আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। নির্বাচন কেন্দ্র করে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে চলছে বাগযুদ্ধ। নির্বাচনের আগে মার্কিন ভিসানীতি তৈরি করেছে নতুন এক সমীকরণ। জেগেছে নতুন শঙ্কা। এই শঙ্কা কাটাতে সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
Advertisement
তার মতে, সংঘাত বন্ধ করতে হলে একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সেই পরিবেশ সৃষ্টি শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সেজন্য যারা বিরোধীদল এবং ভিন্নমতের লোক তাদের প্রত্যেককেই আন্তরিকভাবে একটি ওয়াদা করতে হবে।
মার্কিন ভিসানীতিসহ বর্তমান রাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষ পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক ইসমাইল হোসাইন রাসেল।
আপনি ভালো করলে কিছু শত্রু আপনার হবেই। আমাদের দেশ ভালো করছে এটা নিয়ে সবাই তাজ্জব। ভালো করছি বলে কিছু শত্রু বাড়ছে। আপনি যদি পরিবারের ১০ জনের মধ্যে হঠাৎ বেশি ভালো করেন আপনার কিছু শত্রু হবেই।
Advertisement
জাগো নিউজ: প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, ‘অনেক দেশে নির্বাচন তো এখনো তাদের বিরোধীদল মানেইনি। সেখানে আমাদের দেশের নির্বাচন নিয়ে কীভাবে তারা মন্তব্য করছেন।’ এ বিষয়ে কী বলবেন?
ড. এ কে আব্দুল মোমেন: এগুলো নিয়ে আমার কথা বলা ঠিক নয়। কে কী মানলো না বা মানলো ইট ইজ ইরিলিভেন্ট (এটা অপ্রাসঙ্গিক)। ঠিকমতো চললে আমি ঠিক আছি। এগুলো এজন্য অবান্তর। আমরা ওয়াদা করেছি সুষ্ঠু নির্বাচন করবো এবং আমরা সেভাবে ইনস্টিটিউশন ডেভেলপ করে কাজ করেছি। আপনারাও জানেন শেখ হাসিনা এদেশে গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক। উনি গণতন্ত্রের জন্য যা করেছেন পৃথিবীতে আর কোনো রাষ্ট্রে এই মুহূর্তে তা নেই। মানুষের গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার, তাদের কথা বলার অধিকার, তাদের দু-মুঠো ভাতের অধিকারের জন্য তিনি সেক্রিফাইস করেছেন। উনি আর ওনার বাবা দুজনই করেছেন।
এ মুহূর্তে আপনি কোনো উদাহরণ দেখাতে পারবেন না পৃথিবীতে যে বাপ হারিয়েছেন, মা হারিয়েছেন, ভাই হারিয়েছেন, পরিবারের লোকজন সব হারিয়েছেন- এরকম আর কেউ আছে? তারপরে সেটাও না, বারবার আক্রমণ হয়েছে তার ওপর। মারার জন্য ১৯ না ২৩ বার আক্রমণ হয়েছে, ওপরওয়ালা বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আর কোথাও হয়েছে এত? আপনি উদাহরণ দিতে পারবেন না। তিনি জেলও খেটেছেন, কী করেননি? কীসের জন্য, গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য।
আমার দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি দাঁড়াবো। সরকারে থাকলে সেবা করার সুযোগ বেশি হয়। না থাকলেও সেবা করার সুযোগ আছে। ইটস নট অ্যা ট্যাগ, যে সরকারে থাকতে হবে। দুনিয়ার যত লোক মানুষের সেবা করে সবাই সরকারে থাকে না। সরকারে থাকলে সুবিধা, বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে একটু বেশি সুবিধা।
Advertisement
আরও পড়ুন>> ভিসানীতি নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের ভয়-ভীতি থাকতে পারে
গত ১৫ বছর দেশে যে কয়েক হাজার ইলেকশন হয়েছে দু-একটাতে অনিয়ম হয়েছে, অধিকাংশ স্বচ্ছ হয়েছে। ইভেন লাস্ট যে কয়েকটি মেয়র নির্বাচন হলো স্বচ্ছ হয়েছে এবং সেগুলোতে সংঘাত কম হয়েছে। আমরা মারামারি চাই না বললেই হবে না, মারামারি বন্ধ করতে হলে একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সেই পরিবেশটা শুধু সরকারের একার দ্বারা সম্ভব নয়। সেজন্য যারা বিরোধীদল, যারা ভিন্নমতের লোক তাদের প্রত্যেককেই আন্তরিকভাবে এ সংঘাত বন্ধ করার একটা ওয়াদা নিতে হবে। এটা খালি লোক দেখানোর ওয়াদা না, আন্তরিকভাবে। তাহলে আমাদের এই মারামারি কমবে। আমাদের এ অঞ্চলে এটি একটি বড় সমস্যা। প্রতিবেশী রাষ্ট্রেও তো নির্বাচনের সময় মারামারি হচ্ছে। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আমরা বদ্ধপরিকর যে একটি সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচন দেবো। কে কী বললো না বললো দিস ইজ সেকেন্ডারি।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশে নির্বাচনের জন্য কতটা স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে?
