বিশ্বমানের সব সুযোগ-সুবিধা ও যাত্রীসেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উদ্বোধন করা হয়েছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। শনিবার (৭ অক্টোরব) সকালে এ টার্মিনালের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
Advertisement
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক মেগাপ্রকল্পের একটি। এখানে যাত্রীদের জন্য ই-গেট, হাতের স্পর্শ ছাড়া চেকিং, নিজেই নিজের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করাসহ অত্যাধুনিক সুবিধা রাখা হয়েছে। এছাড়া সুপরিসর অ্যাপ্রোন, বিশাল গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত লাগেজ বেল্ট যাত্রীদের দেবে নতুন অভিজ্ঞতা।
তবে এ সেবা পাওয়া যাবে ২০২৪ সালের শেষদিকে। এখন তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করা হলেও যন্ত্রপাতি স্থাপনসহ আনুষঙ্গিক অনেক কাজ বাকি, যা শেষ করতে আরও এক বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
২০১৭ সালে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি হাতে নেয় সরকার। তবে নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানি সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। বাকি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের আদলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ করেছে জাপানের মিতসুবিশি ও ফুজিতা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং।
Advertisement
তৃতীয় টার্মিনালের যত সুবিধাএখন শাহজালাল বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১ ও টার্মিনাল-২ এর অ্যাপ্রোনে ২৯টি উড়োজাহাজ রাখা যায়। ৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটার আয়তনের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এর অ্যাপ্রোনে আরও ৮-১০টি উড়োজাহাজ রাখা যাবে। একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করে রাখা যাবে। ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজের ব্যবস্থা থাকবে। এর মধ্যে অক্টোবরে চালু হবে ১২টি। বহির্গমনের জন্য মোট চেক-ইন কাউন্টার থাকবে (১৫টি সেলফ সার্ভিস চেক-ইন কাউন্টারসহ) ১১৫টি।
এছাড়া ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ কাউন্টারসহ বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকবে ৬৬টি। আগমনীর ক্ষেত্রে পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় চেক-ইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি কাউন্টার থাকবে। বর্তমান টার্মিনালে রয়েছে আটটি লাগেজ বেল্ট। তৃতীয় টার্মিনালে আগমনী যাত্রীদের জন্য ১৬টি লাগেজ বেল্ট থাকবে। অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগেজের জন্য থাকবে চারটি আলাদা বেল্ট। এক হাজার ৪৪টি গাড়ি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন বহুতল কার পার্কিং তৈরির কাজ চলমান।
বেবিচক জানায়, তৃতীয় টার্মিনাল ভবনের আয়তন দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। বছরে এক কোটি ২০ লাখ যাত্রী এই টার্মিনাল ব্যবহার করতে পারবে। টানেলসহ বহুতলবিশিষ্ট কার পার্কিং ৫৪ হাজার বর্গমিটার। ফায়ার ফাইটিং স্টেশন ইক্যুইপমেন্টসহ চার হাজার বর্গমিটার। আমদানি কার্গো টার্মিনাল ২৭ হাজার বর্গমিটার, রপ্তানি কার্গো টার্মিনাল ৩৬ হাজার বর্গমিটার এবং কানেকটিং ট্যাক্সিওয়ে ৬৬ হাজার ৫০০ বর্গমিটার। দুটি র্যাপিড এক্সিট ট্যাক্সিওয়ে ৪১ হাজার ৫০০ বর্গমিটার।
