লতাপাতা আর ঝোপঝাড়ে ঢেকে রয়েছে ফটকের দেওয়াল। দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ফটকের ভেতরে একটি মিউজিয়াম আছে। সামনে এগুলেই লাতাপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটি সাইনবোর্ড আবছা আবছা দেখা যায়। তাতে লেখা মাদারীপুর মিউজিয়াম, জেলা প্রশাসন, মাদারীপুর। কিন্তু এ পথ দিয়ে যাওয়া কেউ আর জানেন না এখানে মিউজিয়াম আছে। কারণ মিউজিয়ামটি উদ্বোধনের ছয় মাস পার হলেও এখনো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়নি।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৩১ মার্চ মাদারীপুর শহরের ঐতিহ্যবাহী শকুনি লেকপাড়ের পুরাতন ট্রেজারি ভবনে মাদারীপুর মিউজিয়ামের উদ্বোধন করা হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুনের উদ্যোগে সরকারিভাবে মাদারীপুর মিউজিয়ামের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জাতীয় সংসদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান।
মাদারীপুরসহ সারাদেশ ও পৃথিবীর প্রাচীন নিদর্শন, ঐতিহ্য, ইতিহাস, উপ-মহাদেশের ঐতিহাসিক ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত জীবনী, বিলুপ্তি হওয়া নানা জিনিসপত্রসহ নানা বিষয়বস্তু থাকার কথা। অথচ মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মিউজিয়াম উদ্বোধনের ছয় মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। উদ্বোধনের সময় কিছু মনীষীদের ছবি ও সংক্ষিপ্ত জীবনী, কিছু প্রাচীণ ঐতিহ্য, পুরোনো ফ্যাক্স মেশিন, টাইপিং মেশিনসহ বেশ কিছু পুরোনো জিনিসপত্র রাখা হলেও, তা পর্যাপ্ত নয়। এরপর আর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
এদিকে, দীর্ঘদিন মিউজিয়ামটি বন্ধ থাকায় প্রধান গেটে লতা-পাতাসহ জঙ্গলে ভরে গেছে। এমনকি নামের সাইনবোর্ডও ঢেকে গেছে। বোঝার উপায় নেই এখানে একটি মিউজিয়াম আছে। অথচ প্রতিদিনই এই লেকপাড়ে শহরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকার কয়েকশ দর্শনার্থী আসেন। তাই মিউজিয়ামটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া ও জিনিসপত্রের সংগ্রহ বাড়ানো হলে এখানকার মানুষের বিনোদনে জন্য যোগ হবে নতুন মাত্রা। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মও ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে।
Advertisement
পৌরশহরের লেকপাড় দিয়ে যাওয়া পথচারী ইশরাত জাহান, ঊর্মি, স্নিগ্ধা, মাহবুব হাসান, শাহিন খানসহ একাধিক ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলে তারা মিউজিয়ামের কথা জানেন না বলে জানান। তারা বলছেন, এখানে যে একটি মিউজিয়াম আছে, তা জানা নেই। কখনো চোখেও পড়েনি। আর পড়বেই বা কীভাবে, যেভাবে ঝোপ-জঙ্গলে ঢেকে আছে, তাতে তো বোঝার কোনো উপায় নেই।
মাদারীপুরের তারুণ্য পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সোহাগ হাসান বলেন, মাদারীপুরের মিউজিয়ামটি উদ্বোধন হলেও এখনো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়নি। মিউজিয়ামটিতে লতাপাতায় এমনভাবে ঢেকে গেছে যে বোঝার উপায় নেই এখানে একটি মিউজিয়াম আছে। এখান দিয়ে যারা যায় তারাও বোঝে না এখানে একটি মিউজিয়াম আছে। তাই এটি পরিষ্কার করলে এ পথ দিয়ে যাতায়াতকারী মানুষগুলো অনন্ত দেখতে পাবেন মাদারীপুরে একটি মিউজিয়াম আছে। এটি চালু হলে নতুন প্রজন্মও দেশ সর্ম্পকে আরও বেশি জানতে পারবে।
মাদারীপুরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আদর্শ কল্যাণ ফোরামের চেয়ারম্যান মো. এসকান্দার আলী মাতুব্বর বলেন, মাদারীপুরে কোনো মিউজিয়াম ছিল না। কয়েকমাস আগে মিউজিয়ামের উদ্বোধন হয়েছে। কিন্তু তা সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত হয়নি। মিউজিয়ামটি জঙ্গলে ভরে গেছে। তা পরিষ্কার করে চালুর দাবি জানাই।
মৈত্রি মিডিয়া সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক এস এম আরাফাত হাসান বলেন, মাদারীপুর মিউজিয়ামটি উদ্বোধনের পর থেকেই বন্ধ। গেট লতাপাতায় ভরা। এটি সংস্কার করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হোক।
Advertisement
মাদারীপুরের ফ্রেন্ডস অব নেচারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাজন মাহমুদ বলেন, উদ্বোধনের ছয়মাস পার হলেও এখনো এটি চালু না হওয়া দুঃখজনক। তবে জেলা প্রশাসন থেকে যদি বিভিন্ন এনজিও বা সংগঠনগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে ওইসব সংগঠন বিভিন্ন জিনিসপত্র সংগ্রহ করে সহযোগিতা করতে পারে। এতে মাদারীপুরের হারিয়ে যাওয়া অনেক জিনিসপত্র নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হবে।
মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষক সুবল বিশ্বাস বলেন, জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক সরকারিভাবে একটি মিউজিয়াম করেছেন। যা আমাদের প্রজন্ম দেখে-শুনে বুঝতে পারতো এবং সম্মুখ ধারণা নিতে পারতো। মিউজিয়ামটি উদ্বোধনের পর থেকেই বন্ধ থাকায় লতাপাতায় ভরে গেছে। তাই এই মিউজিয়ামটি চালুর জন্য একজন লোক নিয়োগ করা হোক, যাতে করে মিউজিয়ামটি চালু রাখতে পারে। এছাড়া এই লেকপাড়ে প্রতিদিন সকাল-বিকাল কয়েকশ মানুষ আসে। এসব মানুষ মিউজিয়ামটি দেখতে পারবে, জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য মিউজিয়ামটি ভূমিকা রাখুক এ প্রত্যাশা করছি।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাইনউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, এরই মধ্যে মিউজিয়ামটি চালুর কাজ শুরু করেছি। বেশ কিছু কাজও হাতে নেওয়া হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুত এটি খুলে দেওয়া হবে।
মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা) মো. নাজমুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, মিউজিয়ামে তেমন কোনো জিনিসপত্র নেই। বেশকিছু দামী ছবি পাওয়ার কথা। সেগুলো শিগগির হাতে পাবো। মিউজিয়াম চালুর জন্য এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। আশা করছি আগামী দুমাসের মধ্যে এটি চালু সম্ভব হবে। এছাড়া বর্ষা আসায় লতাপাতায় ভরে গেছে। সেগুলোও পরিষ্কার করা হবে। এ বিষয়ে পৌরসভার সঙ্গে কথা হয়েছে।
আয়শা সিদ্দিকা আকাশী /এসজে/এএসএম