কৃষি ও প্রকৃতি

ক্রিসপার কেস-৯ প্রযুক্তি: কৃষি উন্নয়নে নতুন সম্ভাবনা

রত্না খাতুন

Advertisement

জীবের নানা বৈশিষ্ট্য যে জিন নিয়ন্ত্রণ করে, সে কথা এখন প্রায় সবারই জানা। আর জীব যে বংশ পরম্পরায় এদের জিন যৌন জনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সন্তান-সন্তুতিতে পৌঁছে দিয়ে থাকে, সে কথা বর্তমান যুগে কারো অজানা নয়। বাবা-মা থেকে সমান সংখ্যক জিন বহনকারী সমান সংখ্যক জিন ক্রোমোজোম একত্রে জড়ো হয়ে একটি মাত্র কোষে পরিণত হয়। কোষটি বারবার বিভাজিত হয়ে এক সময় তৈরি করে ভ্রূণ। আর ভ্রূণ নানা মাত্রায় রূপান্তরিত হতে হতে এক সময় তৈরি করে জীবের একেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে জীবের নানা বৈশিষ্ট্য। জীবের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ উভয় বৈশিষ্ট্যই জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফসলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ফসলের দেহজুড়ে আছে লক্ষ-কোটি কোষ।

যে কোনো ফসলের প্রতিটি কোষেই আছে সমান সংখ্যক এবং একই রকম জিন। কারণ একটি কোষের বিভাজনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে একই জিন বহনকারী লক্ষ-কোটি কোষ। ফসলের প্রতিটি কোষই আসলে তাই সব তথ্যের ভান্ডার। কিন্তু কোষের সব জিন কখনো ক্রিয়াশীল হয় না। ফসলের বহু কোষের বহু জিন অপ্রকাশিত থেকে যায়। ফসলের নিজস্ব প্রয়োজনে এবং পরিবেশিক নানা প্রভাবের কারণে নানা রকম জিন এদের ক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট উদ্দীপনা না পেলে বহু জিন অপ্রকাশিত থেকে যায়। সব ফসলের জিনের সংখ্যা এক রকম নয়। কিন্তু ফসলের ক্রোমোজোমে বিদ্যমান মোট জিনের শতকরা ৫০ ভাগ জিনই ফসলের জীবনচক্রের মধ্যে অকার্যকর বা অপ্রকাশিত থেকে যায়। ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) একটি নিউক্লিক অ্যাসিড যা জীবদেহের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণের জিনগত নির্দেশ ধারণ করে। সব জীবের ডিএনএ-জিনোম থাকে। যদি শতকরা ১০ বা ২০ ভাগ উদ্ভিদ কোষের জিনোম পরিবর্তন করা যায়, তাহলে তা ফসল উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমাদের সোনালি আঁশ পাটের ক্রোমোজোম সংখ্যা ১৪।

বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য পাটসহ বিভিন্ন ফসলের উন্নত প্রজাতি পেতে জিনোম পরিবর্তন আবশ্যক। যা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহারের মাধ্যমে সম্ভব। ক্রিসপার কেস-৯ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি পদ্ধতি, যা জেনেটিক কোড পরিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভিদের নতুন জাত তৈরি করে। একে জিনোম এডিটিং পদ্ধতিও বলা হয়। কেস-৯ নির্দিষ্ট জিন চিহ্নিত করে এবং ক্রিসপার হলো জিন এডিটিং পদ্ধতি। এর পুরো নাম Clustered regularly interspaced short palindromic repeat। এটি কোষের মধ্যে অবস্থিত ডিএনএর একটি নির্দিষ্ট জেনেটিক সিকোয়েন্স শনাক্ত করে এবং নির্দিষ্ট জিনকে এডিটিং বা প্রতিস্থাপন করে।

Advertisement

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব পাটের ভিত গড়েছেন বঙ্গবন্ধু

