খেলাধুলা

সামর্থ্যের নয়, প্রশ্নটা ক্রিকেটারদের আত্মনিবেদনের

এবারের বিশ্বকাপে সবার শেষে স্কোয়াড ঘোষণা করেছে কোন দেশ? দল ঘোষণা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্বকাপে অংশ নেয়া দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে কোন দেশে?

Advertisement

উত্তরগুলো গোটা ক্রিকেট দুনিয়া জানে। এর সঙ্গে যদি যোগ করা যায়, কোন দেশের পারফরম্যান্স আফসোস বাড়ায়? কিংবা সামর্থ্য প্রমাণের পরীক্ষায় কোন দেশ বেশিরভাগ সময়ই উতরাতে পারে না? ঘুরেফিরে উত্তর একটাই।

সাধারণ মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসায় ক্রিকেটের দেশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ; কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা (ম্যানেজমেন্ট ও প্লেয়ার) নিজেদেরকে কতটুকু নিবেদন করছেন বা ক্রিকেটের জন্য নিজেদেরকে কতটা উজাড় করে দিচ্ছেন, বারবার সেই প্রশ্নটা সামনে এসে দাঁড়ায়।

বিশ্বকাপ মূলপর্বের ছাড়পত্র পাওয়ার অগ্নিপরীক্ষা অর্থাৎ আইসিসি সুপার লিগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়। আরো সহজ করে বললে, উপমহাদেশের দলগুলোর মধ্যে সবার উপরে থেকে বিশ্বকাপের মূলপর্ব নিশ্চিত করে টাইগাররা।

Advertisement

কিন্তু চূড়ান্ত বাস্তবতা হচ্ছে, সদ্য শেষ হওয়া এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। গত কয়েক বছর সাফল্যের ধারাবাহিকতার মধ্যে থাকা টাইগাররা এশিয়া কাপে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ রাখতে পারেননি, অনুসিদ্ধান্তটা এভাবে টানাই যায়।

বিশ্বকাপ মিশনের আগ মুহূর্তে বাংলাদেশ ক্রিকেটের উপর দিয়ে কার্যত সুনামি বয়ে গেছে। এবারের বিশ্বকাপ তো বটেই, এই ক্ষত কতদিন বয়ে বেড়াতে হয়, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন ক্রিকেটাররা। শর্ত দিচ্ছেন। শর্ত পূরণ না হলে অধিনায়কত্ব করবেন না, হুমকি দিচ্ছেন। আর ম্যানেজমেন্ট তো আরো এক কাঠি সরেস। ভেতরের খবর বাইরে প্রকাশ করার জন্য অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন মিডিয়াতে।

তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান ইস্যুকে কেন্দ্র করে পুরো দেশ এখন কার্যত দু’ভাগ। এই দুজনকে এক করাটা কি খুব কঠিন কিছু ছিল? সাকিব-তামিমকে এক জায়গায় বসিয়ে সমস্যা সমাধান করার মানুষ কি তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে নাই?

Advertisement

ব্যাটিংয়ে কাকে কত নম্বরে খেলানো হবে, দলের বৃহত্তর স্বার্থে কার ভূমিকা কেমন হবে, এগুলো হাইলি টেকনিক্যাল ব্যাপার। এগুলো গেম প্ল্যানের পার্ট। এমন স্পর্শকাতর বিষয়গুলো কেন ঢালাওভাবে মিডিয়াতে আসবে?

এই ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন মাশরাফি মর্তুজা। তার ভাষায়, তামিম নেতৃত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে ঠিক করেনি। আর তামিমের সঙ্গে মিনিট খানেক কথা বলেই সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারত সাকিব। আসলে, আলোচনার টেবিলে বসে, বিশ্বকাপ পরিকল্পনা করার ইচ্ছা, ধৈর্য কিংবা আত্মনিবেদন কারোর মধ্যেই নাই।

