রাজনীতি

ভিসানীতি নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের ভয়-ভীতি থাকতে পারে

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা অভিযুক্তদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্য, সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরাও রয়েছেন এর আওতায়। নতুন এ ভিসানীতি ঘোষণার পর থেকেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা গেছে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে।

Advertisement

তবে নতুন এই ভিসানীতিতে কোনো চাপ বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি মনে, করেন সমাজের উঁচুস্তরের মানুষ ও সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে এ বিষয়ে ভয়-ভীতি থাকতে পারে। কারণ তাদের যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি আছে, ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।

‘সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে একটা ভয়-ভীতি থাকতে পারে, কিংবা এ ধরনের যারা সমাজের উঁচুস্তরের মানুষ আছেন তাদের মধ্যে থাকতে পারে। কারণ তাদের ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। ওনারা অনেকে ঘুস-টুস খেয়ে দুর্নীতি করে বিদেশে বাড়ি-ঘর করেছেন। ওনাদের একটা ভয় থাকতে পারে যে ওনাদের যদি ভিসা না দেয় তাহলে বাড়ি-ঘরটা দেখভাল করবেন কীভাবে’

মার্কিন ভিসানীতিসহ বর্তমান রাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক ইসমাইল হোসাইন রাসেল।

Advertisement

জাগো নিউজ: মার্কিন ভিসানীতিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন?

ড. এ কে আব্দুল মোমেন: আমাদের দেশে নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের মাতামাতি বেশি। এর একটি কারণ আমাদের সংবাদ মাধ্যম। কারণ আমাদের সংবাদ মাধ্যম বিদেশিদের বক্তব্য শুনলেই লাফিয়ে ওঠে। বিদেশে যখন ইলেকশন হয়, আমেরিকায় যখন ইলেকশন হয় কোনো বিদেশি সাংবাদিক তাদের খবরও দেয় না। আর বিদেশি কোনো রাষ্ট্রদূত কিংবা বিদেশি সম্মানিত নোবেল লরিয়েটের আমেরিকার ইলেকশন নিয়ে কথা বলার সাহস নেই। কারণ মিডিয়া এটা ফলাও করে বলবে না। এখানে এটা একটা মজা, বিদেশিরা কিছু বললেই আপনারা (মিডিয়া) ফলাও করে বলেন।

আরেকটি হচ্ছে আমাদের দেশের মানুষের মন-মানসিকতা বিদেশিরা বললেই সে ভালো, আর দেশি লোক হলে কখনো সম্মান দেয় না। এটা বড় দুঃখজনক। এর একটি মূল কারণ বোধহয় আমাদের দৈন্য, আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা। এটার পরিবর্তন একদিনে সম্ভব নয়। এবছর ইতোমধ্যে প্রায় ৬০টি দেশে নির্বাচন হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে আরও ২৫টি দেশে নির্বাচন হবে, কোনো গল্প শুনেছেন? কোনো সরকারের রাষ্ট্রদূতরা সেই নির্বাচন নিয়ে কোনো বক্তব্য দিয়েছেন? কেউ দেননি এবং ওরা পাত্তাও দেয় না।

আরও পড়ুন>> মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে উজ্জীবিত বিএনপির মধ্যম সারির নেতৃত্ব!

Advertisement

নির্বাচনে ইলেকশন অবজারভার যাওয়া নিয়ে অধিকাংশ দেশে এমনকি আমার প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এগুলো নেই, আমেরিকায়ও নেই। ইংল্যান্ডেও এগুলো নেই, কিন্তু আমাদের দেশে একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যে নিজেদের ওপর আত্মবিশ্বাস কম। আমরা আমাদের নির্বাচন করবো। আমরা চাইবো আমাদের নিজেদের তাগিদেই স্বচ্ছ ও সুন্দর নির্বাচন। আমরা যে কাজ করছি সেটি গ্রহণযোগ্য কি না সেটা আমরা এই নির্বাচনের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করতে চাই। আমরা মানুষের উন্নয়ন করেছি কি না সেটি যাচাই-বাছাই করতে চাই। আমরা নিজের তাগিদেই এটি করবো।

‘আমরা যারা রাজনীতিবিদ আছি, আমি আমেরিকার নাগরিক ছিলাম। নাগরিকত্ব বাদ দিয়ে এসেছি। খুব কম সংখ্যক লোক নাগরিকত্ব বাদ দিয়ে স্বদেশে ফেরে। আমি মনে করি আমাদের দেশ বিনা পয়সায় আমাদের পড়িয়েছে। আমাদের দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে’

জাগো নিউজ: মার্কিন ভিসানীতির ফলে কোনো চাপ অনুভব করছেন কি?

ড. এ কে আব্দুল মোমেন: বাইরের লোকের এই যে চাপ আপনারা তৈরি করেন, আমরা কোনো প্রেশার ফিল করি না। কারণ আমরা সৎ পথে আছি, স্বচ্ছ পথে আছি। ভিসানীতি-টিতি আমাদের জন্য অপ্রাসঙ্গিক। ভিসানীতি সব দেশেরই আছে। সে যাকে ইচ্ছা তাকেই ভিসা দেয়। আর হঠাৎ করে তারা একটা ঘোষণা করলো, এটা আমাদের জন্য অপ্রাসঙ্গিক। এটা করেছে কারণ আমাদের দেশের অনেক সংখ্যক সরকারি কর্মচারী বড় বড় ব্যাংকের মালিক কিংবা ব্যাংকে চাকরি করেন, এমডি-সিইও যারা আছেন এবং যারা সিভিল সোসাইটির নেতা, আমাদের দেশে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড সিভিল সোসাইটির অনেক নেতা বিদেশি পয়সায় চলেন। ওরা টাকা দেয়, কীভাবে ওনারা খরচ করেন আমরা কিছুই জানি না।