মানুষের দেহে সিসিআর-৫ নামে একটি জিন আছে, যা এইচআইভি ভাইরাস আক্রমণে সাহায্য করে। এইচআইভি ভাইরাস আক্রমণ ছাড়াও সিসিআর-৫ জিন, কেউ ব্রেইন স্ট্রোক করলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে বাধা প্রদান করে। যেহেতু সিসিআর-৫ জিনটি ব্রেইন স্ট্রোক ও এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর জন্য ক্ষতিকর তাহলে ক্রিসপার কেস-৯ প্রযুক্তির মাধ্যমে সিসিআর-৫ জিনটি কেটে ফেলা যায় কি না ভাবনা থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বরে চীনের শেনজন শহরের ‘সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’র অধ্যাপক হে জিয়ানকুই নামক একজন বিজ্ঞানী ও তার সহযোগীরা ক্রিসপার কেস-৯ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানব ভ্রূণে জেনেটিক কোডিং পরিবর্তনের মাধ্যমে এইচআইভি রেজিস্ট্যান্স হিউম্যান বেবির জন্ম দেন। ১৯৮৭ সালে জাপানের একদল গবেষক ই. কলি ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএতে এক ধরনের অজানা সিকোয়েন্স দেখতে পান, যা ই. কলির জিনোমে থাকে না। বিজ্ঞানীরা এ সিকোয়েন্সের ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হন।

পরে ১৯৯০ সালে স্প্যানিশ বিজ্ঞানী ফ্যান্সিস্কো মোহিকা এককোষী অনুজীব আর্কিয়ার ডিএনএতে ব্যাকটেরিয়ার মতো সিকোয়েন্স লক্ষ্য করেন যা থাকার কথা নয়। প্যালিন্ড্রোমিক সিকোয়েন্স রিপিট হওয়ায় মোহিকা এর নাম দেন ক্রিসপার কেস-৯। তিনি ব্যাকটেরিয়া ও আর্কিয়াতে উপস্থিত সিকোয়েন্সগুলোকে কেটে একটি বায়োইনফরমেশন টুলে দেন এবং দেখতে পান ভাইরাসের ডিএনএতে ওই একই ধরনের সিকোয়েন্স। মোহিকার হাইপোথিসিস অনুযায়ী, ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএতে ভাইরাসের ডিএনএ সিকোয়েন্স মূলত ব্যাকটেরিয়ার ইমিউন সিস্টেমের অংশ।

ক্রিসপার কেস-৯ প্রযুক্তিতে এক উদ্ভিদের কোষ অন্য কোনো উদ্ভিদে স্থানান্তর করা হয় না। এটি উদ্ভিদের দেহকোষে উপস্থিত ডিএনএর মধ্যে থাকা জিনের পরির্বতন করে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী উদ্ভিদের জিনোম পরিবর্তন করে নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভিদ সৃষ্টি করা যায়। ডিএনএ শিকলের কোনো একটি নিউক্লিটাইডকে সরিয়ে সেই স্থানে আরেকটি নিউক্লিটাইড প্রতিস্থাপন করা। ডিএনএ বা জিনোম সিকোয়েন্সের কোনো একটি অংশ নতুন করে সংযোগ বা বাদ দেওয়ার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য বা পরিবর্তন আনা যায়। ফলে গাছের ফলন, গুণমান, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

Advertisement

আরও পড়ুন: স্মার্ট কৃষিকে সক্ষম করবে যেসব প্রযুক্তি

কাঙ্ক্ষিত ফসলের জাত উদ্ভাবনের জন্য ক্রিসপার কেস-৯ প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিনোম এডিটিং করার ধাপসমূহ-• এডিট করার জন্য জিন বাছাই;• টার্গেট জিনের ভেতরের পিএএম সিকোয়েন্স শনাক্তকরণ;• SgRNA ডিজাইন এবং সিন্থেসিস করা;• বাইনারি ভেক্টরের ভেতর SgRNA ক্লোনিং করা;• জেনেটিক ট্রান্সফরমেশনের মাধ্যমে উদ্ভিদের সারিতে ঢোকানো;• এডিট করা ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ পরীক্ষণ ও নিশ্চিতকরণ এবং• কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদ মূল্যায়ন ও বাছাইকরণ।এ প্রযুক্তিতে নির্দিষ্ট জিনকে কেটে ফেলে পরে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে চারা উৎপাদন করা যায়।

