তিন রুমের একটি বাসায় খুব চাপাচাপি করে বা কষ্ট করে ১০/১২ জন সদস্য বাস করতে পারবেন। তাও টয়লেট ব্যবহার, শোয়ার ব্যবস্থা, খাবারের আয়োজন করতে হিমশিম খেতে হবে। সেখানে যদি ২০/২৫ জন মানুষ নিয়মিত থাকতে শুরু করেন, তাহলে কী হতে পারে সেই গৃহের অবস্থা, তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। আমাদের ঢাকা শহরের অবস্থাও হয়েছে ঠিক তাই। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে শতভাগ মানুষের বাস এই শহরে। যেখানে ৪০ থেকে ৫০ লাখ মোটামুটি আরামে থাকতে পারার কথা সেখানে বাস করছি প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষ।
Advertisement
শুধু কি মানুষ? মানুষকে কেন্দ্র করে ভবন, দোকানপাট, শপিংমল, হোটেল, প্রাইভেট কার ও মটরসাইকেলের সংখ্যাও বেড়েছে দেদার। বাড়েনি রাস্তার সংখ্যা, শ্রমজীবি ও দরিদ্র মানুষের থাকার ব্যবস্থা, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, পাবলিক টয়লেট, পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা, গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা। নগর পরিকল্পনা রীতিমত ভেঙে পড়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর এখন ঢাকা। ১৫২টি দেশের ১ হাজার ২০০টির বেশি শহরে যান চলাচলের গতি বিশ্লেষণে এই চিত্র উঠে এসেছে। যান চলাচলে এই ধীরগতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
গবেষণা বলছে, ধনী দেশগুলোর শহরে গাড়িতে চলাচল দরিদ্র দেশগুলোর তুলনায় ৫০ শতাংশের মতো দ্রুত হয়। এটা সম্ভব হয় ধনী দেশের শহরগুলোতে বড় বড় রাস্তা এবং অনেক ফাঁকা জায়গা থাকার কারণে। এর ফলে রাস্তায় বেশি গাড়ি নেমেও যানজট ছাড়া চলাচল করতে পারে। রাস্তায় যানবাহনের চাপ কম থাকার পরেও, সবচেয়ে ধীরগতির ২০টি শহরের তালিকাও করা হয়েছে। সেখানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা।
Advertisement
গবেষণাটির ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টাইম ম্যাগাজিন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতি ও দ্রুতগতির দুই শহরে চলাচলে কেমন সময় লাগে, তার একটি উদাহরণ দেওয়া হয়। বলা হয়, ঢাকার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ৯ মাইল দূরের গুলশানের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পার্কে গাড়িতে যেতে সময় লাগে গড়ে ৫৫ মিনিট। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ফ্লিন্ট শহরে একই দূরত্ব যেতে সময় লাগে মাত্র ৯ মিনিট। দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকা আর চার লাখ মানুষের শহর ফ্লিন্টে যাতায়াতে সময়ের এই ব্যবধান শুধু গাড়ির চাপের কারণে নয়, এখানে অন্যান্য বিষয়ও রয়েছে।
একইভাবে বাংলাদেশের শহরে (একই আয়তনের) অন্যান্য দেশের শহরের তুলনায় জনসংখ্যা ৪০ শতাংশ বেশি এবং বড় রাস্তা ৪২ শতাংশ কম। এ কারণে বাংলাদেশের শহরগুলো ধীরগতির। দু’বছর আগেই বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক জরিপ প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেছিল ঢাকাবাসীকে সড়কে প্রতি ২ ঘণ্টায় ৪৬ মিনিট কাটাতে হয় যানজটে বসে। বছরে জনপ্রতি গড়ে ২৭৬ ঘণ্টা নষ্ট হয় যানজটে। অথচ মানুষের চলাচল একটি খুব জরুরি বিষয়। শহর গড়ে উঠেছে এই কারণে যে অল্প জায়গায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদনের সুবিধা থাকবে। মানুষ দ্রুত চলাচল করে সেই সুবিধা নিতে পারবে। কিন্তু ঢাকা ঠিক তার উল্টো অবস্থায় চলছে।
