# দুদফা চিঠি চালাচালির পরও ‘অনড়’ দুপক্ষ# চিঠিতে কঠোর প্রতিক্রিয়ায় তিক্ত হচ্ছে সম্পর্ক# সমাধানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চায় যৌথসভা# ব্যাখ্যা যাচাইয়ের পর সিদ্ধান্ত নেবে ইউজিসি
Advertisement
অন-ক্যাম্পাস স্নাতক কোর্স চালু করা নিয়ে স্পষ্টত ‘দ্বন্দ্বে’ জড়িয়ে পড়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। দুই দফা চিঠি চালাচালিতেও বিষয়টি নিয়ে সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি তারা। সর্বশেষ দফায় পাল্টাপাল্টি চিঠিতে দু’পক্ষই কঠোর ‘শব্দ’ ও ‘ভাষা’র প্রয়োগ করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন— ইউজিসি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিজ নিজ অবস্থানে ‘অনড়’।
ইউজিসি বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অন-ক্যাম্পাস কোর্স চালু এবং তা বন্ধের নির্দেশনা না মানা ‘এখতিয়ার অবমাননার শামিল’। বিশ্ববিদ্যালয়টির সব ক্ষমতা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও ইউজিসি আইনানুযায়ী প্রযোজ্য। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
জবাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের আদেশ ১৯৭৩-এর ৫নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী—অন-ক্যাম্পাস স্নাতক কোর্সে পাঠদান ও ভর্তি বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং বিধি-নিষেধ আরোপ করার কোনো এখতিয়ার ইউজিসির নেই।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২১ জুলাই প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি, বিবিএ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট এবং নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্স বিষয়ে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির আবেদন আহ্বান করা হয়। এর মাধ্যমে অন-ক্যাম্পাস স্নাতক কোর্স চালুর কার্যক্রম শুরু করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ২৭ জুলাই থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আবেদন নেওয়া হয়। ১২ সেপ্টেম্বর অন-ক্যাম্পাস স্নাতক কোর্সের ভর্তির ফল প্রকাশ করা হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর ভর্তিচ্ছুদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ভর্তিও।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর চারটি বিষয়ে অন-ক্যাম্পাস কোর্স বন্ধের নির্দেশনা দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেয় ইউজিসি। সেখানে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন না মেনে এবং ইউজিসির অনুমতি না নিয়েই এ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এছাড়া আইন বিভাগ চালু করতে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী বার কাউন্সিলের ছাড়পত্রও নেয়নি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, যা বিধি-বহির্ভূত।
ইউজিসি আইনের বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করে ওই চিঠিতে বলা হয়, এসব আইন অনুযায়ী— জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে (গাজীপুর) স্নাতক প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২’-এরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
পরদিন ২০ সেপ্টেম্বর ইউজিসির চিঠির জবাব দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তাতে বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনানুযায়ী— অন-ক্যাম্পাস স্নাতক কোর্স চালু করতে ইউজিসির অনুমতির প্রয়োজন নেই। এজন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনুমতি নেয়নি। এছাড়া আইন বিভাগে ভর্তি নিতে বার কাউন্সিল থেকেও ছাড়পত্র নেওয়ার কোনো সুস্পষ্ট বিধান আইনে নেই বলে উল্লেখ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
Advertisement
প্রথম দফা চিঠি চালাচালির পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে। প্রায় দুই সপ্তাহ পর গত ৩ অক্টোবর আবারও কোর্স বন্ধ রাখতে দ্বিতীয়বারের মতো চিঠি দেয় ইউজিসি। চিঠিতে বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সংবিধির অনুচ্ছেদ-৭ অনুযায়ী, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকপূর্ব শিক্ষাবিষয়ক স্কুলকে শুধু অধিভুক্ত কলেজগুলোর ব্যাপারে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। তাই গাজীপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে স্নাতক প্রোগ্রাম পরিচালনার বিষয়টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সংবিধির পরিপন্থি।’