ড. এ কে আব্দুল মোমেন: আপনি ভালো করলে কিছু শত্রু আপনার হবেই। আমাদের দেশ ভালো করছে এটা নিয়ে সবাই তাজ্জব। ভালো করছি বলে কিছু শত্রু বাড়ছে। আপনি যদি পরিবারের ১০ জনের মধ্যে হঠাৎ বেশি ভালো করেন আপনার কিছু শত্রু হবেই। গত ১৫ বছর স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে ভালো নেতৃত্বের জন্য। ভালো ভিশনের জন্য, তাই এখন অনেকেরই চক্ষুশূল। আর তাদের সঙ্গে দেশের কিছু লোক লাফালাফি করে। এই লাফালাফিটা বন্ধ করতে হবে। আপনি যদি না খেয়ে মরেন, ওনাদের কিন্তু মাথাব্যথা নেই। প্রতিবছর আমার সাড়ে ছয় লাখ লোক বাস্তুহারা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের (বৈশ্বিক উষ্ণতা) জন্য, নদীভাঙনের জন্য, লবণাক্ততার জন্য অনেকে ব্যবসা, ভিটেমাটি সব ছেড়ে শহরে আসছে।
বস্তি দেখলে বিদেশিরা বলছে বাংলাদেশে বস্তি, এটা-সেটা। কিন্তু তাদের কারণেই তো বস্তি হচ্ছে। বস্তি থেকে উদ্ধার করতে কেউ তো এক পয়সা দেয় না, আপনারা সেটি নিয়ে কথা বলেন। তারা আমাদের লুটপাট করার ফলেই আমরা কষ্টে আছি।
আবার বস্তি দেখলে বিদেশিরা বলছে বাংলাদেশে বস্তি, এটা-সেটা। কিন্তু তাদের কারণেই তো বস্তি হচ্ছে। বস্তি থেকে উদ্ধার করতে কেউ তো এক পয়সা দেয় না, আপনারা সেটি নিয়ে কথা বলেন। তারা আমাদের লুটপাট করার ফলেই আমরা কষ্টে আছি। আমরা জিনিস যথেষ্ট তৈরি করি, কিন্তু বিক্রি করতে হয় খুব কম দামে। ওনারা এমন এক সিস্টেম করেছেন যে আপনার জিনিসের দাম নেই, ওনার জিনিসের দাম বেশি। আপনার দুর্গতি কেন? কারণ আপনি ওদের বুদ্ধিতে চলেন। পরিবর্তনের এটাই সময়।
জাগো নিউজ: আপনার নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাই?
ড. এ কে আব্দুল মোমেন: আমার দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি দাঁড়াবো। সরকারে থাকলে সেবা করার সুযোগ বেশি হয়। না থাকলেও সেবা করার সুযোগ আছে। ইটস নট অ্যা ট্যাগ, যে সরকারে থাকতে হবে। দুনিয়ার যত লোক মানুষের সেবা করে সবাই সরকারে থাকে না। সরকারে থাকলে সুবিধা, বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে একটু বেশি সুবিধা। ইলেকশন যখন আসবে ইলেকশন করবো। আমেরিকায় ইলেকশনের দুই সপ্তাহ আগে ইলেকশন নিয়ে হইচই হয়। আমাদের দেশে এক বছর আগে আপনাদের কারণে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়, এটা খুবই দুঃখজনক। এত সময় নষ্ট করা, এত রিসোর্স (সম্পদ) নষ্ট করা। এতদিন এত রিসোর্স নষ্ট করবে কেন দেশ?
