অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। বিশেষ সুবিধা আর ছাড় দেওয়ার পরও কমছে না খেলাপি ঋণ। বিপরীতে ব্যাংক খাতের এই ‘প্রধান সমস্যা’ দিনের পর দিন বাড়ছে।
Advertisement
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের ৯২ দিনে খেলাপি বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতিদিন বেড়েছে ২৬৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা। নিয়মিত সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবার বাদ দিলে প্রতি কার্যদিবসে বেড়েছে ৩৭৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
অন্যদিকে করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণকে ব্যাংকিং খাতের বড় দুই সমস্যা বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ঢালাওভাবে ছাড় নয় পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। খেলাপি নামে সমস্যা দূর করতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গ্রহীতা ও দাতার ক্ষেত্রে একইভাবে রেগুলেশন প্রয়োগের পাশাপাশি নৈতিকতার অনুশীলন প্রয়োগের কথাও জানান তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন প্রান্তিক শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ।
Advertisement
তথ্য বলছে, গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা যা ছিল মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা বেড়ে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এক বছর আগে অর্থাৎ গত বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন: ২ থেকে এক লাফে ৫ শতাংশ সুদ চায় বিশ্বব্যাংক
ডলার সংকটে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের দারস্থ হয় বাংলাদেশ। ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার বা ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার পেয়েছে। বাকি ছয় কিস্তির মধ্যে আগামী নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের কথা রয়েছে। কয়েক ধাপে ঋণ ছাড়ের ক্ষেত্রে সংস্থাটি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার শর্ত জুড়ে দিয়েছিল। আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে বলে জানিয়েছে। সব শেষ প্রতিবেদন মতে, খেলাপি ঋণের হার ১০ দশমিক ১১ শতাংশ।
ব্যাংক খাতে ঋণ আদায় হচ্ছে না, আবার বিতরণও চলছে। এভাবে খেলাপি কমবে না। এভাবে ব্যাংক চলতে পারে না।
Advertisement
আইএমএফ-এর ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। তবে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছাড়িয়ে গেছে ২০ শতাংশ। আইএমএফ’র শর্ত মতে, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ, সন্দেহজনক ঋণ ও আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণকেও খেলাপি দেখাতে হবে। সেক্ষেত্রে আইএমএফ’র হিসাবে খেলাপি দাঁড়াবে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থান না থাকায় খেলাপি বাড়ছে বলে মত অনেকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে আমাদের তেমন সফলতা আসছে না। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে। খেলাপি কমাতে না পারলে ব্যাংকগুলোর শাখা বন্ধের নির্দেশ দিতে হবে।
আরও পড়ুন: দুই মাসে ৫৩০৮ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ
বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, করপোরেট গভর্নেন্স ও খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় দুই সমস্যা। খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের আরও ভূমিকা নিতে হবে।
তবে বাস্তবায়ন হয়নি এসবের কিছুই।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, খেলাপি ঋণ বন্ধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই, কার্যকর পদক্ষেপও নেই। খেলাপির যে চিত্র এসেছে প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ, বড় হবে। কোভিড পরিস্থিতিতে ছাড় দেওয়া হলো, অন্যান্য সময়ও ছাড় দেওয়া হচ্ছে। মোট ঋণের কিছুটা পরিশোধ করলেই আর তিনি খেলাপি না, এমনটা বার বার করেও সুফল কতটুকু তা দেখতে হবে।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ঋণ পরিশোধে বার বার সুযোগ দেওয়ার পরও কোনো সুফল আসেনি। যে রেগুলেশন আছে সেটা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। যে ঋণ বিতরণ করছে তাকে এবং যেনি ঋণ নিচ্ছেন তাকেও একই চোখে দেখতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকতে হবে। ব্যাংক খাতে ঋণ আদায় হচ্ছে না, আবার বিতরণও চলছে। এভাবে খেলাপি কমবে না। এভাবে ব্যাংক চলতে পারে না।
ইএআর/এমএইচআর/জিকেএস