একুশে বইমেলা

লিখতে চান অনেকেই কিন্তু পড়তে চান কম: শফিক হাসান

শফিক হাসান মূলত গল্পকার, তবে অল্প-বিস্তর সবই লেখেন। মাড়াতে চান সাহিত্যের নানা প্রান্তর। জন্ম ২ জানুয়ারি ১৯৮৩ সালে—তিতাহাজরা, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালীতে। লেখালেখিকে করে তুলেছেন জীবনের ব্রত। ২০০৪ সাল থেকে সম্পাদনা করছেন গল্পবিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন ‘প্রকাশ’। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের লিটল ম্যাগাজিন ও পত্রপত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। অর্জন করেছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কার ও সম্মাননা। শফিক হাসানের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২১টি। নিজেকে গল্পকার হিসেবে পরিচয় দিতেই ভালোবাসেন।

Advertisement

সম্প্রতি বইমেলা ও বই প্রকাশ সম্পর্কে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—

জাগো নিউজ: আগামী বইমেলায় আপনার কয়টি বই প্রকাশিত হচ্ছে?শফিক হাসান: এটা খুবই কঠিন প্রশ্ন, অন্তত আমার মতো অভাজনের জন্য। চলতি বছরের বইমেলা উপলক্ষে একজন প্রকাশক একটি বই প্রকাশ করবেন করবেন বলে শেষপর্যন্ত করলেন না আর। বলেছেন, পরের বছর (২০২৪) করবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো হেলদোল দেখছি না! কয়েক মাস আগে নতুন একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একটি পাণ্ডুলিপি নিয়েছে। এখনো আপডেট কিছু জানাননি সংশ্লিষ্টরা। এর বাইরে সময় করতে পারলে আরও নতুন দু’একটা নতুন পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করবো। কিছু কাজ করাও আছে। যদি সেটা সম্ভব হয়—নতুন পাণ্ডুলিপি দাঁড়ায়, তারপর শুরু হবে বড় যুদ্ধটা।

লেখক হিসেবে যারা ধারে কাটেন না, ভারেও কাটেন না, সব ধরনের কাটাকাটি থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকেন—তারা সহজে প্রকাশকের কলকে পাবেন না, এটাই সত্য। কঠিন বাস্তবতার সমীকরণ। লেখকের সামাজিক স্ট্যাটাস, ক্ষমতাধর একটি চেয়ার তথা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিপূর্ণ অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এখানে। এখন যদি বলেন, পাণ্ডুলিপি পড়ার কথা, নিয়মতান্ত্রিকতার বিষয়ে। এসব হচ্ছে, গতবাঁধা বুলি; ছেলেভোলানো গল্প। বাংলাদেশের হাজার হাজার প্রকাশকের মধ্যে ঠিক কতজন প্রকাশক পাণ্ডুলিপি পড়েন, পড়লেও পাণ্ডুলিপি বোঝেন! সম্পাদনা পর্ষদ আছে কতজনের? থাকলেও সেখানে কাদের বই সম্পাদিত হয়! নবীন বা প্রবীণ কেউ ভালো লিখলেই যে তার লেখা বই হয়ে সহজে পৌঁছে যাবে পাঠকের কাছে—বিষয়টা বোধকরি এতটা সহজ নয়।

Advertisement

আরও পড়ুন: পাওয়া যাচ্ছে কিশোর জীবনী ‘হাজী মহম্মদ মহসিন’

জাগো নিউজ: বাংলা একাডেমি আয়োজিত আগামী বইমেলা কেমন দেখতে চান?শফিক হাসান: সব সময়ই গোছানো একটি বইমেলা দেখতে চাই—যেটা সবারই প্রত্যাশায় থাকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কিছু না কিছু অসঙ্গতি থেকেই যায়। প্রকাশকরা অভিযোগ করেন, বইমেলায় বাংলা একাডেমিকে স্টল ভাড়া দেওয়া, স্টল বানানোর খরচ থেকে শুরু করে স্টলকর্মীদের বেতনের সমপরিমাণ টাকা কোনো কোনো তরুণ প্রকাশক মাসজুড়ে বিক্রিও করতে পারেন না। এসব ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি ভাড়ার টাকাটা চাইলে আরও কমিয়ে নিতে পারে। উপরন্তু স্টল নির্মাণেও সহযোগিতা করতে পারে। যেহেতু প্রতি বছরই কোনো না কোনো কোম্পানি বইমেলায় স্পন্সর করে।

