ফিচার

আমার জীবনমুখী শিক্ষার গুরু

তাঁর সঙ্গে হেঁটেছি সহস্র মাইল। জ্ঞান আহরণে হেঁটেছি অনেকটা পথ। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা এত গভীর ছিল না। ছিল অন্য আট-দশটা ছাত্রের মতো। গভীর হয়েছে স্কুলজীবন শেষ করার পর। আমি বগুড়ার সোনাতলার টিএম মেমোরিয়াল স্কুলে পড়তাম। স্কুলে যখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে, একদিন রজব স্যার ক্লাসে এসে বললেন, ‘বিজ্ঞানে তোমাদের এক নতুন টিচার এসেছেন। তিনি খুব ভালো পড়ান। ইয়াং-এনার্জেটিক। আবার খুব কড়া।’ শুনে ভয় লেগেছিল সেদিন। এমনি আমি ক্লাসের নরমাল স্টুডেন্ট। কোনো স্যারের ক্লাসে ঠিকমতো পড়া দিতে পারি না। তার ওপর নাকি আবার কড়া স্যার।

Advertisement

প্রথম দিন ক্লাসে যখন স্যার ঢুকলেন; তখন ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। সবাই ভয়ে জবুথবু। স্যার ক্লাসে ঢুকে একদম বসেছিলেন ক্লাস শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। আমরাও কোনো কথা না বলে বসে ছিলাম। ক্লাস শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে স্যার বলে উঠলেন, ‘চক আর ডাস্টার কোথায় ক্লাসে?’ পরে টেবিলে দেখা গেল সত্যি চক-ডাস্টার নেই। আমার বন্ধু মামুন কি ময়নুল যেন দৌড়ে আনতে যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে স্যার বলে উঠলেন, ‘ক্লাসে চক-ডাস্টার নেই। ক্লাস শেষ হওয়ার আগে আনতে যাচ্ছিস? তোদের তো পড়ালেখাতেই মন নেই। তোদের আর পড়াবো কী? আজ আর পড়াবো না।’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘণ্টা বেজে উঠলো। এরমধ্যে স্যার চলে গেলেন। আমরা সবাই হেসে উঠলাম।

প্রথমদিকে স্যার যখন কাউকে পড়ার জন্য দাঁড়াতে বলতেন, তাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘তোর নাম হাশেম না?’ বলতাম, ‘না স্যার’। তারপর বলতেন, ‘তোদের ক্লাসে হাশেম নামে কেউ নাই।’ আমরা বলতাম, ‘না স্যার।’ তবুও স্যার প্রায় দিনই কাউকে না কাউকে বলতেন, ‘তোর নাম হাশেম না?’ ব্যাপারটা আমরাও ইনজয় করতাম, অনেক হাসাহাসি করতাম।

আরও পড়ুন: শিক্ষক: মানুষ গড়ার কারিগর তারা

Advertisement

স্কুলের পাঠ চুকিয়ে কলেজে উঠলাম। তখন স্যারের সঙ্গে টুকটাক কথা হতো। স্যার মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে বলতেন, ‘শান্ত সাহেব ফ্রি আছো? চলো নাস্তা করে আসি।’ আমিও নাস্তা করতে বেরিয়ে পড়তাম। স্যার নাস্তা করার জন্য নিয়ে যেতেন ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে। চা খাওয়ার জন্য নিয়ে যেতেন ১০-১২ কিলোমিটার দূরে। স্যারের এই কর্মকাণ্ড আমাকে রোমাঞ্চিত করতো। আমিও স্যারের সঙ্গে সায় দিয়ে মিশতে শুরু করলাম বন্ধুর মতো। তারপর দিন দিন এমন হলো যে, আমাদের দু’একদিন পরপর ট্যুর দিতে না পারলে ভালো লাগতো না।

স্যার আমাদের স্কুল ছেড়ে দিয়েছেন বেশ কিছুদিন আগে। স্যার থাকেন গাইবান্ধা আর আমি থাকি বগুড়া। তবুও স্যারের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে যেতাম বা স্যারও আসতেন। স্যারের সঙ্গে ঘুরে আমি ক্লাসের চেয়ে বেশি শিখতে পেরেছি। বলতে পারেন জীবনমুখী শিক্ষা, প্রকৃতির শিক্ষা। সব সময় স্যার ভ্রমণের মধ্যদিয়ে সমাজ, দর্শন, ধর্মসহ নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন। নতুন কিছু শেখানোর চেষ্টা করতেন। মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হেসে বলতেন, ‘শান্ত সাহেব, তোমার আরও অনেক কিছু শেখা বাকি আছে।’

স্যার কিন্তু একজন চমৎকার পাঠক। আমার দৃষ্টিতে প্রথম শ্রেণির পাঠক। প্রচুর বই পড়েন। আমার লাইফে এরকম বই পড়তে কাউকে দেখিনি। সোনাতলার যে বাসায় তিনি ভাড়া থাকতেন, সেই বাসাকে মনে হতো কোনো এক লাইব্রেরি। বিছানার ওপর বই, টেবিলের ওপর বই, খাটের নিচে বই, রান্নাঘরে বই। বলতে গেলে তার বাসার আসবাবপত্র নেই শুধু বই আর বই। সেই বইগুলোও আবার দুর্লভ। কবি মির্জা গালিব, শেখ সাদী, কাহলিল জিবরান, শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ুন আজাদ, জাফর ইকবালসহ ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম, সংস্কৃতির বইয়ে ঠাসা। যেন কয়েক হাজার বইয়ের সংগ্রহ তার।

আরও পড়ুন: বিশ্ব শিক্ষক দিবস আজ

Advertisement

শুধু যে পড়াশোনা করা মানুষ তিনি তা কিন্তু নয়; মানবিক মানুষও বটে। স্কুলে থাকতে দেখেছি, অনেক ছাত্র যখন টাকার অভাবে পড়তে পারছিল না, স্যার তাদের দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অনেকের দায়িত্বও নিয়েছিলেন। ছাত্রদের সঙ্গে তিনি মিশতেন বন্ধুর মতো।

আমি যে লেখালেখি করি, সাংবাদিকতা করি; স্যার এটা পছন্দ করেন না। একদিন বসে চা খাওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘তুমি যে লেখালেখি করো তা আমার পছন্দ নয়। তবে তুমি যদি লেখালেখি ছেড়ে দাও, আর তাতে যদি শুধুমাত্র একটা ব্যক্তি কষ্ট পায় সেইটা হলো আমি।’ স্যারের এ কথা আজও বুঝিনি, বুঝতেও চাই না। কারণ স্যার ঘোর সৃষ্টি করতে পছন্দ করেন। তিনি হয়তো আমাকে ঘোরে রাখতে চেয়েছেন, তাই আমি ঘোরেই রইলাম। ও হ্যাঁ, স্যারের নামটাই এখনো বলা হয়নি। অবশ্য নাম না বললেও আমার স্কুলের সহপাঠীরা এ লেখা দেখেই চিনবে তাকে। তবুও বলছি, তার নাম আশরাফুল ইসলাম। তিনি ছিলেন আমার স্কুলশিক্ষক। আমার জীবনমুখী শিক্ষার গুরু। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমার এই শিক্ষককে জানাই অজস্র ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।

এসইউ/এমএস