টাঙ্গাইলের প্রাচীন ঈদগাহ মাঠটি দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। মাঠ দখল করে বসানো হয়েছে অবৈধভাবে ট্রাকস্ট্যান্ড। পাশাপাশি বসেছে ফাস্টফুড, চা-স্টল, পুরি-শিঙারা ও শরবতের দোকান এবং বাঁশের বাজার। ফলে ওই ঈদগাহ মাঠ এখন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
Advertisement
জানা যায়, ১৯০৫ সালে ছয় একর জায়গার ওপর স্থাপিত টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠের জায়গাটি এক নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। সরকারের পক্ষে মাঠের মালিক জেলা প্রশাসক। কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে টাঙ্গাইল পৌরসভা। প্রতিবছর এ মাঠে মুসলমানদের দুটি বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাসহ ধর্মীয় নানা কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এখানে বিভিন্ন ধরনের ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, ১১৮ বছরের পুরোনো কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠের ছয় একর জায়গার মূল ফটকের কাছে উত্তর দিকে বাউন্ডারি দেওয়াল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে আটটি চায়ের দোকান, একটি যৌনশক্তি বর্ধক শরবতের দোকান, দুটি ফাস্টফুড, দুটি পুরি-শিঙাড়ার দোকান।
কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠের মাঝখানে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড বসিয়ে সারি সারি কয়েকশ মিনি ট্রাক রাখা হয়েছে। ট্রাক স্ট্যান্ডের চাঁদা আদায়ের জন্য অস্থায়ী ছাউনি তৈরি করা হয়েছে। অস্থায়ী ছাউনিতে বসে দুজন লোক রশিদের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করছেন। এর পশ্চিম দিকে বসানো হয়েছে ট্রান্সপোর্ট ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান স্ট্যান্ড। যেখানে শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করতো।
Advertisement
কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ৮-১০টি ফিটনেস ক্লাবের সদস্যদের শরীর চর্চা ও খেলাধুলার জায়গাও অবশিষ্ট নেই। মাঠের পূর্ব পাশে পার্কের বাজারের দেওয়াল ঘেঁষে পৌরসভার বিভিন্ন অংশ থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য রাখা হয়েছে। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে ময়লা-আবর্জনা থেকে বের হচ্ছে দুর্গন্ধ। কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠের দক্ষিণ পাশের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে টাঙ্গাইলের একমাত্র বাঁশের বাজার। পুরো দক্ষিণ অংশ জুড়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের বাঁশ। এছাড়া দক্ষিণ অংশের সীমানা প্রাচীরের পাশে অবস্থিত শহরের অন্যতম পয়ঃনিষ্কাশন ড্রেনটি ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে। ফলে পৌর এলাকার পশ্চিম অংশে পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা এক প্রকার বন্ধ।
ঈদগাহ মাঠে মালবাহী ট্রাক চলাচলের কারণে মাটি-কাদায় একাকার হয়ে গেছে। ফলে মাঠটি ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ঈদগাহ মাঠের বৃষ্টির পানি বের হওয়ার একমাত্র ড্রেনটি পৌরসভার ফেলা বর্জ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। পুরো ঈদগাঁ মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্লাস্টিকের কাপ, চা তৈরির ব্যবহৃত পাতি, দুটি ফাস্টফুডের দোকানের ব্যবহৃত ওয়ানটাইম প্লেট, গ্লাস, পলিথিন ও ব্যবহার করা টিস্যু পেপারসহ নানা বর্জ্য। এছাড়া ঈদগাঁ মাঠের পূর্বাংশ জুড়ে প্রতিদিন সকালে সবজির বাজার বসে। সবজির পরিত্যক্ত অংশ মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
