মতামত

গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ শুধু দুই মাস!

রায়েরবাজার বধ্যভূমি। একাত্তরের প্রামাণ্য দলিল। সারাবছর কোনো খোঁজ নেই। খবর নেই। অক্টোবর মাস, শুরু হয়ে যায় সরকারি লোকজনদের নজরদারি। খোঁজ নাও, খবর নাও, দেখ ওখানে ঝাড়মুছের কি অবস্থা। মিডিয়ার অবস্থাও তাই। খোঁজ নেই সারাবছর। মার্চ উপলক্ষ করে জানুয়ারি, ডিসেম্বর উপলক্ষ করে অক্টোবর, শুরু হয় অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া। টেলিভিশনগুলো শুট করার জন্য ছুটে যায় এখানে ওখানে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। ১৯৭২-এ সারা দেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৩০টি, সব ধরনের পত্রিকা ও সাময়িকীর সংখ্যা ৩০০টির মতো। ২০১১ সালের হিসাবে দেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫১৮টি। আর সব ধরনের সাময়িকীর সংখ্যা ৯৪৩টি। এছাড়া ত্রিশটির ঊর্ধ্বে টিভি চ্যানেল ও অসংখ্য অনলাইন নিউজ পোর্টাল তো রয়েছেই। গণমাধ্যম মানুষের চিন্তাকে নাড়া দেয়। যা প্রকাশ পায় গণমাধ্যমে, মানুষ সেই বিষয়ে চিন্তা করে। সহজভাবে বললে, গণমাধ্যম মানুষকে প্রভাবিত করে সহজেই। এক অর্থে গণমাধ্যম যা ভাবায়, মানুষ তাই ভাবে। সে হিসেবে প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনন্য। কিন্তু সেই গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে প্রকাশ পাচ্ছে? কতোটা প্রকাশ পাচ্ছে দেখার বিষয়, ভাববার বিষয় তো বটেই।শুনতে খারাপ লাগলেও, বলতে দ্বিধা নেই, গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ মাত্র দুই মাস। কিছু মিডিয়ার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম থাকলেও প্রায় সবার ক্ষেত্রেই তাই। বাস্তবে মিডিয়াতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টিকে আমরা পাই আর সকল দিবসের মতোই একটি ইভেন্ট হিসেবে।  মার্চ, ডিসেম্বর ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রতিবেদন, মুক্তিযুদ্ধের লেখা, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা খুব একটা চোখে পড়ে না। বেশিরভাগ সম্পাদকদের ধারণা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখা পাঠক সারা বছর ‘খাবে না’। এখনও অনেক সম্পাদক, পাঠক কী ‘খাবে’ বা ‘খাবে না’ এই মানসিকতার বাইরে যেতে পারেননি। তবে কী এখনও মুক্তিযুদ্ধ মিডিয়ার কাছে ইভেন্ট নয়। ইভেন্ট যদি না-ই হবে, তবে সারা বছরজুড়ে মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করি না কেন আমরা? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। কিন্তু কেন মুক্তিযুদ্ধকে সারাবছর চেতনায় ধারণ করি না। নিয়মিতভাবে সারাবছর মুক্তিযুদ্ধের বিষয় স্থান পাওয়া গণমাধ্যমের সংখ্যা কতটি? সংখ্যাটি নেহাত সীমিত, খুবই নগন্য। এ ক্ষেত্রে চ্যানেল আই, সময়, মাছরাঙা, একাত্তর টিভির কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ বৈরী সময়েও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে।বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী নিজেও ছিলেন রণাঙ্গণের সৈনিক মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৬-এর প্রতিকূল সময়ে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের রাজনীতির অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিচিত্রার প্রচ্ছদে। ১৯৭৯-তে জামায়াত আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। শাহরিয়ার কবির ও মাহফুজ উল­াহ বিচিত্রায় প্রচ্ছদ করেছিলেন ১৯৮০-এর দিকে ‘একাত্তরে আমরা ভুল করিনি।’ ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ বই হিসেবে প্রকাশের আগে বিচিত্রায় প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হয়। কাজী নূরুজ্জামানের ‘নয়া পদধ্বনি’ও ভূমিকা রেখেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখালেখি, প্রতিবেদন প্রকাশে সেই সময়ে। যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুটি বিচিত্রাই মানুষের সামনে প্রথম নিয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বছরজুড়েই বিচিত্রা নানাভাবে বিষয় করেছিল। পরবর্তীতে সাপ্তাহিক খবরের কাগজও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নানা ধরনের লেখা প্রকাশ করে থাকে। অনলাইন নিউজ পোর্টালের মধ্যে বিডিনিউজই প্রায় সারাবছর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাধর্মী লেখা প্রকাশের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানকে জানান দেয়। প্রিন্টেট পত্রিকাগুলোতে ‘বিশেষ ক্রোড়পত্র’ বা ‘বিশেষ সংখ্যা’ বের করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি। মার্চ  ও ডিসেম্বরে প্রায় প্রতিটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপন ও বাণী ছাপানোর হিড়িকও পড়ে যায়। বিশেষ দিবসে বিশেষ সংখ্যা হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু সারাবছর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধুমাত্র দুইমাস দায়সারাভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখে কেবল স্পন্সর খোঁজার মাঝে কোন ধরনের চেতনা নিহিত রয়েছে আমার জানা নেই। তবে এক্ষেত্রে ঢালাওভাবে সব পত্রিকাকে দায়ী করা যায় না।দৈনিক পত্রিকাগুলো চাইলেই মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ধারাবাহিক অনুষ্ঠান, অনলাইনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের নানা তথ্য, প্রামাণ্য উপস্থাপনার উদ্যোগ নিতে পারে। শুধু প্রয়োজন মালিক ও সম্পাদকদের বাণিজ্যিক মানসিকতার পরিবর্তন। আমি বলছি না তারা আন্তরিক নয়। কিন্তু যে আন্তরিকতা আছে তার মাত্রা আরও বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধই বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি সারা বছর ধারণ না করা যায়, তবে কি করে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ? যে চেতনার ভিত্তিতেই আজকের বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে, গড়ে উঠছে আগামী প্রজন্ম সেই চেতনাকে তো ধারণ করতেই হবে সারা বছর। জয় বাংলার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চাই সারা বছর। মিডিয়াতে, ব্যক্তিগত জীবনেও।লেখক : উপসম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ।এইচআর/পিআর

Advertisement