সাহিত্য

বাংলাদেশে অনুবাদের পারিশ্রমিক অনেক কম: শেহজাদ আমান

শেহজাদ আমানের জন্ম ১৯৮৭ সালের ২৯ অক্টোবর ভোলা জেলায়। লেখালেখির অভ্যাস থেকে সাংবাদিকতায় আছেন প্রায় এক যুগ। অনুবাদক হিসেবে পরিচিত হলেও বহুমাত্রিক লেখক হিসেবেই দেখতে চান নিজেকে। লিখছেন কবিতা ও ছোটগল্প। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই নিয়মিত পদচারণা ছিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ ও হাউজ অব ভলান্টিয়ার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। মানবাধিকার কর্মী ও সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবেও সক্রিয় আছেন।

Advertisement

দেশসেরা তরুণ অনুবাদকদের একজন হিসেবে পরিচিতি আছে তার। এ পর্যন্ত বের হয়েছে ২৩টি অনুবাদ বই। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতার বই। মৌলিক সাহিত্য নিয়েও সিরিয়াসলি এগোতে চান। সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন অনুবাদ সাহিত্যের আদ্যোপান্ত নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাশিল্পী ও গবেষক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—

জাগো নিউজ: দীর্ঘদিন অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন। আপনার অভিজ্ঞতা যদি বলতেন— শেহজাদ আমান: অসংখ্য ধন্যবাদ সুন্দর প্রশ্নের জন্য। সাহিত্য নিয়ে আমার কাজ করা শুরু হয়েছিল আসলে ২০১৪ সালে। তখন নিয়মিত কবিতা লিখে হাত মশকো করতাম। একসময় আমার বিচরণ নিয়মিত ছিল শাহবাগ, ঢাবি, কাঁটাবনের কবিদের সাথে। এরপর ২০১৬ সাল থেকে বই অনুবাদের কাজে হাত দিই। তখন আমার নিয়মিত বা ফুলটাইম কোনো চাকরি ছিল না। ইচ্ছে ছিল, অনুবাদ করে কিছু টাকা যাতে হাতে আসে। আর অনুবাদের প্রতি আগ্রহ তো অবশ্যই ছিল। সেইমতো, আমি সন্দেশ প্রকাশনীর প্রকাশক মরহুম লুৎফর রহমান ভাইয়ের সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে আইজাক আসিমভের একটা বই ‘দ্য গ্রিক-আ গ্রেট এডভেঞ্চার’ অনুবাদ করতে দেন। ব্যক্তিগত জীবনের নানান স্ট্রাগল ও ঝামেলার কারণে সেটা বের হতেও ২০১৮ সালের বইমেলা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। তবে এরপর আমার জার্নিটা স্মুথই ছিল।

অন্যধারা থেকে আমার দ্বিতীয় অনুবাদ বই বেরোয় ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে। তারপর একে একে বেরিয়েছে আমার আরও ২১টি অনুবাদ বই। আমি আরও কাজ করেছি রোদেলা, অন্বেষা, গ্রন্থরাজ্যর মতো প্রতিষ্ঠানে। যেখান থেকে বেরিয়েছে আমার মোট ৯টি অনুবাদ বই। প্রকাশকদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা এখনো পর্যন্ত বেশিরভাগই ইতিবাচক। তবে সমস্যা হলো এ অঙ্গনের কিছু প্রকাশক বড় বেশি রক্ষণশীল; তারা সাহসী পদক্ষেপ নিতে ভয় পান। আবার সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার চেয়ে কেউ স্রেফ অর্থটাকেই বড় করে দেখেন, যা অনেক ক্ষেত্রেই বাজে উদাহরণ সৃষ্টি করে।

Advertisement

আরও পড়ুন: রুদেবিশ শেকাবের অবিনশ্বর ভালোবাসা

জাগো নিউজ: এ পর্যন্ত ২৩টি বই অনুবাদ করেছেন। কেমন সাড়া পেয়েছেন পাঠকের? শেহজাদ আমান: সত্যি বলতে, পাঠকের কাছ থেকে অত্যন্ত ভালো সাড়া পেয়েছি। অনুবাদ জগতে আমার কোনো সার্কেল বা গ্রুপ নেই, ছিল না কখনো। বিশাল ভক্ত পাঠককূলও নেই। এরপরও আমার বই কিন্তু অত্যন্ত ভালো বিক্রি হয়েছে। আমার নাম বা ‘অনুবাদক শেহজাদ আমান’ বাংলায় লিখে ফেসবুকে সার্চ দিলে আমার বিভিন্ন বইয়ের ওপর প্রচুর রিভিউ পাওয়া যাবে। রকমারিতেও আমার বইগুলোতে প্রচুর পাঠক রিভিউ দিয়েছেন। এসব রিভিউয়ের ৯৫%-ই পজিটিভ রিভিউ। অর্থাৎ পাঠক ভালোবেসেই বইটির ভালো রিভিউ দিয়েছে। আমার প্রথমদিকের কয়েকটি অনুবাদ বই বাদে বাকি সবগুলো বইয়ের অনুবাদই পাঠকের মন ছুঁয়ে গেছে বলেই বুঝতে পেরেছি।

আমার অনূদিত বইয়ের ভেতর সবচেয়ে বেশি যেসব বই বিক্রি হয়েছে, সেসব হলো—সারাহ হার্ভের ‘কাইজেন’, পাওলো কোয়েলহোর ‘দ্য আর্চার’, সান জুর ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’, কোলিন হুভারের ‘ইট এন্ডস উইদ আস’, জন গ্রিনের ‘দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস’ ইত্যাদি। কাইজেন বইটির তৃতীয় মুদ্রণ বের হয়েছে প্রকাশের দশ মাসের মাথায়। এছাড়া বেশিরভাগ বইয়েরই একাধিক মুদ্রণ হয়েছে। বাংলা ভাষায় পাওলো কোয়েলহোর সর্বাধিক বই আমিই অনুবাদ করেছি (৪টি)। যেটা আমার অনুবাদ কাজের অন্যতম প্রাপ্তি বলে মনে করি। ২০১৯ সাল থেকে রকমারির বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আমার বিভিন্ন অনুবাদ বই বেস্টসেলার তালিকায় থাকছে, যেটি আমার জন্যও বড় প্রাপ্তি।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশে অনুবাদের প্রক্রিয়াটি কেমন? কোনো রীতি অনুসরণ করা হয় কি না? শেহজাদ আমান: অনুবাদ করার ক্ষেত্রে কখনো বিদেশি লেখকের বইটি প্রকাশক অনুবাদককে করতে দেন। আবার কখনো অনুবাদকই বইটি বেছে নিয়ে প্রকাশকের কাছে অ্যাপ্রোচ করেন। প্রকাশক ও অনুবাদক মিলে সম্মত হলে অনুবাদক কাজটি এগিয়ে নেন। কাজ শেষ করে প্রকাশকের কাছে জমা দেন। এরপর সেটি কয়েক দফা সম্পাদনার পর বই বের হয়। বাংলাদেশের প্রায় সব প্রকাশকই অনুবাদককে পারিশ্রমিক বাবদ ফর্মা হিসেবে টাকা দেন। সেই টাকা এককালীন বা কয়েক দফায় প্রকাশক অনুবাদককে পরিশোধ করেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর কথাসাহিত্য: আত্মজীবনী থেকে নয়াচীন

বাংলাদেশের ৯৫% অনুবাদ বই-ই অনুমতি ছাড়া বের হয়। অনুমতি নেওয়া অবশ্যই ভালো। তবে অনুবাদের অনুমতি আদায়ের প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল, সময়সাপেক্ষ এবং কখনো কখনো ব্যয়বহুল। যা বেশিরভাগ প্রকাশকের পক্ষেই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অনুমতি ছাড়া বই বের হওয়াটাকে আমি নেতিবাচক চোখে দেখি না।

জাগো নিউজ: অনুবাদের ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতি সুখপাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে?শেহজাদ আমান: অনুবাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সাধারণত ভাবানুবাদই স্ট্যান্ডার্ড। ওয়ার্ড টু ওয়ার্ড বা লাইন বাই লাইন অনুবাদ না করে মূল ভাবটা অনুবাদে ফুটিয়ে তুলতে হয়। এটি করতে পারলেই অনুবাদ সুখপাঠ্য হয়। এক্ষেত্রে ভাষা সহজ, সুন্দর ও প্রাঞ্জল হতে হবে। শব্দ নিয়ে অনুবাদককে খেলা করতে হবে। ছোট ছোট সরল বাক্য ব্যবহার করতে হবে। বিদেশি লেখকের বই কীভাবে, কী টোনে রচিত হয়েছে, সেটা ব্যাপার না। অনুবাদকের কাজ হচ্ছে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের উপযোগী করে বইটি অনুবাদ করা। তবেই অনুবাদ সুখপাঠ্য হবে।