দ্বিতীয় দফায় ইউজিসির দেওয়ার চিঠির জবাব দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের সই করা চিঠিতে বলা হয়, ‘আপনাদের (ইউজিসি) পত্রে উল্লেখিত কমিশনের এখতিয়ার অবমাননার বিষয়টি যথাযথ নয়। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আদেশ ১৯৭৩-এর ৫নম্বর অনুচ্ছেদে কমিশনের এখতিয়ার সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখতিয়ারগুলোর কোথাও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন-ক্যাম্পাসে স্নাতক প্রোগ্রামে পাঠদান ও ভর্তি বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা বিধি-নিষেধ আরোপ করার কোনো এখতিয়ার কমিশনকে দেওয়া হয়নি।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২-এর ৩নম্বর ধারা স্মরণ করিয়ে দিয়ে চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘ধারা ৩নম্বর অনুযায়ী—বলবৎ অন্য কোনো আইনে বিপরীত যা কিছুই থাকুক না কেন, এ আইনের বিধানাবলী কার্যকর হবে। সুতরাং এর আইনগত প্রাধান্য অবশ্যই বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আদেশ ১৯৭৩-এর ওপর অগ্রগণ্য হবে।’
‘সংবিধির ৭নম্বর অনুচ্ছেদে স্নাতকপূর্ব বিষয়ে বা প্রোগ্রামে অন-ক্যাম্পাস পাঠদান ও ভর্তি সংক্রান্ত কোনো বিধি-নিষেধ নেই। বরং একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটের সার্বিক তত্ত্বাবধানে শিক্ষা সংগঠন ও অন্যান্য কার্যাবলী সম্পাদনের কথা বলা হয়েছে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করে।’
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এখতিয়ার মূলত মূল্যায়ন, পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়ার, যা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আদেশ ১৯৭৩ দ্বারা সীমাবদ্ধ। যেহেতু কমিশন কর্তৃক চলমান ইস্যুতে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করার এখতিয়ার আইনত নেই, সেহেতু এখতিয়ার বহির্ভূত নির্দেশনা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।’
‘সর্বশেষ ব্যাখ্যার আলোকে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে বলে গণ্য হবে’ উল্লেখ করে ইউজিসির সঙ্গে ‘যৌথসভা করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন’ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার।
জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার মোল্ল্যা মাহফুজ আল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইনে চলছে, সেটাতে অন-ক্যাম্পাস কোর্স চালুর বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই। ইউজিসি আইনে যদি এ নিয়ে সমস্যা থাকেও তা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কারণ অন্য আইনে বিরোধপূর্ণ কোনো বিষয় থাকলে সেটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ওপরে নয় বলে বিবেচিত হবে।’
তিনি বলেন, ‘ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেখভাল করে। এখানে আমরা একটা ভালো উদ্যোগ নিলাম, সেটাকে অ্যাপ্রিসিয়েট করা তাদের উচিত ছিল। যদি কোনো বিচ্যুতি দেখা যেতো, তখন তারা বলতে পারতেন। আশা করি—ইউজিসির দায়িত্বে থাকা আমাদের বিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যৌথসভা হলে এটা নিয়ে সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে।’
যৌথসভা হবে কি না, তা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এখানো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানান ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান। শুক্রবার (৬ অক্টোবর) সকালে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাদের চিঠি এখনো আমরা পাইনি। চিঠি পেলে তা আগে দেখা হবে, কী ব্যাখ্যা তারা দিয়েছেন। এরপর পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে ইউজিসি।’
জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলেন, ‘আমরা চার বিষয়ে অন-ক্যাম্পাস কোর্স চালু করছি। সেটা চলমান রয়েছে। ইউজিসি যে আপত্তি জানিয়েছে, সেটা আমরা অফিসিয়ালি জবাব দিচ্ছি। বিশ্ববিদালয়গুলোর দেখভাল যেহেতু তারা করে থাকেন, তাদের কিছু নিয়ে আপত্তি বা জানতে চাওয়ার প্রক্রিয়া থাকতেই পারে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-বিধি মেনেই আমরা অন-ক্যাম্পাস কোর্স চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এএএইচ/এমএএইচ/জেআইএম