দেশজুড়ে

৩০ বছরেও স্বাস্থ্যকর্মীর পা পড়েনি রেমাক্রির দুই ওয়ার্ডে

পর্যটন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বেশ সুখ্যাতি রয়েছে বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের। ভ্রমণকারীদের কাছে এলাকাটি অতি জনপ্রিয় হলেও ওই এলাকার ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৩০ বছর ধরে বসবাস করে আসা শিশুরা বঞ্চিত শিক্ষা, চিকিৎসাসহ ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থেকে।

Advertisement

স্থানীয়রা জানায়, গত ২৫-৩০ বছরে থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউপির ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড দুটিতে মোট ১৮টি পাড়া গড়ে উঠেছে। এসব পাড়ায় ৩০০ পরিবারে প্রায় ২ হাজারেরও বেশি ম্রো, ত্রিপুরা ও মারমা পরিবারের বসবাস। যার মধ্যে অন্তত এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিশু-কিশোর। ৩০ বছর ধরে ওই এলাকায় বসবাস শুরু হলেও আজও কোনোদিন কোনো স্বাস্থ্যকর্মী পৌঁছায়নি ওই পাড়াগুলোতে, শিশুরা পায়নি সরকারি বরাদ্দের অতি প্রয়োজনীয় কোনো ভিটামিন বা রোগ প্রতিরোধক টিকা।

এমনকি গড়ে ওঠেনি কোনো সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। ফলে শিক্ষার আলোহীন, শারীরিক অপুষ্টি জনিতসহ নানা রোগ-শোকের মধ্যে বেড়ে ওঠাই যেন তাদের নিয়তি। বর্তমান যুগে দাঁড়িয়েও যেন এক আদিম যুগে বসবাস তাদের।

লইক্রি পাড়ার পাড়া প্রধান মুই তং ম্রো কারবারি জানান, প্রায় ৩০ বছর আগে ২০ পরিবারের ১০০ জন সদস্য মিলে লইক্রি পাড়া এলাকায় বসতি গড়ে তোলেন। বর্তমানে ৩৭ পরিবারের প্রায় আড়াইশো জনের বসবাস এখানে। এই ৩০ বছরের মধ্যে কোনো স্বাস্থ্যকর্মী তাদের পাড়ায় আসেনি। এত বছরের মধ্যে কোনো স্কুলও ছিল না। কোনো স্বাস্থ্যকর্মী তাদের পাড়ায় না আসায় আজ পর্যন্ত কোনো শিশুই সরকারিভাবে দেওয়া ভিটামিন-এ ক্যাপসুল বা রোগ প্রতিরোধক টিকা পায়নি।

Advertisement

তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থায় লইক্রি পাড়া এলাকায় চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও বাকি ১৭ পাড়ায় কোনো প্রকার শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নেই শিশুদের।

রেমাক্রী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড ডলুঝিড়ি পাড়ার কারবারি (পাড়াপ্রধান) চন্দ্র মোহন ত্রিপুরা ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড পান ঝিড়ি (কোয়াইং ক্ষ্যং) ম্রো পাড়ার কারবারী (পাড়াপ্রধান) কাইং ওয়াই ম্রো জানান, ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড মিলে ১৮টির বেশি পাড়ায় প্রায় ২ হাজারের অধিক জনগণের বসবাস হলেও আজ পর্যন্ত তাদের পাড়ায় কোনো ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী আসেননি। ফলে পাড়ার শিশুরা যেমন কোনো টিকা পায়নি তেমনি গর্ভবতী মায়েরাও পাননি কোনো স্বাস্থ্যসেবা কিংবা ডাক্তারি পরামর্শ। এছাড়াও এই এলাকায় কোনো স্কুল না থাকায় শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা।

রেমাক্রি ইউপির ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মানচং ম্রো জানান, এলাকাটি দুর্গম আর যাতায়াত ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে স্বাস্থ্যকর্মীরা যেতে আগ্রহী নন। যার কারণে ৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার শিশুরা কোনোদিন ভিটামিন-এ ক্যাপসুল ও টিকা পায়নি। আগামীতে এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মী নিয়ে যাওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করবেন বলে জানান তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বান্দরবান কার্যালয় হতে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি ও ভিটামিন-এ প্লাস ক্যাম্পেইনে জেলার শতভাগ শিশুকে টিকা বা ভিটামিন-এ প্রদানের কথা বলা হলেও রেমাক্রী ইউপি চেয়ারম্যান মুই শৈ থুই মারমা জানান, থানচি উপজেলার আয়তন ১০২০.৮৩ বর্গ কিলোমিটার। তার মধ্য শুধু রেমাক্রী ইউনিয়নের আয়তন ৪৯৭.৮২ বর্গকিলোমিটার যা রুমা-রোয়াংছড়ি উপজেলা থেকেও বেশি আয়তনের। ২০২২ সালের জনশুমারী অনুসারে রেমাক্রি ইউনিয়নের জনসংখ্যা ৮ হাজার ৬০০ দেখানো হলেও ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যমতে বর্তমানে এই ইউনিয়নে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। যার মধ্যে ইউনিয়নের ৬ নম্বর ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৩০০ পরিবারের প্রায় ২ হাজার জনগণের বসবাস। এলাকাটি দূর্গম ও যোগাযোগের মাধ্যম একমাত্র নৌ-পথ হওয়ার কারণে ওই এলাকার শিশুরা কখনো ভিটামিন-এ ক্যাপসুল ও টিকা পায়নি।

Advertisement

বান্দরবান সিভিল সার্জন মো. মাহাবুবুর রহমান জানান, সকল জনগণের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সদ্য যোগদানের কারণে এই এলাকার কিছু কিছু বিষয় সম্পর্কে জানা নেই। যতটুকু শুনেছি ওই এলাকাগুলো বেশ দূর্গম। তবুও সকলের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে রেমাক্রির ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দূর্গম এলাকাগুলোতে অন্তত প্রতি তিন মাস অন্তর একটি ক্রাশ প্রোগ্রামের (বিশেষ ব্যবস্থায় চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম) মাধ্যমে সেবা প্রদান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুল মান্নান বলেন, সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী যদি কেউ স্কুলের জায়গা দিতে রাজি থাকেন এবং নিয়ম অনুসারে আবেদন করেন তাহলে দুর্গম রেমাক্রী ইউপি এলাকায় শিশুদেরকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনা হবে।

এফএ/জেআইএম