বছর দুয়েক আগে ভারতীয় ক্রিকেটের একটা ঘটনা স্মরণ করা যাক। দেশটির ব্যাটিংয়ের দুই প্রধানতম স্তম্ভ বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মার মধ্যকার চরম দ্বন্দ্বের অবসান ঘটান ওই সময়ের ভারতীয় কোচ রবি শাস্ত্রী। কোহলি ও রোহিতের সম্পর্কের এতটাই অবনতি হয়েছিল যে, পরস্পরের সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন তারা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অধিনায়ক কোহলিকে ‘আনফলো’ করেছিলেন রোহিত। এসব নিয়ে গুঞ্জন থাকলেও খবরটা অনেকদিন অবধি কেউ জানতেই পারেনি। মিডিয়ার সামনে মুখ না খুলে খুব সাবধানে পরিস্থিতি সামলায় ভারতীয় ক্রিকেট ম্যানেজমেন্ট।

মিডিয়াকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বিষয়টি নিয়ে গোপনে তদন্ত করে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। এরপর দু’জনের দ্বন্দ নিরসনে দায়িত্ব তুলে দেয়া হয় কোচ রবি শাস্ত্রীর কাঁধে। দু’জনকে মুখোমুখি বসিয়ে সমস্যার সমাধান করেনে শাস্ত্রী। রোহিত ও কোহলি আবার আগের মতোই দলকে জেতাতে লড়াই করছেন কাধেঁ কাঁধ মিলিয়ে। আর আমাদের দেশে এমন সঙ্কটে ভাগ হয়ে যায় পুরো দেশ!

বৈশ্বিক মানদন্ডে সাকিব সবার ওপরে; কিন্তু তামিম ইস্যুতে মানে বিশ্বকাপ থেকে তামিম বাদ পড়ায় নিজের স্বস্তি কিন্তু লুকিয়ে রাখতে পারেননি সাকিবও। তামিম বাচ্চাদের মত আচরণ করেছে, আমার ব্যাট দিয়ে আমি খেলব, কাউকে দেবো না। খুব ঠান্ডা মাথায় এভাবে দোষারূপ করেছেন সাকিব।

তামিম ছেলেমি করেছেন, একেক সময় একেক রকম আচরণ করেছেন। সবই ঠিক আছে; কিন্তু তামিম এসব করেছেন আবেগবশত। আর তামিম ইস্যুতে সাকিব যে কথাগুলো বলেছেন, তা ঠান্ডা মাথায়, হিসাব কষে কষে। এনিয়ে বিসিবির ভূমিকা না টানাই ভাল। পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে, আরো জটিল করেছে বিসিবি।

এবারে আসা যাক মাঠের খেলার দিকে। এশিয়া কাপে পাঁচ ম্যাচের মধ্যে তিনটিতেই পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করতে পারেনি টাইগাররা। সুপার ফোর পর্বে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যাটারই কে কার চেয়ে কত খারাপভাবে আউট হতে পারে, করেছে সেই প্রতিযোগিতা। আমাদের ব্যাটারদের একটা বিষয় কিন্তু লক্ষ্যণীয়।

২৫ থেকে ৩৫ কিংবা ৭০ থেকে ৮০’র ঘরে আউট হওয়ার প্রবণতা। সেট হওয়ার পর উইকেট বিলিয়ে আসা এবং পঞ্চাশ পেরুনোর পর ইনিংসকে টেনে তিন অঙ্কের ঘরে নিয়ে যাওয়া, এই দু জায়গাতেই ধৈর্যের ঘাটতি চোখে পড়ার মত। এখানেও সামর্থ্যের চেয়ে নিবেদনের ঘাটতিটাই প্রবল।

ম্যানেজমেন্ট নিজেদের জাহির করতে ব্যস্ত। ক্রিকেটারদের ব্যক্তিত্বের সংঘাত চরমে। কেউ কাউকে এক চুলও ছাড় দিতে নারাজ। আর মিডিয়া যতটা পারছে পরিস্থিতিকে উসকাচ্ছে, গরম হাওয়া দিচ্ছে।

সবাই ছুটছে কৃতিত্বের ভাগিধার হওয়ার রেসে। বাংলাদেশে ক্রিকেট যে খুবই জনপ্রিয়! ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা সর্বোপরি নিবেদনে সামান্যতম ঘাটতি নেই সাধারণ মানুষের। আর চরম অবজ্ঞা-উন্নাসিকতা দেখিয়ে সেটাই বোধকরি পুষিয়ে দিচ্ছে আমাদের ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা।

আইএইচএস/