অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে) বিরুদ্ধে ৫২টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রোববার (৮ অক্টোবর) ৫২ মামলার মধ্যে পি কে হালদারসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে করা প্রথম মামলার রায় ঘোষণা করবেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০ এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। রায়ে পি কে হালদারসহ ১৪ জনের ২২ বছরের কারাদণ্ডের প্রত্যাশা করছে দুদক।
Advertisement
প্রথম মামলার আসামিদের মধ্যে পি কে হালদারসহ ১০ জন পলাতক। কারাগারে থাকা চার আসামি অবন্তিকা বড়াল, শংখ বেপারী, সুকুমার মৃধা ও অনিন্দিতা মৃধা মামলায় লড়ছেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী বলছেন, ‘পি কে হালদার যদি অ্যারেস্ট থাকতেন অথবা তিনি যদি মামলায় কনটেস্ট করার (মামলা লড়া) সুযোগ পেতেন, তাহলে প্রকৃত অর্থে টাকাগুলো কী হয়েছে, কে দোষী, কাকে ব্যবহার করা হয়েছে, কে ব্যবহৃত হয়েছেন- এসব বিষয় উঠে আসতো।’
পি কে হালদারের বিরুদ্ধে বাকি ৫১ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের অপেক্ষায় রয়েছে বলে দুদকের সাধারণ নিবন্ধন শাখা থেকে জানা গেছে। দুদক সূত্রে জানা যায়, পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।
আরও পড়ুন>> পি কে হালদারসহ ১৪ জনের ২২ বছর সাজা প্রত্যাশা দুদকের
Advertisement
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মীর আহম্মেদ সালাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পি কে হালদারসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে ১০৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ৯৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। আমরা যুক্তি উপস্থাপন করেছি। সব সাক্ষ্য-প্রমাণে তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইনের ২৭(১) ধারা ও মানিলন্ডারিং আইনে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা তাদের ২৭(১) ধারায় ১০ বছর ও মানিলন্ডারিং আইনে ১২ বছরের কারাদণ্ড প্রত্যাশা করছি।’
পি কে হালদারের মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান জাগো নিউজকে বলেন, ‘পি কে হালদারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৫২টি মামলা করা হয়েছে। একটিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বাকি ৫১ মামলা তদন্তনাধীন।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী শাহিনুর রহমান বলেন, ‘পি কে হালদারের মানি লন্ডারিং মামলায় মোট আসামি ছিলেন ১৪ জন। ১৪ জনের মধ্যে চারজন কনটেস্ট করছেন। বাকিরা পলাতক থাকায় কনটেস্ট করার সুযোগ পাননি। আমরা জানি পি কে হালদার ভারতের কলকাতায় আছেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে আনেননি এবং কনটেস্ট করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। চারজন আসামি কনটেস্ট করছেন। তাকে আনলে হয়তো কনটেস্ট হতো। আর আমরা যারা আছি তারা কেউ নিকটাত্মীয়, কেউ পি কে হালদারের অফিসিয়াল স্টাফ। আমাদের মামলার মধ্যে বলা হচ্ছে, আমরা পি কে হালদারকে মানি লন্ডারিংয়ে সহায়তা করেছি, আমাদের অ্যাকাউন্টে টাকা-পয়সা গেছে। আর আমরা বলেছি, আমাদের অ্যাকাউন্টে যে টাকা এসেছে তা মানি লন্ডারিংয়ের টাকা কি না তা আমরা জানি না। আমরা যেটা জানি তা হলো বিজনেস ট্রানজেকশনে আমাদের অ্যাকাউন্টগুলো ব্যবহার করা হয়েছে এবং আমরা যেহেতু পি কে হালদারের স্টাফ ছিলাম, আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অ্যাবিউজ (অপব্যবহার) হয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে এটি মানি লন্ডারিং মামলা, কিন্তু পি কে হালদার যে দেশের বাইরে টাকা নিয়েছেন, সেটার ফিগার কত- এ ধরনের তথ্য কিন্তু মামলার মধ্যে আসেনি। আর দেখা গেছে, পি কে হালদার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব লোন নিয়েছেন, সেগুলো দিয়ে আলটিমেটলি তার অন্যান্য ব্যক্তিগত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্পদ পারচেজ করা হয়েছে অথবা অন্যান্য খাতে ব্যয় করেছেন। নিজে কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। সেক্ষেত্রে গভর্নমেন্টের (সরকার) কোনো কাগজ আসেনি যে, তিনি বাংলাদেশের বাইরে টাকা নিয়ে গেছেন। সেটা যে প্রক্রিয়াতেই হোক না কেন।’
Advertisement