প্রশ্ন জাগতে পারে, গতি কেন যুক্তরাষ্ট্রে বেশি, বাংলাদেশে কম? আবার দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের শহরে গতি কম। অন্যান্য দরিদ্র দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গতি কম গড়ে ২০ শতাংশ। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন গবেষকেরা। তাঁরা দেখেছেন, অন্যান্য অনেক ধনী দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোর জনসংখ্যা ২৪ শতাংশ কম, শহরগুলো প্রায় ৭২ শতাংশ বড় এবং যুক্তরাষ্ট্রের শহরে বড় বড় রাস্তার সংখ্যা বেশি ৬৭ শতাংশ।
গবেষণাতে যানজট ও নগরীর অব্যবস্থা নিয়ে নানাধরনের প্রসঙ্গ উঠে এলেও, এটাও বলা হয়েছে নগরীর অস্বাভাবিক লোকসংখ্যা নগরী গোছানোর ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। ঢাকার ক্ষেত্রে যা শতভাগ প্রযোজ্য। ঢাকায় মানুষ একবার পড়াশোনা বা কাজ করতে এলে আর ফিরে যেতে চায় না। কারণ ঢাকাই হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র শহর যেখানে সব সুবিধা পুঞ্জীভূত করা হয়েছে। কাজের প্রয়োজনে, ভাল চিকিৎসা, পড়াশোনা, সরকারি অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্য সব কাজে মানুষ ঢাকামুখী। স্থায়ী বাসিন্দা, অস্থায়ী জনসংখ্যা সবকিছু মিলে ঢাকার “শিরে সংক্রান্তি” অবস্থা। এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা নগরীতে নানা কৃত্রিম সমস্যার সৃষ্টি করছে, যার মধ্যে অন্যতম যানজট। ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। শহরের পরিবহনব্যবস্থাও একেবারে ভেঙে পড়েছে।
Advertisement
বিভিন্ন নগরীর যানবাহনের গতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে গবেষকেরা বলছেন, তিনটি কারণে তাদের এই অনুসন্ধান গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সারা বিশ্বে নগর যাতায়াত নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এই গবেষণার ফলাফল নীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। দ্বিতীয়ত, শহরে বহু মানুষ কর্মক্ষেত্র, স্কুল ও বিনোদনকেন্দ্রের হাঁটার দূরত্বে বসবাস করে না। তারা দ্রুতগতির এবং বিশ্বস্ত যাতায়াত ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে চায়। তৃতীয়ত, পরিবার ও সরকার প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করে নগরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে। কিন্তু একটি শহর ভ্রমণ বা চলাফেরার জন্য কতটা সুন্দর, তা কমই জানা থাকে। তারা বলেছেন পরিকল্পনাবিদেরা খুব কমই জানেন যে একই ধরনের অন্যান্য দেশের শহরের তুলনায় তাদের শহরটি কতটা পিছিয়ে বা কেন পিছিয়ে আছে। এই কথাটাই ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে শতভাগ ঠিক।
আমাদের নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেন, সমস্যা চিহ্নিত না করে শুধু সড়ক সম্প্রসারণ, উড়ালসড়ক ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করলে যানজট দূর হবে না। নগরের যানজট নিরসন করার জন্য যা যা প্রয়োজন, তা না করে ইচ্ছামতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আবার প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও এর জন্য যে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা দরকার ছিল, তাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা বদলে স্বল্প মেয়াদে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে।
