মতামত

উন্নয়ন আর আন্দোলনের লড়াই

একশো মিটার দৌড় নিশ্চয়ই দেখেছেন আপনারা। ৯০ মিটারে পৌঁছে প্রতিযোগিরা মরিয়া হয়ে যান বিজয়ের জন্য। যারা একটু পিছিয়ে থাকেন তারা সর্বশক্তি দিয়ে ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন দৌড়ের শেষ প্রান্তে আছে। সবাই সর্বশক্তি দিয়ে সবার আগে বিজয় স্পর্শ করতে চায়। আগামী বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী নভেম্বরে ঘোষিত হবে তফশিল। সে হিসেবে সরকারের স্বাভাবিক মেয়াদের শেষ মাস অক্টোবর। সরকার তড়িঘরি করে তার ভান্ডার থেকে বের করছে একে একে উন্নয়নের চমক। আর বিরোধী দলও মরিয়া তাদের সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায়ে।

Advertisement

ভোটাধিকার, মানবাধিকার, দুর্নীতি, অর্থপাচারসহ অনেক সমালোচনা আছে। কিন্তু এটা মানতেই হবে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার দেশে অভাবনীয় সব উন্নয়ন করেছে। বারবার ইতিহাস লেখা হচ্ছে নতুন করে। প্রথম মেয়াদেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতিকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের করে এনেছে সরকার। আর দেশজুড়ে বয়ে গেছে উন্নয়নের জোয়ার।

বাংলাদেশে এখন দুর্গম বলে আর কোনো এলাকা নেই। সড়ক, রেল, সেতুতে সংযুক্ত গোটা বাংলাদেশ। নিজেদের অর্থে বানানো পদ্মা সেতু তো এখন আমাদের গৌরবের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে স্যাটেলাইট যুগে, সাবমেরিন যুগে, মেট্রোরেল যুগে, এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ে যুগে, পারমাণবিক শক্তির যুগে, প্রবেশ করতে যাচ্ছে টানেল যুগে। এা ধারাবাহিকতায় অক্টোবরকে বলা যায় উন্নয়নের মাস।

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান শেষে গত ৪ অক্টোবর দেশে ফেরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিনই তিনি যোগ দেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে। যে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও। তার দুদিন পরেই শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আধুনিক তৃতীয় টার্মিনাল। প্রধানমন্ত্রীর আশা বাংলাদেশ হবে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের হাব।

Advertisement

আগামীকাল পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলবে রেল। ২৩ অক্টোবর মেট্রোরেল চলবে মতিঝিল পর্যন্ত। এতদিন উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চললেও মতিঝিল পর্যন্ত এটি সম্প্রসারিত হলে এর সুফল পাবে আরো অনেক বেশি মানুষ। আগামী ২৮ অক্টোবর থেকে কর্ণফুলি নদীর নিচ দিয়ে চলবে গাড়ি। ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন এ মাসেই চলার কথা থাকলেও বন্যার কারণে তা হয়তো কিছুটা পিছিয়ে যাবে। তবে খুব বেশি যে পেছাবে না, তা বলাই যায়। ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আংশিক চালু হয়েছে। পুরোটা চালু হলে যানজট নিরসনে তা দারুণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন অন্য মাত্রায় উন্নীত হয়েছে।

তবে রাজনীতির মাঠে যেন উন্নয়নের কোনো ভূমিকাই নেই। রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি সরসকার পতনের এক দফা আন্দোলন করছে জুলাই মাস থেকে। সমাবেশ, কনভেনশন, রোডমার্চের মত কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি দেশজুড়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। তারা এখন আন্দোলনে মরণকামড় দিতে চায়। এখন তারা ঢাকা অচলের পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। ঘোষিত সর্বশেষ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সমাবেশ, মিছিল, ছাত্র কনভেনশন, যুব সমাবেশ, অনশন।

আগামী ১৮ অক্টোবর ঢাকায় জনসমাবেশ দিয়ে শেষ হবে এবারের কর্মসূচি। বিএনপির সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ১৮ অক্টোবরের জনসমাবেশ থেকেই আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে। শারদীয় দুর্গোৎসবের কারণে একটু বিরতি দিয়ে অক্টোবরের শেষ দিকে আসতে পারে নতুন কর্মসূচি। তাতে থাকতে পারে সরকার পতনের আলটিমেটামও। আর দাবি আদায়ে অবরোধ, ঘেরাও, অসহযোগ, অবস্থানের মত কর্মসূচিও আসতে পারে। তবে এর আগেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে আলটিমেটাম দিলেও কিছুই আদায় করতে পারেনি বিএনপি। বিএনপির আকাঙ্খা তফশিল ঘোষণার আগেই নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আদায় করা। কিন্তু না পারলে, মানে আন্দোলন সফল না হলে কী হবে, সে ব্যাপারে বিএনপি এখনও পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। আন্দোলনের অংশ হিসেবে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে অংশ নেয়ার চমক দেখাবে নাকি নির্বাচন বর্জন করে আবারও আওয়ামী লীগকে একতরফা নির্বাচনে পার পাওয়ার পথ করে দেবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক মহলের চাপে বাংলাদেশে যদি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়; মানুষ যদি নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তাহলেই বোঝা যাবে সরকারের উন্নয়নে মানুষের মন ভরেছে নাকি বিএনপির আন্দোলনে জনগণের আস্থা?