এছাড়া তৃতীয় টার্মিনালের নিচতলায় থাকবে ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম। দ্বিতীয় তলায় ক্যানটিন ও বোর্ডিং ব্রিজ। থাকবে সুপরিসর ডিউটি ফ্রি শপ এবং বহির্গমন লাউঞ্জ। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য কাস্টমসের একটি হল ও ছয়টি চ্যানেল থাকবে। ভিআইপি যাত্রীদের জন্য রাখা হচ্ছে বিশেষ ব্যবস্থা। তৃতীয় টার্মিনালের দক্ষিণ প্রান্তে তিন হাজার ৬৫০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে ভিভিআইপি ও ভিআইপি যাত্রীদের জন্য আলাদা বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। ট্রানজিট যাত্রীদের জন্য বিশাল লাউঞ্জ করা হচ্ছে নতুন টার্মিনালে।
Advertisement
৪০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের প্রধান বহির্গমন লাউঞ্জ ব্যবহার করবেন ট্রানজিট যাত্রীরা। তবে পুরোনো দুটি টার্মিনালের সঙ্গে নতুন টার্মিনালের সংযোগ থাকবে না এখন। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে করিডোর নির্মাণ হবে। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তৃতীয় টার্মিনালের সঙ্গে বহুতল কার পার্কিং ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে এক হাজার ৩৫০টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে।
নিজের ইমিগ্রেশন নিজেই করতে পারবেন যাত্রীনতুন টার্মিনাল ভবনের বহির্গমন পথে ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল বা ই-গেট থাকবে। যেখানে যাত্রীরা নিজেরাই ইমিগ্রেশন করতে পারবেন। তাদের আর ইমিগ্রেশন পুলিশের মুখোমুখি হতে হবে না। তবে নিজেরা করতে না চাইলে তাকে সহযোগিতা করতে ৫৬টি বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টারও প্রস্তুত থাকবে। সেখানে ইমিগ্রেশন করবে ইমিগ্রেশন পুলিশ। এছাড়া যেসব যাত্রী অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে ঢুকবেন তাদের জন্য পাঁচটি ই-গেট থাকবে। পাশাপাশি থাকবে ৫৪টি অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন কাউন্টার।
বেবিচকের দাবি, টার্মিনাল চালু হলে যাত্রীরা আসা-যাওয়ায় ভোগান্তির শিকার হবেন না। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, তৃতীয় টার্মিনাল ভবনের সঙ্গে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। কাওলায় মেট্রোরেল স্টেশনের সঙ্গে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এটি যাতায়াতকে সহজতর করবে। একজন যাত্রী টার্মিনাল থেকে বের হয়ে সহজে গাড়িতে চড়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা সুড়ঙ্গপথে হেঁটে মেট্রোরেল স্টেশনে যেতে পারবেন। থাকবে আন্তর্জাতিকমানের অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা।
শাহজালালে যাত্রীদের আর তল্লাশি করা হবে না। নিরাপত্তার জন্য অত্যাধুনিক স্ক্যানিং ব্যবস্থা থাকবে। উড়োজাহাজে ওঠা পর্যন্ত হাতের স্পর্শ ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তল্লাশি চলবে। তবে সহযোগিতার অংশ হিসেবে যাত্রীকে বডি স্ক্যানার মেশিনের ভেতর দু’হাত তুলে দাঁড়াতে হবে। ফলে সবার সময় বাঁচবে। যাত্রী ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সময় বাঁচবে।
ঘোরাফেরা ও কেনাকাটার জন্য তৈরি হচ্ছে ১৪টি স্পটে ডিউটি ফ্রি শপ। যাত্রীরা টার্মিনালের বাইরে ও ভেতরে ওয়াই-ফাই এবং মোবাইল চার্জিংয়ের সুবিধা পাবেন। নারী-পুরুষের জন্য আলাদা নামাজের ব্যবস্থাও থাকছে। যাত্রীদের নিতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য মিটার্স অ্যান্ড গ্রিটার্স প্লাজা থাকবে নতুন টার্মিনালে।
শিশুদের দুগ্ধপানের জন্য মায়েদের সুবিধায় এ লাউঞ্জের ভেতর ব্রেস্ট ফিডিং বুথ, ডায়াপার পরিবর্তনের জায়গা এবং একটি বড় পরিসরে ফ্যামিলি বাথরুম থাকবে। বাচ্চাদের স্লিপার-দোলনাসহ একটি চিলড্রেন প্লে এরিয়াও থাকবে। নতুন টার্মিনালে যাত্রীরা পাবেন ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা।
এমএমএ/এমএএইচ/এএসএম