ঈদগাহ মাঠে ক্রিকেট অনুশীলন করতে আসা শিক্ষার্থী সোয়েব, ছায়েম, মেহেদী, তমাল, আবীর, শাহীন জানায়- প্রতি শুক্রবার তারা এখানে খেলাধুলা করতে আসে। কিন্তু এ শুক্রবার এসে তারা দেখতে পায় তাদের খেলার জায়গায় বিভিন্ন ধরনের ট্রাক রাখা হয়েছে। সপ্তাহে মাত্র একদিন তারা খেলার সুযোগ পেলেও অবৈধভাবে ট্রাকস্ট্যান্ড গড়ে তোলায় খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা।
স্থানীয় মো. রাসেল খান, মো. আনিছুর রহমান, আব্দুল লতিফ, শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া, মশিউর রহমান, হাদি উজ্জামান সোহেল, ছাদেক ইসলাম, জামিল সিদ্দিকী, আব্দুল মজিদ সুমন, আনোয়ার হোসেন, হিমেলসহ অনেকেই ক্ষোভের সঙ্গে জানায়, মুসলমানদের জন্য ঈদগাহ একটি পবিত্র স্থান। কয়েক বছর ধরে এখানে স্থাপন হয়েছে- চায়ের দোকান, শরবতের দোকান, ফাস্টফুড, সিঙ্গারা-পুরির দোকান। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে মাঠে ট্রাকস্ট্যান্ড বসানো হয়েছে। প্রতিদিন ট্রান্সপোর্টের মালামাল নামানোর স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারী ট্রাক চলাচলের কারণে এরইমধ্যে ঈদগাহ মাঠ অসমতল ও কর্দমাক্ত হয়ে গেছে।
Advertisement
তারা আরও জানান, মাঠটি সংস্কারে উদ্যোগের কথা বারবার বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অবিলম্বে কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠ থেকে ট্রাকস্ট্যান্ডসহ সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের দাবি তাদের।
কেন্দ্রীয় ঈদগাহ কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা এভারগ্রিন ফিটনেস ক্লাবের সমন্বয়ক সৈয়দ নাজমুল হোসেন বলেন, সকালে ৮-১০টি ফিটনেস ক্লাবের শতাধিক সদস্য মাঠে খেলাধুলা ও শরীরচর্চা করে থাকেন। এতগুলো ফিটনেস ক্লাবের সদস্যদের জন্য ঈদগাঁ মাঠ এমনিতেই অপ্রতুল। এরমধ্যে মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো গড়ে উঠেছে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড। ফলে ভোরে খেলতে আসা বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষসহ স্বাস্থ্য সচেতন লোকদের জন্য এটা সমস্যার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবিলম্বে ট্রাকস্ট্যান্ডটি উচ্ছেদ করে ঈদগাহ মাঠের পবিত্রতা রক্ষার দাবি জানাচ্ছি।
ঈদগাঁ মাঠে গড়ে ওঠা মিনি ট্রাকস্ট্যান্ডের নেতৃত্বদানকারী শ্রমিক নেতা মো. হোসেন আলী ও রুবেল মিয়া বলেন, শহরের স্টেডিয়াম পুকুরের সামনে থেকে ট্রাকস্ট্যান্ডটি উচ্ছেদ করার পর আমরা পৌর মেয়রের সঙ্গে কথা বলে অস্থায়ীভাবে ঈদগাহ মাঠে স্থানান্তর করেছি।
টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র এসএম সিরাজুল হক আলমগীর জাগো নিউজকে বলেন, বিভাগীয় কমিশনার গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে জেলা ক্রীড়া সংস্থার পুকুরের সামনে থেকে ট্রাকস্ট্যান্ডটি সরিয়ে ঈদগাহ মাঠে অস্থায়ী ভিত্তিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে কোনো অবস্থাতেই ঈদগাহ মাঠে ট্রাকস্ট্যান্ডসহ কোনো ধরনের দোকান করার সুযোগ নেই। ডিসেম্বরের মধ্যে টাঙ্গাইল পৌরসভা টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ সংস্কারের কাজ শুরু করবে।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে ট্রাকস্ট্যান্ড স্থাপন করার কোন ধরনের অনুমতি দেওয়া হয়নি। যদি কেউ বিনা অনুমতিতে ট্রাকস্ট্যান্ড বসিয়ে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. ছানোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি জানা নেই। ঈদগাহ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব টাঙ্গাইল পৌরসভার। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে তিনি দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
এসজে/জেআইএম