ভারতের মণিপুর রাজ্যে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানকার তিনটি বড় হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে ৯৬টি মরদেহ। কিন্তু এসব মরদেহ নেওয়ার জন্য এখনো কেউ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ভয়ে লোকজন হাসপাতাল থেকে স্বজনদের মৃতদেহ নিচ্ছেন না। বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
Advertisement
এমন পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক গঠিত প্রাক্তন বিচারপতিদের একটি কমিটি রাজ্য সরকারকে মৃতদের একটি তালিকা প্রকাশ করার পরামর্শ দিয়েছে। এতে করে মরদেহগুলো শনাক্ত করা যাবে এবং তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা সহজ হবে।
আরও পড়ুন: ফের উত্তপ্ত মণিপুর, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত ৪০
এরপরেও যদি কোনো মরদেহের দাবিদার এগিয়ে না আসেন তাহলে সসম্মানে অন্তিম সংস্কার করে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মণিপুরে জাতিগত সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ১৭৫ জন নিহত হয়েছেন এবং অনেকে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
Advertisement
মণিপুর রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই এবং কুকি উপজাতিদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গা বেধেছে। এই গোষ্ঠী দুটি রাজ্যের দুটি ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাস করে। দাঙ্গার পর এখন পরিস্থিতি এমন যে, এক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ অন্য গোষ্ঠীর ভূখণ্ডে যেতে পারে না। সমগ্র মণিপুর রাজ্য জাতিগত ভিত্তিতে ভাগ হয়ে গেছে। সেখানে এখনো সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।
গোষ্ঠীভিত্তিক এলাকা ভাগজাতিগত সহিংসতায় নিহত ৯৬ জনের মরদেহ মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের দুটি হাসপাতালে রাখা হয়েছে। ইম্ফল উপত্যকায় মেইতেই গোষ্ঠীর আধিপত্য রয়েছে এবং এখানকার দুটি হাসপাতালে রাখা মরদেহগুলো কুকি নৃগোষ্ঠীর অন্তর্গত। চুড়াচাঁদপুরের জেলা মেডিকেল হাসপাতালে যে মরদেহগুলো রাখা হয়েছে সেগুলো কুকি এবং মেইতেই উভয় গোষ্ঠীরই। তবে তাদের মধ্যে কুকিদের মরদেহের সংখ্যাই বেশি।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দাঙ্গার পর কুকিরা মেইতেইর এলাকায় যেতে পারে না এবং মেইতেই সম্প্রদায়ের লোকেরা কুকিদের এলাকায় যেতে পারে না। আইন অনুযায়ী, নিহতদের পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগতভাবে হাসপাতাল মর্গে গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করতে হয় এবং পরিবারের সদস্যরা একে অন্য জাতির অঞ্চলে যেতে না পারায় কয়েক মাস ধরে এসব দেহ শনাক্তকরণ ছাড়াই এখানে রাখা হয়েছে।
পারস্পরিক বিশ্বাস ভেঙ্গে গেছেঅত্যন্ত সংবেদনশীল পরিস্থিতির কারণে হাসপাতালগুলো এখনো এসব মরদেহের ছবি এবং বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেনি। স্থানীয় কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনী চেষ্টা করছে যেন নিহতদের পরিবার গিয়ে মরদেহগুলো অন্তত শনাক্ত করতে পারে। তাহলে তাদের সৎকার করা যেত। কিন্তু তাও সম্ভব হচ্ছে না। গত কয়েকদিনে সেখানে গুলি বর্ষণের ঘটনা কমেছে ফলে মৃত্যুর সংখ্যাও কিছুটা কমেছে।
Advertisement
তবে সমস্যা হচ্ছে, উভয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস ও ঘৃণার ব্যবধান এতটাই গভীর হয়ে উঠেছে যে তা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর দুই গোষ্ঠীরই আস্থা কমে যাওয়ায় সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন: থমথমে ভারতের মণিপুর, রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি কংগ্রেসের
এদিকে ইনডিজেনাস ট্রাইবাল লিডারস ফোরামের সেক্রেটারি মাওয়ান তেভেম্বেং বিবিসিকে বলেন, ইম্ফল উপত্যকায় গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করা অসম্ভব। কারণ এটি মৃত্যুর উপত্যকার মতো। নিহতদের পরিবার তো সেখানে যেতে পারছেনই না, এমনকি আমাদের বিধানসভার সদস্যকেও সেখানে বেধড়ক মারধর করা হয়েছিল।
তার কথায়, বেশিরভাগ মৃতদেহ ছবি বা ফোনের মাধ্যমে শনাক্ত করা হলেও বৈধ কাগজপত্র জমা না দিতে পারায় কর্তৃপক্ষ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করছে না।
তিনি জানান, এসব মৃতদেহ ছাড়াও ৪১ জন কুকি এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। অনেক মৃতদেহ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে সেগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। নিহতদের নাম, বয়স ও অন্যান্য তথ্য দিয়ে বিবিসিকে একটি তালিকা পাঠিয়েছেন তিনি।
তার মতে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই গোষ্ঠী ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলে এবং কেন্দ্রীয় সরকার অভিযোগের সমাধান করলেই পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এখনও অস্থায়ী শিবিরগুলোতে ৪১ হাজার কুকি বসবাস করছেন। এমন পরিস্থিতি রয়েছে যা কয়েক দিনে স্বাভাবিক করা যাবে না। পরিস্থিতি নির্ভর করছে সরকারের অভিপ্রায়ের ওপর।
সরকার কী করছে?সুপ্রিম কোর্ট গত মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি গীতা মিত্তলের নেতৃত্বে হাইকোর্টের তিন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির একটি কমিটি গঠন করেছিল। এই কমিটির কাজ মণিপুরে জাতিগত সহিংসতার মানবিক দিকগুলোতে সহায়তা করা।
কমিটি একটি রিপোর্টে সুপারিশ করেছে যে, রাজ্য সরকারকে পাঁচ মাস ধরে চলা সহিংসতায় নিহতদের একটি তালিকা প্রকাশ করতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে যেন তাদের পরিবারকে নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়।
আরও পড়ুন: মণিপুর ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ, মিজোরামে শরণার্থীর ঢল
কমিটি বলছে, যদি এই প্রচেষ্টা সফল না হয়, তাহলে জেলা কালেক্টরের উচিত উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করে পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে মৃতদেহগুলো সৎকার করা। কিন্তু সেটাও আসলে খুব একটা সহজ কাজ নয়।
মণিপুর বর্তমানে উত্তেজনা আর সহিংসতার ভয়ে ডুবে রয়েছে। এখানে আবারও কয়েক দিনের জন্য মোবাইল ইন্টারনেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ অস্থায়ী শিবিরে অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে বসবাস করছে এবং স্বাভাবিক জীবন পুরোপুরি বিপর্যস্ত। কতদিন পরিস্থিতি এরকম থাকবে সে বিষয়ে এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
টিটিএন