আরও পড়ুন>> অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ভিসানীতি: উজরা জেয়া
একটা ইলেকশনের জন্য এতদিন এত রিসোর্স নষ্ট করবে কেন? আমেরিকায় দুই সপ্তাহ আগে বা ১০ দিন আগে হয়তো টেলিভিশনে দেখলেন প্রার্থীদের ছবি আসছে। আর এগুলো নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। যদি সরকার ভালো করে, ওই লোক (প্রার্থী) ভালো করে তাকে মানুষ ভোট দেবে। আর যদি ভালো না করে তাহলে বিদায়। এটা নিয়ে কোনো কথাই কেউ বলে না।
আপনি কখনো দেখেছেন সাবেক প্রেসিডেন্টগুলো পকপক করে? খুব কম লোকই করে, ইউ আর গন (বিদায় নেওয়া) মানে গন। আমাদের দেশে একটা বদ অভ্যাস, আমার এখানে নির্বাচন হবে আমাকে যদি পছন্দ করে ভোট দেবে পছন্দ না করলে ভোট দেবে না, তাতে ভুল কী? আমি তো ওখানে নির্বাচনে জয়লাভ নিজের প্রয়োজনে করিনি। আমি ওখানে মানুষের যদি কিছু সাহায্য করতে পারি সেজন্য নির্বাচন করেছি। সুতরাং, আমার তো হারানোর কিছু নেই। সেবা করার যে সুযোগ সেটা হয়তো একটু কমবে। এ নিয়ে আমি খুব চিন্তিত না। নির্বাচন আসবে যাবে, তো অসুবিধা কী?
আমি মনে করি প্রত্যেক জেলায় জেলা সরকার নির্বাচিত হবে এবং তারা এটি নিয়ন্ত্রণ করবে। আমাদের এই সেন্ট্রালাইজেশনটা ডিভলভিং করা উচিত। এখন সব দায়-দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। এই যে সেন্ট্রালাইজেশন হয়েছে এগুলোর বিরুদ্ধে লেখেন না কেন? এর ফলে বাকি দেশের লোক তাকিয়ে থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে। আমেরিকায় সব স্থানীয় ব্যাপার। প্রত্যেক ক্ষেত্রে নির্বাচন হয়। সেখানে ডিসি সাহেব, এসপি সাহেব, পুলিশ কমিশনার সাহেব-স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নিয়োগ দেয়। তার বেতনও নির্ধারণ করে তারা। কোন স্টেটে বেতন বেশি কোন স্টেটে বেতন কম।
আরও পড়ুন>> বাংলাদেশে নির্বাচন কীভাবে হবে তা আমাদের ব্যাপার
অ্যারিজোনা গরিব সেখানে গভর্নরের বেতন ৩৫ হাজার ডলার, ম্যাসাচুসেটস ধনী সেখানে গভর্নরের বেতন ১ লাখ ২০ হাজার ডলার। আর নিউইয়র্ক আরও ধনী সেখানে বেতন দুই লাখ ডলার। ম্যাসাচুসেটসে সবচেয়ে বেশি বেতন পান স্কুল সুপারিটেন্ডেন্ট। কারণ তারা এডুকেশনের ওপর জোর দেয়। ওখানে স্থানীয় মেয়র ঠিক করেন পুলিশ কমিশনার কে হবেন। এবং ওই এলাকায় যে লোকটা ভালো বোঝে তাকে তারা পুলিশ কমিশনার বানায়।
ট্রান্সফার নেই, এই সিস্টেমই নেই। আমাদের দেশে সেই ব্যবস্থা করলে আমাদের আরও বেশি উন্নতি হবে। বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর সিস্টেম। কিন্তু ব্যুরোক্র্যাটরা (আমলা) সেটি বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন সময় সেখানে ফিরে যাওয়ার। নির্বাচিত জেলা প্রতিনিধি যদি হয় আমার ধারণা আমাদের উন্নয়ন আরও বেশি ত্বরান্বিত হবে। তবে ডিজিটাল হওয়ায় একটা সুবিধা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সেবাটা ভালো হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি স্থানীয় নেতৃত্ব দায়িত্ব পেলে কেন্দ্রীয় হুকুমের দায়িত্ব নয়, নিজেরা যদি রেভিনিউ তুলতে পারে আমাদের উন্নয়ন আরও সহজ হবে এবং ত্বরান্বিত হবে।
আইএইচআর/এএসএ/জেআইএম