তরুণ প্রকাশকদের একুশে বইমেলায় স্টল নেওয়া যেন অনেকটা বাধ্যতামূলক। কারণ সেখানে স্টল না থাকলে লেখকসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই তাদের পোঁছেন না। এটাও সঠিক মানসিকতা নয় বলেই মনে করি। বই বিক্রির বিকল্প জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। তাহলে বইমেলাকেন্দ্রিক অহেতুক উন্মাদনা কিছুটা হলেও কমানো যাবে।

জাগো নিউজ: আপনার দেখা বিগত বইমেলায় কোনো অসঙ্গতি চোখে পড়েছে?শফিক হাসান: পড়েছে অবশ্যই। তিনটি বিষয়ের কথা বলি। ডাস্টবিন রাখা হয়েছে বইমেলার শেষের দিকে। মানে বইমেলার বিভিন্ন স্টলের বর্জ্যগুলো ফেলা হতো মেলার ভেতরেই, যেখানে বাংলাদেশ পুলিশের একটি নিরাপত্তাবিষয়ক ক্যাম্প ছিল, সেটার পেছনের দিকটায়। বইমেলার নির্দিষ্ট একটি অংশকে ভাগাড় বানিয়ে ফেলাটা ভালো লাগেনি। চাইলে বর্জ্যগুলো অপসারণ করে মেলার বাইরেও নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলা যেত।

Advertisement

প্যাভিলিয়নগুলো গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে মোটামুটি একই জায়গায়। লেকের তিন দিকে। অথচ সুষম বিন্যাস করে প্যাভিলিয়নগুলো যদি পুরো মেলার নানা প্রান্তে থাকতো—সেটাই হতো যুগপৎ সুন্দর ও যৌক্তিক। প্যাভিলিয়নে থাকে জনপ্রিয় ও নামকরা লেখকদের বই, সঙ্গত কারণেই সেখানে ভিড় হবে বেশি। তাই দেখা গেছে, এক জায়গায় অস্বাভাবিক জটলা অন্য দিকগুলো ফাঁকা। আর প্যাভিলিয়ন যারা নেন, তারা অধিকাংশই ক্ষমতাবান প্রকাশক। বিগত বছরে এই প্রকাশকরা বরাদ্দকৃত জায়গার বাইরে গিয়ে নিজেদের পছন্দের জায়গায় প্যাভিলিয়ন বানিয়েছেন। এমন বিচ্যুতিতে বাংলা একাডেমি গতবাঁধা বক্তব্য দিলেও শেষপর্যন্ত শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জোরের মুল্লুকই থেকে গেছে সর্বত্র।

আরও পড়ুন: মিজানুর রহমান মিথুনের ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প’

খাবারের উচ্চমূল্যও বইমেলার বড় সমস্যা। কেউ কেউ কটাক্ষ করে বলেন, বইমেলায় কেন খেতে যাবে মানুষ! খাবার মৌলিক চাহিদা, এটা লাগবেই। নেতিবাচকভাবে নেওয়ার কিছু নেই। গলাকাটা দাম কেন হবে? খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, স্টলপ্রতি কয়েক লাখ টাকা করে নেয় বাংলা একাডেমি। এই টাকা তোলার জন্যই তারা গ্রাহকের পকেট কাটে। বাংলা একাডেমির উচিত, অন্তত খাবারের স্টলগুলোকে ভাড়ামুক্ত করে দেওয়া। তাহলে নিম্ন আয়ের স্টলকর্মী, শিক্ষার্থীসহ মেলায় আগত সবাই ন্যায্য মূল্যে খাবার কিনতে পারবেন। এতে শেষপর্যন্ত একটি-দুটি বই কেনার টাকা থেকে যাবে মেলায় আগত বইপ্রেমীর পকেটে। এর প্রভাব পড়বে বই বিক্রিতেও।