বর্তমানে চীন, আমেরিকা, জাপান, কোরিয়া, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে জীবপ্রযুক্তি গবেষণাগারে এ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন উদ্ভিদের জিনোম এডিটিং করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে রোগ-প্রতিরোধী জিন যুক্ত করে বা রোগ সংবেদনশীল জিন অপসারণ করে রোগ প্রতিরোধী ফসলের জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। আলুর শর্করার গুণগত মান বাড়াতে, ব্রাউন স্ট্রিক ভাইরাস রোগ প্রতিরোধী কাসাভা উৎপাদনে, পেঁপের Papaya Ring Spot virus রোগ প্রতিরোধী পেঁপে উৎপাদনে, পাউডারি মিল্ডিউ রোগ প্রতিরোধী টমেটো, পার্থেনোকার্পিক টমেটো উৎপাদনে, ক্ষরাপ্রবণ এলাকায় ভুট্টার ফলন বাড়াতে, সরিষার প্রতি সিলিকে বীজের সংখ্যা বাড়াতে, ধান ও গমের বীজের ফলন বৃদ্ধি করতে, ব্লাস্ট প্রতিরোধী ধানের সারি তৈরিতে, ধানের জাতকে লবণাক্ততা সহনশীল করতে, চালে আম্যাইলোজের পরিমাণ বাড়াতে এবং আলোক সংবেদনশীল মেল স্টেরাইল ধানের লাইন তৈরিতে ক্রিসপার কেস-৯ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে।

আমাদের দেশে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৮.৬ লাখ হেক্টর উপকূলীয় এলাকার মধ্যে প্রায় ১০.৫৬ লাখ হেক্টর এলাকা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততা কবলিত। মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এসআরডিআই) এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, শুধু লবণাক্ততার কারণেই প্রতি বছর উপকূলীয় জেলাগুলো খাদ্যশস্য উৎপাদন-বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে ৩০ লাখ টনের বেশি। এসআরডিআইয়ের হিসাব অনুযায়ী, উপকূলীয় অঞ্চলে মাঝারি থেকে খুবই তীব্র মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৮ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর। এসব জমিতে প্রতি বছর লবণাক্ততার কারণে শস্য উৎপাদন কম হচ্ছে হেক্টরপ্রতি গড়ে ৩ দশমিক ৪৮ টন করে। সব মিলিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলের জমিগুলো শুধু লবণাক্ততার কারণে ফলন হারাচ্ছে ৩০ লাখ ২৭ হাজার টনেরও বেশি। প্রতি কেজি শস্যের গড় মূল্য ৭৭ সেন্ট হিসেবে বছরে এ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩ হাজার ১২০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে পাটপণ্য প্রযুক্তির সম্ভাবনা

অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পুষ্টি প্রতিস্থাপনে ব্যয় হচ্ছে ১১৫ কোটি টাকা। দেশে প্রতি বছর শুধু উপকূলীয় জমিতে লবণাক্ততার কারণে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ৩ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা করে। ব্রি এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমির ফসল খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্রিসপার কেস-৯ প্রযুক্তির ব্যবহার এ সমস্যা থেকে মুক্তির পথ। অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২০ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ২য় প্রধান রপ্তানিখাত হলো পাট ও পাটজাত পণ্য, ৭৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাটসহ বিভিন্ন উদ্ভিদ লবণাক্ততা ও ক্ষরা সহনশীল করতে, লম্বা জাত, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং জিনগত রোগের বিরুদ্ধে এক বিধ্বংসী অস্ত্র হিসেবে ক্রিসপার কেস-৯ প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষির উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সাইটোজেনেটিক্স শাখা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।

এসইউ/এমএস