আরও পড়ুন>> অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ভিসানীতি: উজরা জেয়া

আমেরিকায় আপনি এভাবে এক পয়সাও খরচ করতে পারবেন না, অ্যাকাউন্টিবিলিটি (দায়িত্ব) আছে। কিন্তু এনারা টাকা পান নিজেরাই খরচ করেন। কী করেন, এক আল্লাহই জানেন। তাদের ছেলেমেয়েরা সব বিদেশে। এবং এদের যদি দেখেন আপনারা যাদের সুশীল বলেন, সুশীলদের একটি বিরাট অংশ তাদের ছেলেমেয়ে বিদেশ থাকে। তারা অনেকেই আসলে পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিস্ট (সক্রিয় কর্মী)। তারা রাজনীতি করেন, রাজনীতিতে মানুষ তাদের এখন সাপোর্ট দেয় না, তাই তিনি এখন প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন বানিয়ে ফেলেন। এটি বানিয়ে তাদের বক্তব্যগুলো প্রচার করেন আর দেশ-বিদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। আমাদের দেশে যদি হিসাব করেন সুশীল সমাজ দেখবেন অধিকাংশই রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট।

‘এবছর ইতোমধ্যে প্রায় ৬০টি দেশে নির্বাচন হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে আরও ২৫টি দেশে নির্বাচন হবে, কোনো গল্প শুনেছেন? কোনো সরকারের রাষ্ট্রদূতরা সেই নির্বাচন নিয়ে কোনো বক্তব্য দিয়েছেন? কেউ দেননি এবং ওরা পাত্তাও দেয় না’

জাগো নিউজ: ভিসানীতির ফলে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

ড. এ কে আব্দুল মোমেন: আমেরিকার ভিসানীতি নিয়ে যে এজেন্ট হয় তার জন্য কোনো মাথাব্যথা নেই, সেই ভিসা অ্যাপ্লাইও করেন না। আর করলেও ইট ডাজেন্ট ম্যাটার টু হিম (তার জন্য কোনো ব্যাপার না)। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে একটা ভয়-ভীতি থাকতে পারে কিংবা এ ধরনের যারা সমাজের উঁচুস্তরের মানুষ আছেন তাদের মধ্যে থাকতে পারে। কারণ তাদের ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। ওনারা অনেকে ঘুস-টুস খেয়ে দুর্নীতি করে বিদেশে বাড়ি-ঘর করেছেন। ওনাদের একটা ভয় থাকতে পারে যে ওনাদের যদি ভিসা না দেয় তাহলে বাড়ি-ঘরটা দেখভাল করবেন কীভাবে। তারা (আমেরিকা) বলেছে যারা আগে ভিসা পেয়েছেন তাদেরও বাদ দিতে পারেন, তো এখন অনেকের ছেলেমেয়ে ওখানে থাকে, সরকারি চাকরি করলে একটা সুবিধা চোখ-মুখ খোলা হয় তখন।

আরও পড়ুন>> ভিসানীতি নয়, আমাদের চিন্তার বিষয় জনগণের নিরাপত্তা

পেপারে দেখলাম ২৯ জন সচিবের একাধিক ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকেন। বিদেশে কিন্তু থাকা খুব এক্সপেন্সিভ (ব্যয়বহুল), ইটস নট ইজি (এটি সহজ নয়)। তার মানে কত পয়সা? ওনারা কেউ কেউ হয়তো কাজ-কর্ম করে, কিন্তু কাজ-কর্ম করলেও ইট ইস নট ইজি। এদের হয়তো ভয় লাগতে পারে কী না কী হয়! আমরা যারা রাজনীতিবিদ আছি, আমি আমেরিকার নাগরিক ছিলাম। নাগরিকত্ব বাদ দিয়ে এসেছি। খুব কম সংখ্যক লোক নাগরিকত্ব বাদ দিয়ে স্বদেশে ফেরে। আমি মনে করি আমাদের দেশ বিনা পয়সায় আমাদের পড়িয়েছে। আমাদের দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। আমি আশা করবো অন্যরাও এই দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রদর্শন করবে। আমরা ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছি আমাদের স্বাধীনতার জন্য। দেশটাকে উন্নত, সমৃদ্ধশালী, স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। আমরা যদি না করি হু উইল ডু দ্যাট (কে এটা করবে)। দেশের লোকদেরই এটি করতে হবে, বিদেশিরা কখনো আপনার মঙ্গল চাইবে না।

জাগো নিউজ: ভিসানীতি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন কি?

ড. এ কে আব্দুল মোমেন: ভারতবর্ষ সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ ছিল। দুনিয়ার সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ। তারপর বিদেশিরা একের পর এক এলো, শেষে ব্রিটিশরা। দেশটাকে একেবারে ছারখার করে দিয়ে গেলো। এখনো তারা অন্যভাবে আসতে চায়, যাতে আপনার যত রকম সম্পদ আছে লুট করতে পারে। বিদেশিরা আপনার মঙ্গলের জন্য আসে না। বড় বড় ইস্যুতে বলে মানবাধিকার অমুক-তমুক, এগুলো সব ভাওতাবাজি। এটা খুবই দুঃখজনক যে আমাদের অনেক লোক এ ধরনের ভাওতাবাজির শিকার হয়।

আইএইচআর/এএসএ/এএসএম