জাগো নিউজ: বইমেলায় বইয়ের বিক্রি বাড়ছে নাকি কমছে?শফিক হাসান: বইমেলায় বইয়ের বিক্রি কমেছে, আবার বেড়েছেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে। কিন্তু আদতে জনসংখ্যা অনুপাতে বর্তমানের বিক্রির পরিমাণ হতাশাজনক। শুনতে পাই, বইমেলায় যত দর্শনার্থী আসেন, সবাই যদি একটা করেও বই কেনেন, মেলার মাঠে ঘাসও থাকবে না। কথাটা হয়তো সত্য। তারচেয়েও বড় সত্য, লেখকরাও এখন বই কেনেন না। বিশেষ করে কবিরা। কবিরাই বইমেলা মাতিয়ে রাখেন, তারাই সংখ্যায় বেশি, দলবল নিয়ে আড্ডা দিতে আসেন বইমেলায়। সবাই যদি সমসাময়িক লেখকদের বই কেনেন অল্প হলেও, অগ্রজদের বই কেনেন, চিরায়ত বই কেনেন রুচি ও পছন্দমাফিক তাহলে কিছুটা হলেও কুল রক্ষা হয়। সমস্যা হচ্ছে, আমরা লিখতে চাই অনেকেই কিন্তু পড়তে চাই কম মানুষই!

জাগো নিউজ: বইয়ের প্রচারণাকে কোন দৃষ্টিতে দেখেন?শফিক হাসান: বইয়ের প্রচারকে সব সময়ই ইতিবাচকভাবে দেখি। এখন চাইলেও কাগজে বইয়ের বিজ্ঞাপন দিতে পারেন না অনেকেই। কারণ বিজ্ঞাপনের পেছনে এত টাকা খরচ করার সঙ্গতি অনেকের থাকে না। এই উচ্চমূল্যের দেশে ডাল-ভাতের সংস্থান করা, মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু টিকিয়ে রাখাই যেখানে কঠিন সমস্যা। অনেকে তাই ফেসবুক প্ল্যাটফর্মটাকে ব্যবহার করেন, বিনা মূল্যে পেয়ে। কিন্তু সেখানেও কারও কারও চোখ টাটায়। ফেসবুকে কেন বইয়ের এত বিজ্ঞাপন দিতে হবে—এমন অভিযোগ তোলেন। তবে যথাস্থানে টাকা ঢেলে চালাকিপূর্ণ বিজ্ঞাপনও করেন সামর্থ্যবানরা। নিম্নমানের বইও এতে প্রচারের আলোয় উঠে আসে, অন্যদিকে সত্যিকারের বই আড়ালে পড়ে থাকে। এটাও ঠিক নয়। তবে এটাও সত্য, এই বাজারে কোনো পণ্যের প্রচারকেই রোধ করার ক্ষমতা কারও নেই। পুঁজি আপন বৈশিষ্ট্যেই জায়গা করে নেবে, হয়তো মুনাফার মুখও দেখবে। হয়তো বলছি, এ কারণে, বই এখনো সেই অর্থে ‘পণ্য’ হয়ে উঠতে পারেনি!

আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই

জাগো নিউজ: বইমেলার পাঠকের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?শফিক হাসান: পরামর্শ একটিই—আমরা যারা বইমেলায় যাই, সবাই যেন অন্তত একটি করেও হলেও বই কিনি। বই কিনলে লেখক বাঁচবেন, প্রকাশক বাঁচবেন। আর এই দুই পক্ষ বাঁচলে দেশ বাঁচবে। সুতরাং নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই বই কিনতে হবে। আর বই কেনা এমন এক বিনিয়োগ, যেখানে কোনো লোকসান নেই। কেউ যদি দুইশ’ টাকায় একটি বই কেনেন, পড়ার পর আর রাখতে না চাইলে পরিচিত বা অপরিচিত কারও কাছে আবার বিক্রিও করে দিতে পারেন। এখন অনলাইন অফলাইনসহ নানাভাবেই ব্যক্তি উদ্যোগেও বই বিক্রি হচ্ছে।

বই হচ্ছে অক্ষয়, চিরযৌবনা; বই কিনে তাই প্রকৃতপক্ষে কেউ দেউলিয়া হয় না। তবে আউলিয়া হতে পারেন! কারণ বই-ই জাগিয়ে তুলতে পারে মনুষ্যত্ব, যাবতীয় শুভবোধ! একটি ভালো বই পাঠককে জীবনের দিকে ফেরায়, মানুষমুখী করে। পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া আর কী আছে এতটা সুন্দর, এত চমৎকার—ভালোবাসার!

এসইউ/এমএস