এই আইনজীবী বলেন, ‘পি কে হালদার যদি অ্যারেস্ট থাকতেন বা তিনি যদি কনটেস্ট করার সুযোগ পেতেন, তাহলে প্রকৃত অর্থে টাকাগুলো কী হয়েছে, কে দোষী, কাকে ব্যবহার করা হয়েছে, কে ব্যবহৃত হয়েছেন- এসব বিষয় মামলায় আসতো। যেটা মামলায় আসেনি। মামলায় ডকুমেন্টস এসেছে, বিভিন্ন ট্রানজেকশনাল ডুকুমেন্টস। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে টাকা গেছে। তবে আমার কখনো মনে হয়নি, এসব অ্যাকাউন্টে টাকাগুলো এসেছে, এসব অ্যাকাউন্ট দিয়েই কেবল মানি লন্ডারিং হয়েছে, এটা যথেষ্ট নয়, ল’ইয়ার হিসেবে আমার এটা মনে হয়েছে।’
আরও পড়ুন>> পি কে হালদারের বান্ধবী নাহিদা রুনাইয়ের জামিন হাইকোর্টে স্থগিত
এর আগে গত ৪ অক্টোবর রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০ এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম রায় ঘোষণার জন্য ৮ অক্টোবর দিন ধার্য করেন। ওইদিন সাক্ষ্যগ্রহণের সময় কারাগারে থাকা চার আসামি অবন্তিকা বড়াল, শংখ বেপারী, সুকুমার মৃধা ও অনিন্দিতা মৃধাকে আদালতে হাজির করা হয়। পি কে হালদারসহ এ মামলার পলাতক আসামিরা হলেন- লিলাবতী হালদার (পি কে হালদারের মা), পূর্ণিমা রানী হালদার, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, অমিতাভ অধিকারী, প্রিতিশ কুমার হালদার, রাজিব সোম, সুব্রত দাস, অনঙ্গ মোহন রায় ও স্বপন কুমার মিস্ত্রি। এ মামলায় ১০৬ সাক্ষীর মধ্যে ৯৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী। মামলার এজাহারে বলা হয়, পি কে হালদার বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা ও অবৈধ কার্যক্রমের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ নিজ দখলে রেখেছেন। এছাড়া ওই অর্থ আড়াল করতে বিদেশে পাচার করে মানি লন্ডারিং আইনেও অপরাধ করেন তিনি।
মামলাটি তদন্ত শেষে ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন দুদকের উপ-পরিচালক সালাহউদ্দিন। ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে ৯৩৩ কোটি টাকার জমি, ফ্ল্যাট ও হোটেল ক্রয় করেন পি কে হালদার। এর মধ্যে জমি কিনেছেন ৬ হাজার ৭৯০ শতাংশ। এই সম্পদের বাজারমূল্য প্রায় ৩৯১ কোটি ৭৫ লাখ ৮১ হাজার ১২ টাকা। নিজের নামে তিনি জমি কিনেছেন ৪ হাজার ১৭৪ শতাংশ। দলিলে এসব জমির দাম ৬৭ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ৯৩০ টাকা দেখানো হলেও প্রকৃত বাজারমূল্য প্রায় ২২৮ কোটি টাকা। এছাড়া ধানমন্ডিতে তার নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
আরও পড়ুন>> ৩৮ কোটিতে বিক্রি হয়ে গেলো পি কে হালদারের কুমিরের খামার
চার্জশিটে আরও বলা হয়, পি কে হালদার তার নিকটাত্মীয় পূর্ণিমা রানী হালদারের নামে উত্তরায় একটি ভবন নির্মাণ করেন, যার দাম প্রায় ১২ কোটি টাকা। পূর্ণিমার ভাই উত্তম কুমার মিস্ত্রির নামে তেজগাঁও, তেজতুরী বাজার ও গ্রিন রোডে ১০৯ শতাংশ জমি কেনেন, যার বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকা। পি কে হালদার কাগুজে কোম্পানি ক্লিউইস্টোন ফুডসের নামে কক্সবাজারে দুই একর জমির ওপর র্যাডিসন নামে আটতলা হোটেল নির্মাণ করেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৪০ কোটি টাকা তার খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী ও অনঙ্গ মোহন রায়ের নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৪০৪ শতাংশ জমি কেনেন, যার দাম প্রায় ১৬৭ কোটি টাকা।
কলকাতার অনতিদূরে অশোকনগরসহ পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় অভিযান চালিয়ে ২০২২ সালের ১৪ মে পি কে হালদারকে গ্রেফতার করে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। একই সঙ্গে তার ভাই প্রাণেশ হালদার, স্বপন মিস্ত্রি ওরফে স্বপন মৈত্র, উত্তম মিস্ত্রি ওরফে উত্তম মৈত্র, ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদার এবং আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদারসহ বাকি অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়।
গত ১১ জুলাই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কলকাতার আদালতে চার্জশিট জমা দেয় ইডি। অর্থপাচার আইন-২০০২ এবং দুর্নীতি দমন আইন- ১৯৮৮’র বিভিন্ন ধারায় অভিযুক্তদেরর নামে চার্জ গঠন করা হয়।
বর্তমানে পি কে হালদারসহ পাঁচ পুরুষ আসামি রয়েছেন প্রেসিডেন্সি কারাগারে। আর একমাত্র নারী আসামি আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদার রয়েছেন আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে।
জেএ/ইএ/জেআইএম