ভ্রমণ

প্রতিশ্রুতিতেই ঝুলে আছে অপার সম্ভাবনার পর্যটন

# সাতটি ঝরনার ইজারা দিয়েছে বন বিভাগ# নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও আবাসিক সমস্যা প্রকট# উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি

Advertisement

পাহাড়-সমুদ্র বেষ্টিত অপার সম্ভাবনাময় চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার পর্যটন শিল্প। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক পাহাড়ি ঝরনা, লেক, সমুদ্রসৈকতসহ একাধিক পর্যটন স্পট। প্রতিদিন এসব পর্যটন স্পটের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন শত শত ভ্রমণপিপাসু। তবে পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তা ও থাকার ভালো ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যায় পড়তে হয় অনেককে। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে সরকার এ খাত থেকে প্রতি বছর কয়েক কোটি রাজস্ব আদায় করতে পারবে।

জানা গেছে, পর্যটন স্পটকে আরও আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ ২০১৭ সালে প্রায় ৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে মহামায়া ও খৈয়াছড়া ঝরনাকে ঘিরে দুটি প্রস্তাবিত প্রকল্প হাতে নিলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি। অবশ্য এ বিষয়ে বন বিভাগ বলছে, প্রস্তাবিত দুটি প্রকল্পের মধ্যে মহামায়া প্রকল্পটির কিছু কাজ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে খৈয়াছড়া ঝরনা প্রকল্প পরিকল্পনা বিভাগ থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। পুনরায় দুটি প্রকল্প নতুন করে মহাপরিকল্পনার আওতায় প্রস্তাব পাঠানো হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের মিরসরাই রেঞ্জের গোভানিয়া বিট এলাকায় অবস্থিত মহামায়া সেচ প্রকল্প ও বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং বড়তাকিয়া বিট এলাকার খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায় পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকারের বন বিভাগ আলাদা দুটি প্রকল্প হাতে নেয়। ২০১৭ সালে প্রস্তাবিত এ পকল্পে খৈয়াছড়া ঝরনার জন্য ছিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশ পুনরুদ্ধার ও পর্যটক টানতে ২৫ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প। মহামায়ার জন্য ছিল ঝুলন্ত সেতু, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, পিকনিক স্পট ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে ২৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার প্রকল্প। দীর্ঘ ৬ বছর ধরে দুটি প্রকল্প প্রস্তাবনার মধ্যেই আটকে আছে।

Advertisement

আরও পড়ুন: একদিনেই ঘুরে আসুন মিরসরাইয়ের বোয়ালিয়া ঝরনায়

কী ছিল খৈয়াছড়া ঝরনা প্রকল্পেপর্যটকদের জন্য পার্কিং নির্মাণ, যাতায়াতের জন্য স্থানীয় প্রতাপ নারায়ণ সড়কে মাটির কাজ, পার্কের প্রাকৃতিক বিবরণ সংক্রান্ত জরিপ কাজ, ২শ হেক্টর সাইকাস উদ্ভিদ বনায়ন, দুষ্প্রাপ্য বিপদাপন্ন দেশীয় প্রজাতির, ফলদ প্রজাতির, স্থানীয় প্রজাতি ও সৌন্দর্যবন্ধক বনায়ন ৬শ হেক্টর। প্রচার ও প্রকাশনার উদ্যোগ গ্রহণ, আবাসিক ও ফাংশনাল ভবন নির্মাণ, যাতায়াতের সড়কে ৫টি আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণ, আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল, গাইড ওয়াল, ঝরনায় যাতায়াতের সুবিধার্থে আরসিসি সড়ক ও সিঁড়ি নির্মাণ, পর্যটকদের ব্যবহারের জন্য ৫টি শৌচাগার ও ওয়াশরুম নির্মাণ, ঝরনা এলাকায় ময়লা-আবর্জনা অপসারণে পথে পথে ডাস্টবিন স্থাপন, পাহাড়ের পাদদেশে পায়ে হাঁটার পথ তৈরি, তিনতলা বিশিষ্ট পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ, প্রধান ফটক ও টিকিট কাউন্টার নির্মাণ, তথ্যকেন্দ্র, আরসিসি বেঞ্চ, ছাতা বেঞ্চ, আরসিসি প্ল্যাটফর্ম, নিরাপত্তার জন্য আরসিসি বাউন্ডারি ওয়াল, পার্কিং ও সড়কের জন্য ১৫ ডিসিম্যাল জমি অধিগ্রহণ, স্টিল স্ট্রাকচার নির্মাণ, ফুল বাগান, সাইনবোর্ড স্থাপন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে তিনটি গভীর নলকূপ স্থাপন, দুই কিলোমিটার এলাকায় বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন ও কেন্দ্রীয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন আছে প্রকল্পজুড়ে।

কী ছিল মাহামায়া ইকো-পার্ক প্রকল্পেবন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার এ প্রকল্পের আওতায় মহামায়াকে নতুন আদলে গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল। ২ হাজার একর বনভূমি ঘিরে তৈরি এ পর্যটন এলাকায় সংরক্ষণ করা হবে উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের সংযোগে স্থাপন করা হবে ২৫০ মিটার দৈর্ঘের দুটি ঝুলন্ত সেতু, প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকদের জন্য নির্মাণ করা হবে তিনতলা বিশিষ্ট পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, ৭শ মিটার দীর্ঘ সীমানা প্রাচীর, ২শ মিটার অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি সড়ক, চারটি পিকনিক স্পট, কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্র, পর্যটকদের জন্য শেড নির্মাণ ও খাবার পানি সরবরাহ, সংস্কার করা হবে প্রাকৃতিক ঝরনাগুলো, পর্যটকদের জন্য লেকের পানিতে থাকবে পরিবেশবান্ধব নৌকা, নির্মাণ করা হবে জলজ পক্ষিশালা, বাস্তবায়ন করা হবে ৫০ হেক্টর শোভাবর্ধনকারী বৃক্ষের বনায়ন, ২শ হেক্টর দেশীয় প্রজাতির ফলদ বৃক্ষের বনায়ন, ৫০ হেক্টর ওষুধি বৃক্ষের বনায়ন ও ২শ হেক্টর এলাকায় বিলুপ্ত দেশীয় প্রজাতির বনায়ন। এছাড়া দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য ট্যুরিজমের নানা সুবিধা স্থাপনে ছোট ছোট নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনাও আছে প্রস্তাবিত ওই প্রকল্পে।

অন্তহীন সমস্যাপ্রথমে ২০১৪ সাল নাগাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পায় খৈয়াছড়া ঝরনার অবয়ব। সে থেকে দেশের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটক আসা শুরু করে এখানে। বন বিভাগের হিসাব মতে, প্রতিদিন এখানে ২ হাজার পর্যটক যাতায়াত করেন। ঝরনা এলাকার পাহাড়ি নির্জন স্থানে কয়েকজন পর্যটক ছিনতাইয়ের শিকার হন। ছিনতাইয়ের শিকার হন কয়েকজন নারী পর্যটক।

Advertisement

উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক জুনু বলেন, ‘আমরাও জেনেছি খৈয়াছড়া ঝরনাকে ঘিরে বিশাল একটি প্রকল্প এখানে বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু কয়েক বছর হলো প্রকল্পগুলো আলোর মুখ দেখছে না।’

আরও পড়ুন: অপরূপ সৌন্দর্যের আরেক নাম বাওয়াছড়া

এদিকে ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেচ প্রকল্প হিসেবে উদ্বোধনের পর থেকে দেশের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটক আসা শুরু করে মহামায়া লেক এলাকায়। এরপর সরকারের বন বিভাগ এখানে স্থাপন করে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকো-পার্ক। গত কয়েক বছরের কিছু উন্নয়ন কাজ করেছে সরকারের বিভাগটি। তবে পর্যটকদের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানি, ওয়াশরুম, অবকাশ যাপন নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকায় নানামুখী সংকট এখানে বিদ্যমান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাহাড় ও সমুদ্রবেষ্টিত এ উপজেলায় আছে আট স্তর বিশিষ্ট খৈয়াছড়া ঝরনা, রূপসী ঝরনা, নাপিত্তাছড়া ঝরনা, মহামায়া ঝরনা, সোনাইছড়া ঝরনা, বোয়ালিয়া ঝরনা ও বাওয়াছড়া হরিণাকুণ্ড ঝরনা, মহামায়া লেক, বাওয়াছড়া লেক, মুহুরি প্রজেক্ট, ডোমখালী সমুদ্রসৈকত। অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রকৃতির সঙ্গে এখানকার মুখরিত জনপদ হয়ে উঠছে আরও মুখর। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত ভ্রমণপিপাসু লোকজন ছুটে আসে। কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও থাকা-খাবারের সুব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তির শিকার হতে হয় পর্যটকদের।

রাজধানী থেকে ঘুরতে আসা নাঈম, শিমুল, দেলোয়ার ও হাসান বলেন, ‘মিরসরাই উপজেলায় অনেকগুলো পর্যটন স্পট রয়েছে। আমরা অনেকগুলো ঝরনা ঘুরেছি। এখনো অনেক অব্যবস্থাপনা বিরাজমান। পাহাড়ের ভেতর পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রয়োজন। অনেক ঝরনায় যাওয়ার রাস্তা-ঘাটও ভালো না। সবচেয়ে বেশি ভোগায় থাকার সমস্যা। মিরসরাইয়ে এতগুলো পর্যটন স্পট কিন্তু কোনো রিসোর্ট কিংবা আবাসিক হোটেল গড়ে ওঠেনি।’

আরও পড়ুন: মহামায়ায় গিয়ে যা দেখবেন

তরুণ উদ্যোক্তা মো. ওমর শরীফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মিরসরাই উপজেলা পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা। সরকার যদি এসব পর্যটন স্পটে রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো উন্নয়ন করে, তাহলে পর্যটক অনেক বেড়ে যাবে। আমি বিশ্বের অনেক দেশে গিয়েছি। সেখানকার পর্যটন কেন্দ্র থেকে আমার এলাকার পর্যটন স্পটগুলো অনেক সুন্দর। শুধু উদ্যোগ প্রয়োজন। এসব পর্যটন স্পট থেকে সরকার বছরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে পারবে।’

চট্টগ্রাম উত্তর করেরহাটের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মোহাম্মদ হারুন অব রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মহামায়া ইকোপার্কে দৃশ্যমান অনেক কাজ হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে তথ্যকেন্দ্র নির্মাণ, পিকনিক স্পট নির্মাণ ও গেট নির্মাণ। চলতি বছরের মধ্যে অসম্পন্ন কাজগুলো শুরু হবে। আশা করছি আগামী বছরের মধ্যে সব কাজ শেষ করা যাবে।’

বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন চট্টগ্রামের ইউনিট ব্যবস্থাপক (উপ-ব্যবস্থাপক) মোহাম্মদ সরওয়ার উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মিরসরাই উপজেলায় অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এসব এলাকাকে ঘিরে পর্যটন কর্পোরেশনের বিভিন্ন পরিকল্পনাও আছে। আমাদের পরিকল্পনা ডিপার্টমেন্ট এগুলো নিয়ে কাজ করছে।’

এসইউ/এমএস