যানজট নিরসন করে শহরকে গতিময় করতে ২০১২ সালের পর থেকে গত এক দশকে সড়ক, সেতু, মেট্রোরেল, উড়ালসড়কসহ নানা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় এক লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এই সময়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ এবং মেট্রোরেলের একটি রুটের একাংশ ছাড়াও শহরের মধ্যে ছোট বড়ো অন্তত সাতটি নতুন ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছে সরকার। বুয়েটের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোঃ হাদীউজ্জামান বলছেন, “এখানে একই সড়কে আঠার ধরনের যানবাহন চলছে। গতি আসবে কীভাবে। মূল সড়কগুলোর পাশে নিয়ম নীতি না মেনে বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করা হয়েছে। জংশন বা স্টেশনগুলোতে ইন্টারচেঞ্জ বানানোর সুযোগই রাখা হয়নি।” (বিবিসি বাংলা)
২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে চার দশমিক আট কিলোমিটারে। এরপর ২০২৫ সাল নাগাদ এটি চার কিলোমিটারের নিচে চলে আসতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ সব ধরনের যানবাহনের সংখ্যাই বেড়েছে কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় গণপরিবহনের সঠিক বিন্যাস করা হয়নি।
এই ”তিলোত্তমা ঢাকা” শহরে আমরা যারা বাস করি, তারা সকাল থেকে রাত অব্দি বিভিন্ন কারণে নাকাল হচ্ছি। যানজট ছাড়াও আছে শব্দদূষণ, গাড়ির হর্ন, সাইলেন্সার পাইপবিহীন মটর সাইকেলের শব্দ, ভিআইপি গাড়ির উচ্চ সাইরেন, মানুষের চিৎকার, চেঁচামেচি, ঝগড়া, আতশবাজির শব্দ, মাইকের আওয়াজ।
ঢাকা শহরে মানুষ বাড়ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। এত মানুষ যখন ঢাকার মতো পরিকল্পনাহীন একটা শহরে এসে ভীড় করছে, তখন সেই শহর, মৃত শহর ছাড়া আর কী হবে। এছাড়া এলোপাথারি চলাচল, চালকদের দুর্বিনীত আচরণ, অপর্যাপ্ত ও নিন্মমানের গণপরিবহন, তীব্র হর্ন, রাস্তার অভাব, রাস্তা খোঁড়াখুড়ি ও পথচারিদের নিয়ম না মানার খেসারতো আমাদের সবাইকে দিতে হবে, দিচ্ছিও। ঢাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে বিষাক্ত সীসাসহ আরো নানাধরনের উপাদানে। এছাড়া ধুলাবালি, ভেজাল খাবার আমাদের শিশুদের সব শক্তি কেড়ে নিচ্ছে।
অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোঃ হাদিউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলছেন, "ঢাকা শহরের হৃৎস্পন্দন ভয়াবহভাবে কমে গেছে। গাড়ির ঘণ্টা প্রতি গতি, এটা একজন সুস্থ মানুষের হাঁটার গতির চাইতেও কম।” বাংলাদেশে শহরগুলোর তুলনায় একই আয়তনের অন্য দেশের শহরে জনসংখ্যা ৪০ ভাগ কিন্তু তাদের বড় সড়ক ৪২ শতাংশ বেশি। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। ঢাকায় লোকসংখ্যা বাড়তে দেয়াতো যাবেই না, বরং কমাতে হবে। শহরে ছোট গাড়ি, রিকশা ও মোটরসাইকেল কমাতে হবে। বাড়াতে হবে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট।
শুরু থেকে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেই আসছেন, একটা সুন্দর নগর গড়ে তোলার জন্য দরকার বাসস্থান, এর সাথে সাথে দরকার জনবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা, খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজ এবং স্বাস্থ্যসেবা। এগুলো শুধু থাকলেই হবেনা, মানুষ যেন সেই সুবিধাগুলো ভোগ করতে পারে, সেই ব্যবস্থাও রাখতে হবে। উন্নয়ন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যা প্রবৃদ্ধি, উন্নতি, জনগণের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও জনসংখ্যার উপাদান বিষয়ক ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করে। কিন্তু এই জনসমুদ্র ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন ভাবনা নিয়ে ঢাকাকে কি আদৌ রক্ষা করা সম্ভব? নতুন করে, নতুনভাবে ভাবার সময় এসেছে। নয়তো সত্যিই ঢাকা খুব দ্রুত একদিন মৃত নগরীতে পরিণত হবে।
৩ অক্টোবর, ২০২৩
লেখক: যোগাযোগকর্মী ও কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম