অর্থনীতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির রহস্য

এটা প্রচলিত কোনো ডাকাতি ছিল না। মুখোশ পরিহিত অস্ত্রধারী ডাকাতও ছিল না। নগদ টাকার কোনো বস্তাও নিয়ে যায়নি। ফেব্রুয়ারিতে কেউ অথবা সম্ভবত একটি গোষ্ঠী নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই চোর চক্র ৮১০ মিলিয়ন অর্থ চুরি করতে সক্ষমও হয়। ব্যাংকে সাইবার চুরির ইতিহাসে এটিকে বড় ধরনের ঘটনা বলা হচ্ছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে ফিলিপাইনে ব্যবসায়ী, ব্যাংক ও দূতাবাস কর্মকর্তারা সিনেট কমিটির শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। ফিলিপাইনে এই অর্থ ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত এ ঘটনার মূল হোতাদের সম্পর্কে খুব সামান্য তথ্যই জানা গেছে। মঙ্গলবার ফিলিপাইনের এক ক্যাসিনো ব্যবসায়ী ও ক্যাসিনোর প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এটি এখনো অস্পষ্ট এই সাইবার ডাকাতি কতদিনের পরিকল্পনায় হয়েছে। তবে গত বছরের মে মাসে ফিলিপাইনের কয়েকটি অ্যাকাউন্ট এই টাকা স্থানান্তরে ব্যবহৃত হয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম শুক্রবার হ্যাকাররা এক বিলিয়ন অর্থ কয়েকটি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরের জন্য নিউ ইয়র্ক ফেডারেলে আবেদন পাঠায়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে শুক্রবার সরকারি ছুটি থাকায় রোববারের আগে পর্যন্ত অফিস বন্ধ থাকে। রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মদিবস শুরু হয়, তখন বিশাল অংকের অর্থ স্থানান্তরের জন্য ফেডারেল ব্যাংকের কয়েকটি আবেদন পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্তাব্যবস্থা সচল না থাকায়, ফ্যাক্স এবং ই-মেইলের মাধ্যমে ফেডারেল ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা। কিন্তু ওইদিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ছুটি ছিল। সুতরাং এটা পরিষ্কার বিশাল এই সাইবার ডাকাতি ঘটে ফেব্রুয়ারির প্রথম সোমবার। তবে এর মধ্যেই ৩৫ টি আবেদনে ৮১০ মিলিয়ন অর্থ হাতিয়ে নেয় হ্যাকাররা। পরে ডাচ ব্যাংক বানান ভুলের কারণে শ্রীলঙ্কায় ২০ মিলিয়ন অর্থ স্থানান্তরের আবেদন আটকে দেয়। ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের (আরসিবিসি) চারটি অ্যাকাউন্টে ওই অর্থ স্থানান্তর হয় বলে দেশটির সিনেট প্যানেল জানতে পারে দুই সপ্তাহ আগে। ফিলিপাইনে ব্যাংকের গোপনীয়তা আইন অত্যন্ত কঠোর এবং দেশটির ক্যাসিনোগুলোতেও সরকারি কড়া নজরদারির মধ্যে চললেও এতে সন্দেহজনক অর্থ স্থানান্তর ঠেকাতে কিংবা সরকারি কর্তৃপক্ষকে জানানোর বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আরসিবিসি ব্যাংকের একজন আইনজীবী জানান, ছুটি শেষে ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংক খোলার দিন মাকাতি সিটির ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মাইয়া স্যানতোস দেগুইতোকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি সতর্ক বার্তা পাঠানো হয়। ওই সতর্কবার্তায় আরসিবিসির চারটি অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর স্থগিতের আবেদন জানানো হলেও দেগুইতো সেই আবেদন উপেক্ষা করেন। ওই আইনজীবী দ্য আটলান্টিক ডটকমকে আরো জানান, উইলিয়াম গো নামে একজন ব্যবসায়ীর অ্যাকাউন্টে ওই অর্থ স্থানান্তর করেন দেগুইতো। পরে তিনি মুদ্রা-বিনিময়কারী কোম্পানি ফিলরেম সার্ভিস কর্পোরেশনের সহায়তায় ক্যাসিনোতে পাঠিয়ে দেন। তবে গো ওই অর্থ স্থানান্তর ও চুরির ঘটনায় জড়িত থাকার তথ্য সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। ফিলরেমের একজন প্রতিনিধি সিনেট প্যানেলকে জানান, অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে ম্যানেজার দেগুইতো ওই কোম্পানিকে দুটি ক্যাসিনোতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর মধ্যে ৩০ মিলিয়ন অর্থ উইক্যাঙ জু নামে এক ব্যবসায়ীর অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর হয়। ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সোলারাই ক্যাসিনোতে যায়। এছাড়া অবশিষ্ট অর্থ চলে যায় ইস্টার্ন হাওয়াই লেইজার নামের আরেকটি ক্যাসিনোয়। এই ক্যাসিনোর প্রেসিডেন্ট ক্যাম সিন অঙ। ফিলিপাইন সিনেটের ব্লু রিবন কমিটির প্রধান সের্গেই ওসমেনা দ্য আটলান্টিক ডটকমকে জানান, এখানে একজন প্রধান পরিকল্পনাকারী রয়েছে; খুব সম্ভবত এই ব্যক্তি কিম অঙ। এই সাইবার কেলেঙ্কারির জেরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেছেন। বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিউ ইয়র্ক ফেডারেলের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ইঙ্গিত দিয়েছে। এদিকে, ফেডারেল ব্যাংক বলছে, অর্থ স্থানান্তরের সব আবেদন বৈধ ছিল, সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ওইসব আবেদন করেছিল। এদিকে বার্তাসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে সিলিকন ভ্যালির বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সুতীক্ষ্ণ ধারণা ছিল হ্যাকারদের। এমনকি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হ্যাকাররা দীর্ঘদিন ধরে গোয়েন্দাগিরি চালিয়েছিল। আরসিবিসি ব্যাংকের সব ক্যামেরা ওই দিন বন্ধ ছিল। রমুআলদো অ্যাগাররাদো নামে ব্যাংকের এক কর্মকর্তা  জুপিটার শাখার ব্যবস্থাপক দেগুইতোর গাড়িতে ব্যবসায়ী গোর সহায়তায় কাগজের ব্যাগে ভরিয়ে চার লাখ মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ উঠাতে দেখেন। আরসিবিসির সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক অ্যাঞ্জেলা তোরেস ফিলিপাইনের জাতীয় দৈনিক ইনকোয়ারারকে বলেন, বুধবার সিনেটে দেওয়া অ্যাগাররাদোর বক্তব্য সঠিক নয়। কেননা ওই অর্থ কাগজের ব্যাগে নয়, বক্সে ভর্তি করে গাড়িতে তোলা হয়েছিল। এ ঘটনার সঙ্গে একাধিক অপরাধী জড়িত থাকতে পারে বলে দ্য আটলান্টিক বলছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদেনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় জড়িত দুই চীনা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মঙ্গলবার ফিলিপাইনে মামলা দায়ের করেছে দেশটির অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি)। দেশটির বিচার বিভাগে চীনের ক্যাসিনো জাঙ্কেট অপারেটর জু উইক্যাঙ এবং কাগাইয়ানের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ক্যাম সিন অঙয়ের বিরুদ্ধে ওই মামলা হয়েছে। অঙয়ের আইনজীবী ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেন, ফিলিপাইনের সিনেট কমিটির কাছে শুনানিতে অংশ নেবেন অঙ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া এই অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনা একেবারেই কম। এসআইএস/পিআর

Advertisement