লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের দুটি এজেন্ট আউটলের পরিবেশক মহিউদ্দিন মাহমুদ উধাও হয়ে গেছেন। এরপর কর্তৃপক্ষ তা বন্ধ করে দেয়। পাঁচদিন ধরে উপজেলার চরলরেন্স ও করইতলা বাজারের এ আউটলেট বন্ধ রয়েছে।
Advertisement
মহিউদ্দিন মাহমুদ ব্যক্তিগতভাবে চড়া সুদের আশ্বাসে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে অন্তত ৮-১০ কোটি হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার সন্ধান পাওয়া যায়নি।
এদিকে আউটলেট দুটির সামনে কার্যক্রম বন্ধের নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তারা জানিয়েছেন, মহিউদ্দিনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কোনো দায়ভার তারা নেবেন না।
মহিউদ্দিন মাহমুদ উধাও হওয়ার খবরে পাওনাদাররা প্রতিদিনই আউটলেটগুলোর সামনে ভিড় করছেন। সম্ভাব্য স্থানগুলোতেও তারা সন্ধান চালাচ্ছেন।
Advertisement
অভিযুক্ত মহিউদ্দিন উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের চরজাঙ্গালিয়া গ্রামের হাবিব উল্যাহর ছেলে। তিনি এলাকায় ‘কুতুব উল্যাহ’ নামে পরিচিত। তার মালিকানাধীন লাবিব এন্টারপ্রাইজ ও তাজ এন্টারপ্রাইজ নামের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেটগুলো পরিচালিত হতো। এরমধ্যে চর ররেন্স বাজারের আউটলেটটি মাস্টার এজেন্ট ছিল। মহিউদ্দিন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে জেলা শহরের বসবাস করতেন। চরলরেন্স এলাকার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম, আবদুস শহিদ ও তাজুল ইসলাম জানান, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আড়ালে মহিউদ্দিন সুদের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। উচ্চ সুদের লোভ দেখিয়ে বিভিন্নজনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই টাকা নিয়েই তিনি লাপাত্তা হয়ে গেছেন। এতে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চরলরেন্স বাজারের একজন কম্পিউটার ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, মহিউদ্দিনের কাছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ৭২ জনের টাকা পাওয়া রয়েছে। ওই ব্যক্তিরা তার দোকানে অভিযোগ লিখে প্রিন্ট করেছেন। এরমধ্যে ১০ হাজার থেকে ৮১ লাখ টাকার পাওনাদার রয়েছেন। সবমিলিয়ে প্রায় ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার একটি হিসাব পাওয়া গেছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম জানান, মহিউদ্দিনের উধাও হওয়ার খবরে কয়েকদিন ধরে লোকজন আউটলেটের সামনে ভিড় করছেন। তাদের সঙ্গে মহিউদ্দিনের ব্যক্তিগত লেনদেন ছিল। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসে কার্যক্রম বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দিয়েছেন। চরলরেন্স গ্রামের প্রবাসী মোসলেহ উদ্দিন বলেন, বিদেশ থেকে এসে চরলরেন্স বাজার ডাচ-বাংলার এজেন্ট শাখায় ছয় লাখ টাকার একটি ডিপিএস করেছিলেন। পরে মহিউদ্দিন তাকে প্রতিমাসে লাখে ১২০০ টাকা লাভ (সুদ) দেওয়ার প্রস্তাব দেন। একপর্যায়ে তিনি ডিপিএসের ছয় লাখ টাকা উত্তোলন করে মহিউদ্দিনকে দেন। এজন্য তার ব্যাংক হিসাবের অলিখিত চেক ও সই করা স্ট্যাম্প দেন। কয়েকমাস নিয়মিত লাভ দিয়েছেন। এরপর হঠাৎ তিনি পালিয়ে গেছেন।
চরলরেন্স গ্রামের মো. ইউসুফের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অধিক লাভের আশায় মহিউদ্দিনকে সাত লাখ টাকা দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কয়েকজন আত্মীয়ের কাছ থেকে আরও ২৩ লাখ টাকা নিয়ে মহিউদ্দিনকে দেন। কয়েকমাস সবাইকে সময়মতো লাখে এক হাজার ২০০ টাকা করে লাভও দেওয়া হয়েছিল। সব টাকা নিয়ে তিনি এখন উধাও।
Advertisement
একইভাবে চর জাঙ্গালিয়া গ্রামের হারুনের পাঁচ লাখ, জুয়েলের ১৭ লাখ, চরজগবন্ধু গ্রামের তানিয়া আক্তারের চার লাখ টাকা মহিউদ্দিনকে দিয়েছেন।
স্থানীয় জুয়েল আহমেদ জানান, এজেন্ট ব্যাংকে তার জমা রাখা টাকা ঠিক রয়েছে। তবে উচ্চ লাভের আশায় মহিউদ্দিনের সঙ্গে যারা ব্যক্তিগত লেনদেন করেছেন তারাই এখন বিপাকে পড়েছেন। তারাই আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেটের রিটেইলার জান্নাতুল ফেরদৌসী অভি বলেন, ‘২৫ সেপ্টেম্বর (বুধবার) দুপুরে মহিউদ্দিন এসে মোবাইলফোন ও ব্যাংকের কার্ড রেখে যান। ৪০ মিনিট পর অন্য ফোন নম্বর থেকে তিনি নিজের মোবাইলে কল দেন। মহিউদ্দিন বলেন, দুজন লোক কোথায় যেন তাকে নিয়ে যাচ্ছে। ঘটনাটি যেন তার ভাই হারুনুর রশিদকে জানানো হয়।’
ঘটনাটি জানতে মহিউদ্দিনের স্ত্রী শিল্পী আক্তারের মোবাইলফোনে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে মহিউদ্দিনের ভাই হারুনুর রশিদ বলেন, মহিউদ্দিনের স্ত্রী শিল্পী আক্তার অসুস্থ। তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। প্রকৃত ঘটনাটি জানার চেষ্টা করছি। ৯৯৯ নম্বরে কল দিয়ে পুলিশকে ভাইয়ের ঘটনাটি জানিয়েছি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো খোঁজ পাইনি।
কমলনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, খবর পেয়ে ওই আউটলেট এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। তবে টাকা লেনদেনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি। ঘটনাটির তদন্ত চলছে। এ বিষয়ে ডাচ-বাংলা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কমপ্লেইন ম্যানেজার মাইন উদ্দিন মিয়া বলেন, আউটলেট দুটির কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। গ্রাহকরা অন্য শাখাগুলো থেকে লেনদেন করতে পারবেন। মহিউদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে ব্যাংক চেক ও স্ট্যাম্প দিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। সে দায়ভার ব্যাংক নেবে না। ব্যাংক হিসেবে গ্রাহকদের টাকা নিরাপদ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মহিউদ্দিন কতজনের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে টাকা নিয়েছেন তা জানা নেই। এরই মধ্যে ৬০-৭০ জন্য আমাদের জানিয়েছেন। তবে কেউই ব্যাংকে টাকা রেখেছেন বলে প্রমাণ দিতে পারেননি। কমলনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বাপ্পি বলেন, মহিউদ্দিন গোপনে বিদেশ পালিয়ে গেছেন বলে শুনেছি। বিভিন্ন ব্যক্তি তার কাছে সুদের অন্তত ১০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তিনি উধাও হওয়ার পর মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে।
কাজল কায়েস/এসআর