কোনো প্রকার জমি চাষাবাদ বা রোপণ প্রক্রিয়া ছাড়াই খুলনার রূপসায় কাটা ধানের শীষ থেকে ঝরে পড়া বীজ থেকে ধান উৎপাদন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন কৃষক সুলতানুর রহমান। তার এই সাফল্য দেখে তার অনুকরণে চাষাবাদ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এলাকার অন্যান্য কৃষকরা। সুলতানের কাজে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন উপজেলার কৃষি কর্মকর্তারা।
Advertisement
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার জাবুসা বিলজুড়ে কোথাও পাকা ধান নেই। পাকা ধানের সময়ও এখন নয়। চোখ যেদিকে যায় সেদিকেই রোপা সবুজ ধানের চারার সমারহ। সেই বিলের এক প্রান্তে সুলতানুর রহমানের জমিতে সোনালী ধানের ঝনঝনানি ও অপরূপ দৃশ্য নজর কাড়ছে অন্যান্য কৃষকসহ সাধারণ মানুষের। খবর শুনে দূর-দূরান্তের কৃষকরা আসছেন তার ধান উৎপাদনের গোপন রহস্য জানতে।
গত বছর উপজেলার জাবুসা গ্রামের সুলতানুর রহমান ১০ একর জমিতে বোরো মৌসুমে উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষ করেন। পাকা ধান কাটার কয়েকদিন পর ঝরে পড়া ধান থেকে চারা গজায় জমিতে। একসময় ওই চারা থেকেও ধান ফলে। কোনো প্রকার চাষাবাদ বা জমির পরিচর্যা ছাড়াই সেবছর ৯০ মণ ধান পান সুলতানুর রহমান। আশায় বুক বাঁধেন তিনি। এ বছরও তার ওই ১০ একর জমিতে ঝরে পড়া ধানে বাম্পার ফলন হয়েছে।
কৃষক সুলতানুর রহমান বলেন, গত বছর বোরো মৌসুমে ধান কাটার পর ঝরে যাওয়া ধান থেকে চারা গজায়। চাষাবাদ বা পরিচর্যা ছাড়ায় ওই জমি থেকে প্রায় ৯০ মণ ধান পাই। বিষয়টি উপজেলা কৃষি অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
Advertisement
তিনি বলেন, এ বছর কৃষি অফিসার ফরিদুজ্জামানের পরামর্শ ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিমাদ্রী বিশ্বাসের সার্বিক তত্ত্বাবধানে জমিতে ঝরে পড়া ধানের সঙ্গে আরও দুই মণ বীজ ধান জমিতে ছড়িয়ে দিই। এরপর সুন্দরভাবে ধানের চারা গজিয়ে ওঠে। পরে কিছু আগাছা পরিষ্কার করিয়ে সামান্য সার ছিটিয়ে দিই। সব মিলিয়ে ১০ একর জমিতে খরচ হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। বোরো মৌসুমে যে পরিমাণ ধান হয়েছিল, এই সময়ও কোনো প্রকার চাষাবাদ বা বাড়তি খরচ ছাড়াই প্রায় সমপরিমাণ ফলন আশা করা যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আশা করছি এ বছর কমপক্ষে সাড়ে তিনশো মণ ধান পাবো। যার বাজার দর সাড়ে তিন লাখ টাকা। এছাড়া আরও প্রায় এক লাখ টাকার খড়-কুটো বিক্রি হবে।
সুলতানুর রহমান বলেন, উফশী জাতের ব্রি ধান-৯৯ জাতের ধান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত। আমি উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে নতুন জাতের বীজ পেয়েছি। এর মধ্যে আরও দু’টি জাত রয়েছে। এগুলো হলো- ব্রি ধান-৯২ ও ব্রি ধান-৬৭। তবে কেউ যদি আমার এই পদ্ধতি অনুসরণ করে তাহলে তাকে উফশী ব্রি-৯৯ জাতের ধান চাষ করতে হবে। এতে ভালো ফলন পাবে।
উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিমাদ্রী বিশ্বাস বলেন, গত মৌসুমে ঝরে পড়া ধান থেকে চারা গজানোর খবর পেয়ে আমরা জমিতে এসে দেখি এতে ফসল আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন আমরা পরবর্তী বছর ঝরা ধান থেকে আরও ভালো ফলন কীভাবে আনা যায় সে ব্যাপারে পরিকল্পনা করি। তারই আলোকে এ বছর কৃষককে ঝরে পড়া ধানের সঙ্গে আরও কিছু বীজ ধান ও সার ছোনানোসহ আগাছা পরিষ্কার করার পরামর্শ দিই। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে যে ধান হয়েছে তা বোরো মৌসুমের চেয়ে কম না।
Advertisement
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. ফরিদুজ্জামান বলেন, কোনো প্রকার চাষাবাদ বা বাড়তি খরচ ছাড়া সহজ পদ্ধতিতে চাষি সুলতানুর রহমানের জমিতে ধান উৎপাদন হয়েছে। তার জমিতে চাষ করা উচ্চ ফলনশীল ব্রি ধান-৯৯ জাতটি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা দুই বছর আগে আবিস্কার করেন। এই জাতটি লবণাক্ততা সহিষ্ণু এবং উঁচু বা নিচু যেকোনো জমিতে চাষাবাদ করা সম্ভব। হাইব্রিডের মতো অধিক ফলনও হয়।
তিনি বলেন, সুলতানুর রহমানের ঝরা ধান চাষের এই খবর পেয়ে বিভিন্ন এলাকার কৃষক আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিচ্ছেন। তবে সুলতানুর রহমানের এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে আউশ মৌসুমে একদিকে অল্প খরচে কৃষকরা ভালো ফলন পেয়ে লাভবান হবেন অন্যদিকে দেশের খাদ্য চাহিদা মিটবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কোহিনুর জাহান বলেন, কৃষিখাতের উন্নয়নে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় বিভিন্ন প্রকল্প ও সংস্থার মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। সে আলোকে রূপসা উপজেলায় কৃষিখাতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। জাবুসার সুলতানুর রহমান ঝরে পড়া ধান থেকে যে ফসল উৎপাদন করেছেন তাতে কৃষি উন্নয়নে নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। অন্যান্য কৃষকরা জমি ফেলে না রেখে এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি চাষিরা লাভবান হবেন।
এফএ/জেআইএম