পাড়ার মধ্যে কংলাক পাড়া উঁচু, সেখানে হেঁটে উঠতে বাঁশের লাঠি নিলাম। সত্যিই উঁচু পাহাড় থেকে নিচের দৃশ্যটা ছিল দেখার মতো। এর চেয়েও উঁচু পাহাড় দেখে এসেছি সিকিম থেকে। দিনটা ভালোই গেল। রাতে গানের আড্ডা হ্যালিপ্যাডে বসে। রাতের খাবারে ছিল বনমোরগ।
পরদিন সকালে চা হাতে বেলকনিতে বসে মেঘের মধ্যে সূর্যোদয় উপভোগ করি। নাস্তা শেষ করে কিছুক্ষণ হেটে চারপাশ দেখে নিচ্ছি। অপরূপ দৃশ্য তাই একটুও মিস করতে চাইনি। এখানে চারপাশের স্নিগ্ধ পরিবেশে আমরা শুধুই মুগ্ধ হই। কথা বলতে বলতে চারপাশে দেখি মেঘ আমাদের ঘিরে ফেলেছে আর পূর্বদিকের মেঘের গালিচায় ঢেকে গেছে উঁচু পাহাড়। বহু দূরের পাহাড়ের সারিগুলো একেকটা দেওয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে তার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সোনালি সূর্যের রশ্নি। উড়ে যাওয়া সাদা তুলার মতো নরম মেঘের চাদর, চোখে তখন মুগ্ধতার চিহ্ন এঁকে দিয়ে যাচ্ছে বার বার। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে কবির ভাষায় আবারও বলতে ইচ্ছে হয়, ‘কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।’
এসইউ/এমএস