Advertisement

দীর্ঘদিন বিএনপি আন্দোলন করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে। কিন্তু এবার আন্দোলনে নেমেছে সরকার পতনের এতদফা নিয়ে। দফায় চমক থাকলেও আন্দোলনে কোনো চমক নেই। সেই গতানুগতিক ধারায় ঢিমেতালে চলছে আন্দোলন। বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার মত তীব্র গণআন্দোলন তারা এখনও গড়ে তুলতে পারেনি। তারা তাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের হাতে সময় বেশি নেই। তারা কিসের আশায় বসে আছে জানি না।

মাঠে কঠোর আন্দোলন গড়তে না পারলেও কণ্ঠে তাদের বিজয়ের সুর। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘রোডমার্চ ও সমাবেশ অনেক করেছি। আর কোনো রোডমার্চ নেই। এখন থেকে সব ঢাকায় হবে। রাজধানীতেই সরকারের পতন ঘটাতে হবে। দুর্গাপূজার আগে আমরা কোনো কঠোর কর্মসূচিতে না গেলেও এর মধ্যে সরকার পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে না দিলে জনগণই সেই ক্ষমতা দখল করবে।’ মির্জা ফখরুলের কথা নেতাকর্মীদের চাঙা করার জন্য ঠিক আছে। কিন্তু তফশিল ঘোষণার একমাস আগে ‘জনগণই ক্ষমতা দখল করবে’ ধরনের বালখিল্যতা দিয়ে কি আন্দোলন চাঙা করা যাবে?

মানতেই হবে সরকার দারুণ চাপে আছে। তবে সেই চাপ বিএনপি দিতে পারেনি। আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানামুখী পদক্ষেপই সরকারকে চাপে ফেলেছে। বিএনপি সেই চাপে ভর করে ক্ষমতায় যেতে চাইছে। এটা ঠিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নজরদারি এবং ভিসা নীতির কারণে বিএনপি অনেক নিশ্চিন্তে আন্দোলন করতে পারছে। আগে হলে এতদিনে পুলিশ পিটিয়ে বিএনপিকে মাঠ ছাড়া করতো। ভিসা নীতি যেমন বিএনপিকে সুবিধা এনে দিয়েছে, তেমনি অসুবিধাও হয়েছে তাদের।

বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস বলে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন দিয়ে সরকার পতনের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। আবার বিএনপি সহিংস আন্দোলনে গেলে মার্কিন ভিসা নীতির প্রয়োগ হতে পারে তাদের ওপরও। কারণ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতেই ভিসা নীতি দিরয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এবং সেটা বিরোধী দলের জন্যও প্রযোজ্য। তারচেয়ে বড় কথা হলো, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমলেও তৃণমূল পর্যন্ত তাদের সংগঠন আছে। বিএনপি মাঠে আন্দোলন করতে চাইলে আওয়ামী লীগ প্রতিরোধ গড়তে মাঠে থাকবে। অনেকদিন ধরেই আওয়ামী লীগ বিএনপিকে অনুসরণ করে কর্মসূচি ঘোষণা করছে। সরকার রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং উন্নয়ন সব দিক দিয়েই বিএনপিকে চাপে ফেলতে মরিয়া।

মার্কিন পদক্ষেপে যেহেতু আওয়ামী লীগ বিপাকে পড়েছে। তাই অনেকে মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝি আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বারবার বলছে, তাদের অবস্থান কোনো দলের পক্ষে নয়। বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করাই তাদের লক্ষ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেনি। সংবিধানের অধীনে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি নেই। তারা শুধু অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে চায়। এমনকি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথাও যুক্তরাষ্ট্র বলেনি। তাই যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে বিএনপির দাবি আদায় হবে না। তাদের হয় তীব্র গণআন্দোলনে সরকার পতনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। নইলে সর্বশক্তি নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক মহলের চাপে বাংলাদেশে যদি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়; মানুষ যদি নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তাহলেই বোঝা যাবে সরকারের উন্নয়নে মানুষের মন ভরেছে নাকি বিএনপির আন্দোলনে জনগণের আস্থা?

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম