১৯৯৯ সাল থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলে। প্রথমবার গিয়েই শক্তিশালী পাকিস্তানকে হারিয়ে আলোড়ন তুলেছিল। সেই জোয়ারে পরের বছরই টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যায় বাংলাদেশ। সেই থেকে হাঁটিঁ হাঁটিঁ পা পা করে বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়েছে। অনেক ব্যর্থতার পাশাপাশি সাফল্যও কম নয়। সবচেয়ে কম বয়সী টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান বাংলাদেশের, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার বাংলাদেশের। তবে ২০১৫ এর বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা আর ২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসানের একক অলরাউন্ড নৈপুণ্য ছাড়া বলার মতো সাফল্য নেই। এবার স্বপ্নটা অনেক বড় ছিল। সেই স্বপ্নের সারথী ছিলেন তামিম ইকবাল। বিশ্বকাপ জেতার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই ভারত যাওয়ার কথা বলছিলেন অধিনায়ক তামিম। কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, সেই তামিম ইকবালকে ছাড়াই বিশ্বকাপ খেলতে গেছে বাংলাদেশ।
Advertisement
যে সময়টা বিশ্বকাপকে সবার পাখির চোখ করার কথা, সেই সময়টা বাংলাদেশ ক্রিকেটে বিতর্কের ঝড় বয়ে গেছে। আর বিতর্কের কেন্দ্রে তামিম ইকবাল। যার কাঁধে অধিনায়কের দায়িত্ব তাকে ঘিরেই যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সেটা হয়তো তামিম বুঝতেই পারেননি। অনেকদিন ধরে যারা তামিমকে চেনেন, তারা জানেন, তামিম আবেগে চলেন। সেই আবেগটাকেই তার বিরুদ্ধে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে প্রাণঘাতী অস্ত্র হিসেবে। ফর্ম-ইনজুরি নিয়ে খোঁচাখুঁচির এক পর্যায়ে আফগানিস্তান সিরিজের মাঝপথে অবসরের ঘোষণা দিয়ে ঝড় তোলেন তামিম। সেই ঝড় পরে সাইক্লোন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তামিম অবসর ভেঙে ফিরে আসেন। তবে পরে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন। চিকিৎসা এবং রিহ্যাব শেষে নিউজিল্যান্ড সিরিজে মাঠে ফেরেন। প্রথম ম্যাচে ব্যাট করার সুযোগ না পেলেও দ্বিতীয় ম্যাচে ৪৪ রান করলেন একদম আগের তামিমের স্টাইলে।
সম্ভবত ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে তামিমের ৭টি চারই চোখে লেগে থাকার মতো। তামিম যখন সুস্থ হয়ে বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুত, ব্যাটেও তার আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া, তখনই ষড়যন্ত্রকারীরা হানলো চূড়ান্ত আঘাত। ফিজিও তামিমকে পরীক্ষা করে জানালেন, নিউজিল্যান্ড সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে খেলার মতো ফিট তামিম। তখনই ছড়িয়ে দেওয়া হলো, তামিম বিশ্বকাপে ৫টি ম্যাচ খেলতে চান, যার কোনো ভিত্তি নেই।
সাকিব জানিয়ে দিলেন, আনফিট খেলোয়াড় দলে রাখলে তিনি বিশ্বকাপ খেলতে যাবেন না। তখনই বোঝা গেলো, ষড়যন্ত্র অনেক গভীরে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচক নন। তবুও তিনি যখন নির্দেশ দিয়েছেন তামিম বিশ্বকাপ খেলবে, তখন কারও পক্ষেই তাকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আবারও তামিমের আবেগে আঘাত করা হলো। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচের অন্তত ১৩ দিন আগে বোর্ড সভাপতি ফোন করে তামিমকে জানালেন, আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে যেন তিনি না খেলেন। খেললেও নিচের দিকে ব্যাট করতে হবে। যিনি দেশের সর্বকালের সেরা ওপেনার, যিনি ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে ওপেনিং ছাড়া অন্য কোনো পজিশনে ব্যাট করেননি; তাকে নিচে ব্যাট করতে বললে তামিম কী জবাব দেবেন; সেটা নিশ্চয়ই বোর্ড সভাপতি জানতেন।
Advertisement
তামিম তাই বলেছেন, তাহলে আমাকে বাদ দিয়ে দেন। এটার জন্যই সবাই অপেক্ষা করছিলেন। তামিমকে ছাড়াই ঘোষণা করা হলো বিশ্বকাপ স্কোয়াড। এখন খুব সহজেই বলা হচ্ছে, তামিমকে বাদ দেওয়া হয়নি, তিনি নিজেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। যে প্রক্রিয়ায় তামিমের মতো ব্যাটসম্যানকে বাদ দেওয়া হলো, তা কাশিমবাজার কুঠির ষড়যন্ত্রকেও হার মানায়। এটা ঠিক, তামিম যদি হঠাৎ অবসরের ঘোষণা না দিতেন, যদি অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা না দিতেন, যদি বোর্ড সভাপতির ফোনে রেগে গিয়ে নিজেকে সরিয়ে না নিতেন; তাহলে তিনি বিশ্বকাপে যেতে পারতেন। তামিম ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত খেলতে চেয়েছিলেন, ওয়ানডেতে ১০ হাজার রান করার স্বপ্ন ছিল তার; সব স্বপ্ন হারিয়ে গেলো ষড়যন্ত্রের আড়ালে। প্রথম কথা হলো, বোর্ড সভাপতি নির্বাচক নন। দল ঘোষণার আগেই ১৩ দিন পরের ম্যাচে কে খেলবেন, কে খেলবেন না বা কোন পজিশনে খেলবেন; সেটা ঠিক করার এখতিয়ার তার নেই। বারবার সীমা লঙ্ঘন করে নাজমুল হাসান পাপন বাংলাদেশ ক্রিকেটে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছেন।
তামিম আর সাকিব একসময় ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। অনেকদিন ধরেই তাদের বৈরিতার খবর চাউর ছিল। তবে এবার তামিমকে বাদ দেওয়ার ঘটনায় সামনে চলে এলো তাদের বিরোধ। বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপ খেলতে ভারতের উদ্দেশ্যে উড়াল দেওয়ার পর ফেসবুকে তামিম ইকবাল পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, তিনি এই নোংরামির মধ্যে থাকতে চান না। তবে তিনি কারও নাম উল্লেখ করেননি। কিন্তু বিমান ধরার আগেই সাকিব টি-স্পোর্টসকে বিশাল সাক্ষাৎকারে যেভাবে তামিমকে আক্রমণ করেছেন, তা রুচিহীন।
একজন অধিনায়ক বোর্ডের অনুমতি ছাড়া বিশ্বকাপের আগে আগে এমন সাক্ষাৎকার দিতে পারেন কি না, প্রশ্ন আছে তা নিয়েও। তবে তারচেয়ে বড় প্রশ্ন যেভাবে তিনি তামিমের দেশপ্রেম নিয়ে, দলের প্রতি নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ক্রিকেটের কোনো মানদণ্ডেই তা গ্রহণযোগ্য নয়। যে ব্যাটসম্যান একহাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে ব্যাট করতে নেমে যান, তার নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা অন্যায়, ঘোরতর অন্যায়। তামিম তার ফেসবুক লাইভ শেষ করেছে, এই বলে, আমাকে ভুলে যাইয়েন না, মনে রাইখেন। ২০০৭ বিশ্বকাপে জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেট এসে ছক্কা মারা, বলে কয়ে লর্ডসে সেঞ্চুরি করে অনার্স বোর্ডে নাম লেখানো তামিমকে ভোলা সম্ভব নয়।
এই ইস্যুতে গোটা বাংলাদেশ এখন তামিম আর সাকিব এই দুইভাগে বিভক্ত। এই বিভক্তি বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য খুবই ক্ষতিকর। দলটা সাকিব বা তামিমের নয়, এটা বাংলাদেশ। এই ইস্যুতে ন্যায্যতার প্রশ্নে, আবেগের প্রশ্নে এমনকি যুক্তির প্রশ্নেও আমি তামিমের পক্ষে।
Advertisement
প্রথম কথা হলো যেভাবে দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্র করে তামিমকে বাদ দেওয়া হলো, তা অন্যায়। তারচেয়ে বড় কথা হলো, এই মুহূর্তে তামিমের চেয়ে ভালো ওপেনার বাংলাদেশ দলে নেই। দেশের স্বার্থেই বিশ্বকাপে তামিমকে দরকার ছিল। বিশ্বকাপ দলে আমি সাকিব-তামিম দুজনকেই চাইবো। কিন্তু প্রশ্ন যদি হয়, সাকিব না তামিম, তাহলে আমার ভোট সাকিবের পক্ষে। মানুষ হিসেবে যতটা খারাপ, ক্রিকেটার হিসেবে ততটাই ভালো সাকিব। একই সঙ্গে তিনি কমপ্লিট ব্যাটসম্যান, একই সঙ্গে কমপ্লিট বোলার। সাকিব থাকা মানে দলে একজন বেশি খেলোয়াড় থাকা। সাথে আছে তার ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্ক।
কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা সবকিছুতে এমনভাবে অন্ধ হয়ে যাই, বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে যায়। তামিমের সাথে অন্যায়ের প্রতিবাদ অনেকেই করছেন। কিন্তু কিছু অন্ধ সমর্থক, তামিমের প্রতি অন্যায়ের প্রতিশোধ হিসেবে সাকিবের ব্যর্থতা চাইছেন, বাংলাদেশের পরাজয় চাইছেন, ওপেনাররা যাতে ভালো করতে না পারেন সে অভিশাপ দিচ্ছেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ার্ম আপ ম্যাচে ইনজুরির কারণে সাকিব খেলেননি। তাতে যেন উল্লাসের বান ডাকে তামিম সমর্থকদের মধ্যে। পুরো ঘটনায় তামিম যতটা স্পোর্টিং, তার সমর্থকদের কেউ কেউ তার উল্টো।
আমরা যদি ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারি, তাহলেই উল্লাসে মাতবে গোটা দেশ। সে সামর্থ্য অবশ্যই আমাদের আছে। যদি আরও এগিয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই। বিশ্বকাপে সব দলেরই কমপক্ষে ৯টি ম্যাচ খেলার সুযোগ আছে। আমার ব্যক্তিগত চাওয়া হলো, বাংলাদেশ যদি ভারত আর পাকিস্তানকে হারাতে পারে তাহলেই আমি চ্যাম্পিয়নের আনন্দ পাবো। সব তিক্ততা ভুলে আমরা বাংলাদেশের সাথে আছি। এগিয়ে যাও বাংলাদেশ।
তামিম সমর্থকরা সাকিবের মতো প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, দলটা সাকিব বা তামিমের নয়। এই দলের যে কারও ইনজুরি মানে বাংলাদেশের স্বপ্নে আঘাত। সাকিব খেলতে না পারা মানে পুরো দেশের ওপর আঘাত। পেছনে যা হয়েছে, তা নিয়ে বসে থাকলে হবে না। আমাদের এখন সামনে তাকাতে হবে। যে ১৫ জন ভারতে গেছে, তাদের সুস্থতা এবং ফর্মই এখন আমাদের সবার চাওয়া হওয়া উচিত। ওয়ার্ম আপ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পারফরম্যান্স আমাদের আবার আশাবাদী করেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে সংকটের জায়গা যে ওপেনিং, তা জ্বলে উঠেছে।
অনেকদিন পর ফর্মে ফিরেছেন লিটন দাস, জুনিয়র তামিম তার সামর্থ্য জানান দিয়েছেন। হৃদয়ের সামর্থ্য আমরা জানি। খালি মাথা ঠান্ডা রেখে খেলতে হবে। মুশফিক নিশ্চয়ই তার শেষ বিশ্বকাপ স্মরণীয় করে রাখতে চাইবেন। আর রিয়াদের তো অনেক কিছু প্রমাণের আছে। এশিয়া কাপে মিরাজ তার সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন। এদের সাথে আছেন সাকিব আল হাসান। ভারতের মাটিতে ব্যাটিং পিচে লড়াই হবে ব্যাটসম্যানদের।
কাগজে-কলমে আমাদের ব্যাটারদের সামর্থ্য আছে যে কোনো বোলিংকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার। এখন শুধু জ্বলে ওঠার অপেক্ষা। তবে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখার সাহস আমাদের বোলাররা। মানতেই হবে বাংলাদেশের বোলিং এখন বিশ্বসেরা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ার্ম আপ ম্যাচে বাংলাদেশের বোলাররা যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তা আশাবাদী হতে অনুপ্রাণিত করবে। অ্যালান ডোনাল্ড বদলে দিয়েছেন বাংলাদেশের পেস অ্যাটাক। তাসকিন তো আছেনই, নিউজিল্যান্ড সিরিজে ফর্মে ফিরেছেন মুস্তাফিজও। ভারতের মাটিতে ফিজ হতে পারেন প্রতিপক্ষের আতঙ্ক। স্পিন নিয়ে তৈরি সাকিব আর মিরাজ। প্রয়োজনে হাত ঘুরাতে পারবেন রিয়াদও। সব মিলিয়ে স্বপ্ন দেখাই যায়। তামিমকে মিস করবো। কিন্তু পৃথিবীতে কিছুই কারও জন্য থেমে থাকে না। যেহেতু এখন দলের ওপর সাকিবের একক নিয়ন্ত্রণ, আশা করি তিনি তার আক্রমণাত্মক মনোভাব ছড়িয়ে দিতে পারবেন দলে।
আমরা যদি ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারি, তাহলেই উল্লাসে মাতবে গোটা দেশ। সে সামর্থ্য অবশ্যই আমাদের আছে। যদি আরও এগিয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই। বিশ্বকাপে সব দলেরই কমপক্ষে ৯টি ম্যাচ খেলার সুযোগ আছে। আমার ব্যক্তিগত চাওয়া হলো, বাংলাদেশ যদি ভারত আর পাকিস্তানকে হারাতে পারে তাহলেই আমি চ্যাম্পিয়নের আনন্দ পাবো। সব তিক্ততা ভুলে আমরা বাংলাদেশের সাথে আছি। এগিয়ে যাও বাংলাদেশ।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম