দেশজুড়ে

জানার ঘাটতি নিয়েই এমবিবিএস শেষ হবে ৫০ শিক্ষার্থীর!

প্রতিষ্ঠার পর পাঁচ বছর পেরিয়েছে নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজের। ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করা মেডিকেল কলেজটিতে এখন শিক্ষার্থী ২৩২ জন। প্রথম ব্যাচের অর্ধশত শিক্ষার্থী এক বছর পরই শিক্ষাজীবন শেষ করবেন। তবে প্রস্তাবিত হাসপাতাল না হওয়ায় বিশেষায়িত চিকিৎসা না দেখেই ডাক্তারি পড়া শেষ করবেন তারা। ফলে জানার ঘাটতি নিয়েই এমবিবিএস শেষ হবে তাদের।

Advertisement

এছাড়া নিজেদের একাডেমিক ভবন ও শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষাগারও নেই। কোনো কোনো বিভাগ চলে মাত্র এক বা দুজন চিকিৎসক দিয়ে। মেডিকেলে পড়েও তারা পাচ্ছেন না ক্লিনিক্যাল ক্লাস।

কলেজ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তা পাস হয়নি। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এর দায় প্রশাসকদের। তাদের তদারকি ও সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে।

নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালের কয়েকটি কক্ষে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। আবাসন ও শ্রেণিকক্ষ সংকটে হতাশ শিক্ষার্থীরা। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মেডিকেল কলেজটির চিত্র এই।

Advertisement

কলেজ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তা পাস হয়নি। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এর দায় প্রশাসকদের। তাদের তদারকি ও সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে।

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজের উদ্বোধন করেন। কলেজের সঙ্গে হওয়ার কথা ছিল ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও নার্সিং কলেজ। তবে পাঁচ বছর পেরিয়ে জমি অধিগ্রহণও হয়নি। বর্তমানে অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সদর হাসপাতালের কয়েকটি কোয়ার্টার।

হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ অস্ত্রোপচার কক্ষ, আইসিইউ, সিসিইউ ও এনআইসিইউ’র মতো বিশেষায়িত কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা এসব না দেখেই শিক্ষাজীবন শেষ করতে যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন: রাষ্ট্রপতির নামে স্থাপিত মেডিকেল কলেজের ৭টি লোহার খাটের হাসপাতাল

Advertisement

বর্তমানে পাঁচটি ব্যাচে মোট শিক্ষার্থী ২৩২ জন। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ ছাত্রী। বিপরীতে শিক্ষক মাত্র ৪৪ জন। প্রতিষ্ঠানটিতে একমাত্র অধ্যাপক অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। ছয়জন সহযোগী অধ্যাপক, ১৬ জন সহকারী অধ্যাপক। বাকি সবাই প্রভাষক। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকলেও ইএনটি, রেডিওলজি, সার্জারিসহ কয়েকটি বিভাগে শিক্ষকের সংকট প্রকট। দু-একজন শিক্ষক দিয়ে এসব বিভাগে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চতুর্থ বর্ষে পড়া কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, তাদের চতুর্থ বর্ষ চলছে। বছরখানেকের মধ্যে তারা ইন্টার্ন চিকিৎসক হবেন। কার্ডিওলজি, নাক-কান-গলা (ইএনটি), অর্থোসার্জারিসহ বিশেষায়িত চিকিৎসায় হাতে-কলমে শিক্ষার সুযোগ হয়নি। ক্লিনিক্যাল শিক্ষায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

কলেজের দুই সহকারী অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সংকট নিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ হলে শিক্ষার্থীদের জানার ঘাটতি থেকে যাবে। যেমন একটি বিভাগে যদি একজন শিক্ষক থাকেন, ওই শিক্ষককেই কয়েকটি ব্যাচের তত্ত্বীয় ক্লাস, ক্লিনিক্যাল ক্লাস, আইটেম পরীক্ষা, হাসপাতালে রোগী দেখার মতো কাজ করতে হচ্ছে। ফলে শিক্ষকের ওপর যেমন অতিরিক্ত চাপ পড়ছে, তেমনি শিক্ষার্থীরাও নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন।

ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজগুলোতে অনেক পদ খালি। শিক্ষক ও চিকিৎসকের অভাবে সেখানে শিক্ষা-চিকিৎসা দুটোই ব্যাহত হচ্ছে। ভালো চিকিৎসক তৈরি হবে না। ফলে সামগ্রিকভাবে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানান, মেডিকেলে ভর্তির পর শিক্ষার্থীদের প্রথম পর্বে দেড় বছর সময়ের মধ্যে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি ও বায়োকেমিস্ট্রি পড়ানো হয়। দ্বিতীয় পর্বে এক বছর সময়ের মধ্যে কমিউনিটি মেডিসিন ও ফরেনসিক মেডিসিন পড়ানো হয়। তৃতীয় পর্বে এক বছরের জন্য ফার্মাকোলজি, প্যাথলজি ও মাইক্রোবায়োলজি পড়ে শিক্ষার্থীরা। চতুর্থ বা চূড়ান্ত পর্বে ক্লিনিক্যাল বিষয়ে দেড় বছর পড়তে হয় তাদের। এ সময়ের মধ্যে মেডিসিন, কার্ডিওলজি, শিশু, বক্ষব্যাধি, সার্জারি, অর্থোসার্জারি, ইএনটি, চক্ষু, অ্যানেসথেসিয়া ও প্রসূতি বিষয়ে হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ব্যবহারিক ক্লাস করতে হয়। কিন্তু ১০০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক সদর হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, রোগী, চিকিৎসা কোনোটাই নেই।

হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ অস্ত্রোপচার কক্ষ, আইসিইউ, সিসিইউ ও এনআইসিইউ’র মতো বিশেষায়িত কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা এসব না দেখেই শিক্ষাজীবন শেষ করতে যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন: মেডিকেল কলেজ স্থাপনে বাংলাদেশের সেঞ্চুরি

এ বিষয়ে নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ শ্যামল কুমার পাল বলেন, কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জায়গা নির্ধারণসহ ভৌত অবকাঠামো স্থাপনের জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তর একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি কার্যালয়ে জমা দিয়েছিল। পরে সেটি পাস হয়নি।

তিনি আরও বলেন, নির্ধারিত স্থান না থাকায় সদর হাসপাতালের অব্যবহৃত কয়েকটি ছোট কোয়ার্টার মেরামত করে নিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তাতে মাত্র ১৬৬ শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বাকি ৬৬ শিক্ষার্থী বাইরে থাকে। মেডিকেল কলেজের জন্য সদর উপজেলার মৌজেবালি এলাকায় জায়গা নির্বাচন করে জরিপ ও নকশার কাজ করা হয়েছিল। পরে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও সেটি কার্যকর হয়নি।

মেডিকেল কলেজটির শিক্ষার এ অবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের (বিএসএমএমইউ) গাইনোকোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা বলেন, ‘শুধু নেত্রকোনা নয়, অনেক মেডিকেল কলেজেই শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সরকার পদ সৃজন করে চিকিৎসকদের সেখানে দিতে পারে। শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসক আছেন। সরকার উদ্যোগ নিয়ে যথাযথ পদে পদায়ন করলেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’

জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, এ বিষয়গুলো অনেক দিন ধরেই শুনে আসছি। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজগুলোতে অনেক পদ খালি। শিক্ষক ও চিকিৎসকের অভাবে সেখানে শিক্ষা-চিকিৎসা দুটোই ব্যাহত হচ্ছে। ভালো চিকিৎসক তৈরি হবে না। ফলে সামগ্রিকভাবে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

আরও পড়ুন: ১২ বছর পর মর্গ পেল সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ

তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সমস্যা সমাধানে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ রয়েছে। তারা কেন বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে না, তা বুঝে আসে না। অনেক চিকিৎসক ১০-১২ বছর আগে এমডি/এমএস পাস করে মেডিকেল অফিসার হয়ে বসে আছে। তাদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। পদোন্নতি ও শিক্ষক নিশ্চিত করা প্রশাসনের দায়িত্ব। কর্তাব্যক্তিদের এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। এর দায় প্রশাসকদের। তাদের তদারকি ও সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষক সংকট নিরসনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

এইচ এম কামাল/এমএইচআর/এসএইচএস/জেআইএম