জাগো নিউজ: ভিনদেশি সাহিত্য যে হারে অনূদিত হচ্ছে, সে হারে বাংলা ভাষার বই অনুবাদ হচ্ছে কি? শেহজাদ আমান: সেটি অবশ্যই হচ্ছে না। এটি খুবই দুঃখজনক। আমি অনেকবারই অনুভব করেছি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য গ্রন্থগুলো ইংলিশে অনুবাদ করা দরকার। এজন্য উদ্যোগ নেওয়া খুবই দরকার। সরকার, বড় বড় প্রকাশক, সবাইকে এক্ষেত্রে বড় কিছু প্রজেক্ট গ্রহণ করে ভালোমানের কিছু সংখ্যক অনুবাদককে ব্যবহার করে এই কাজ এগোতে হবে। সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া এই কাজ সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন: মুঠোফোনের কাব্য: কবিতার ভিন্ন আঙ্গিক

জাগো নিউজ: আপনার দৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্য অনুবাদের অন্তরায় কী হতে পারে? শেহজাদ আমান: অন্তরায় অনেক। প্রথমত, অনুবাদ শেখার তেমন কোনো সোর্স দেশে নেই। বেশিরভাগ অনুবাদক এক্ষেত্রে কাজ করতে করতে শেখেন, যে কারণে অনেকেরই প্রথম দিকের অনুবাদ বইয়ের অনুবাদ ভালো হয় না। দ্বিতীয়ত, দেশে কিছু অসাধু অনুবাদক প্রকাশক আছেন যারা গুগল ট্রান্সলেশন ব্যবহার করে বা অন্যের অনুবাদ বই কপি করে সমানে অত্যন্ত নিম্নমানের অনুবাদ বই প্রকাশ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি আমার অনূদিত একটি বেস্ট সেলিং আত্মোন্নয়ন বই কপি করে এক তথাকথিত অনুবাদক এ কাজ করেছিলেন। তৃতীয়ত, অনুবাদ সাহিত্যে অলিখিত গ্রুপিং দেখা যায়; কিছু অনুবাদক, প্রকাশক, সাহিত্যকর্মী, অনলাইন বুক সেলার এবং তাদের সাথের ঘনিষ্ঠ কিছু প্রভাবশালী পাঠক মিলে অলিখিত একটা গ্রুপ গড়ে তোলেন। গ্রুপ সংশ্লিষ্ট সবাইকে তারা ঢালাওভাবে প্রমোট করেন। কিন্তু সেই গ্রুপ বা গণ্ডির বাইরে তারা কাউকে গুরুত্ব দেন না বা ফ্লোর দিতে চান না। চতুর্থত, বাংলাদেশে অনুবাদের পারিশ্রমিকটা এখনো অনেক কম এবং প্রায়ই প্রকাশক পারিশ্রমিক দিতে বিলম্ব বা গড়িমসি করেন।

জাগো নিউজ: আদর্শ অনুবাদের প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে যদি বলতেন—শেহজাদ আমান: অনুবাদ একটি শিল্প; সেজন্যই একে অনুবাদ সাহিত্য বলা হয়। তাই সেই শিল্প, সেই সাহিত্যের কদর সবাইকেই বুঝতে হবে। বইয়ের বাজার সম্প্রসারণের জন্য সরকারকে অবশ্যই অনেক আন্তরিক হতে হবে। বইয়ের বাজার সম্প্রসারিত হলে অনুবাদের বাজার এমনিতেই সম্প্রসারিত হবে। শটকাটে অনুবাদ বই বের করার চিন্তা অনুবাদক, প্রকাশকদের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। অসাধু উপায়ে কপি বা গুগল ট্রান্সলেশন করে অনুবাদ বই বাজারজাত করার বিরুদ্ধে কঠোর আইন চালু করতে হবে। অনুবাদ সেক্টরে দলাদলি বা গ্রুপিং বন্ধ করে সবার মধ্যে একটি আন্তরিক, ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব রাখতে হবে। অনুবাদকদের পারিশ্রমিকটা অবশ্যই বাড়ানো দরকার এবং তা প্রদানে বিলম্ব করা যাবে না।

এসইউ/এমএস