#উদ্বোধনের আগে ৯০ শতাংশ কাজ শেষ করতে চায় বেবিচক#বছরে ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রী এই টার্মিনালে সেবা নিতে পারবেন#উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সামনে রেখে এখন দিনে ১০ থেকে ১২ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন#২০২৪ সালের ডিসেম্বরে টার্মিনালটি ব্যবহার করতে পারবেন যাত্রীরা
Advertisement
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ঘিরে এখন সাজ সাজ রব। চলছে উদ্বোধনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। ব্যস্ত সময় পার করছেন কয়েক হাজার শ্রমিক। প্রকৌশলীরা ব্যস্ত যান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। একটি অংশে চলছে ধোয়া-মোছার কাজ। উদ্বোধনের নানান সরঞ্জামও এনে রাখা হচ্ছে। আগামী ৭ অক্টোবর এই মেগা প্রকল্পের প্রথম ধাপের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে টার্মিনালে ফ্লাইট পরিচালনার যাবতীয় কার্যক্রম শুরুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্র জানায়, আগামী ৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় টার্মিনালের ‘সফট ওপেনিং’ করবেন। উদ্বোধনের আগে প্রকল্পের ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা হবে। বাকি কাজ (কিছু যন্ত্রপাতি স্থাপন, জনবল নিয়োগ, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং) উদ্বোধনের পর করা হবে।
রাজধানীর নিকুঞ্জের লা মেরিডিয়ান হোটেলের উত্তর পাশের একটি সড়ক দিয়ে সামনে এগোলেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প এলাকা। সরেজমিনে সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ। লেকের পাড়ের রাস্তা ধরে সামনে এগোতেই প্রথমে প্রকল্প অফিস এলাকা।
Advertisement
আরও পড়ুন>> এক্সপ্রেসওয়ে-মেট্রোতে সরাসরি যুক্ত হচ্ছে তৃতীয় টার্মিনাল
এখান থেকে অ্যাপ্রোন, হেলমেট পরে গাড়ি নিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি র্যাম্প দিয়ে সোজা টার্মিনালের দ্বিতীয় ফ্লোরে। ঢুকতেই দেখা যায়, টার্মিনালের দক্ষিণ অংশে (টার্মিনালের প্রায় অর্ধেক অংশ) টাইলস, ওপরে দৃষ্টিনন্দন নকশা, ফটক, সিঁড়ি ধোয়া-মোছা করছেন শ্রমিকরা। উত্তর অংশে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। সেখানে কয়েক হাজার শ্রমিক বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে কাজ করছেন। তাদের কেউ বৈদ্যুতিক বাতি লাগাচ্ছেন, কেউ টাইলস বসাচ্ছেন, কেউ বড় বড় যন্ত্রের সাহায্যে টার্মিনালের ছাদের অংশে দৃষ্টিনন্দন সিলিং ফিট করছেন।
টার্মিনালের সবচেয়ে উত্তরের ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, সেখানেও শ্রমিকরা কাজ করছেন। তবে দক্ষিণ অংশে (ভিআইপি, ভিভিআইপি) অংশে তেমন কর্মযজ্ঞ নেই। সেখানে সারিবদ্ধভাবে বোর্ডিং কাউন্টার, চেকিংয়ের বিভিন্ন যন্ত্র, ইমিগ্রেশন ডেক্স ধাপে ধাপে সাজানো। ফ্লোর ধোয়া-মোছা করছেন শ্রমিকরা। আর স্বয়ংক্রিয় চলমান ওয়াকওয়ে ‘মুভিং ওয়াক’, এসকেলেটর, লিফট স্থাপনের কাজও শেষ। এগুলো বারবার চালিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন প্রকৌশলীরা। এর মধ্যে এই অংশে টার্মিনালের সিলিং ও মুভিং ওয়াকওয়ে বেশি আকর্ষণীয়। টার্মিনালের ভেতর থেকে স্বচ্ছ কাচের মধ্য দিয়ে বিমানবন্দরের রানওয়েতে উড়োজাহাজ ওঠা-নামা, প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনালের উড়োজাহাজ পার্কিং দেখা যায়।
দ্বিতীয় ফ্লোর থেকে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামতেই দেখা যায়, ভিআইপি বা ভিভিআইপি অংশে উন্নত দেশের আদলে আলাদা চারটি বোর্ডিং ব্রিজ স্থাপনও করা হয়েছে। এই অংশের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রসহ বৈদ্যুতিক সবকিছু সচল। এই অংশে বাইরে বড় একটি এলইডি বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থাপনার থ্রিডি নকশার ছবির সঙ্গে ফাঁকে ইংরেজি ও বাংলায় লেখা উঠছে, ‘ওয়েলকাম বাংলাদেশ বা বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগতম।’
Advertisement
আরও পড়ুন>> বাণিজ্য বাড়াবে ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল
টার্মিনাল ভবন থেকে বের হয়ে দেখা যায়, ট্রাকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন মালামাল আনছেন শ্রমিকরা। সেগুলো বিমানবন্দরের পার্কিং এলাকায় স্তূপ করে রাখছেন। লা মেরিডিয়ান হোটেল সংলগ্ন যে রাস্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী টার্মিনালে ঢুকবেন, সে রাস্তা সংস্কারের কাজ চলছে।
সম্প্রতি জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, উদ্বোধনের আগে প্রকল্পের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ করার পরিকল্পনা আছে। এখানে প্রতিনিয়ত কাজ চলছে। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার কর্মী কাজ করছে।
তিনি বলেন, এই টার্মিনালের নির্মাণকাজ ২০২৪ সালের এপ্রিলে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তার আগেই আমরা চলতি বছর অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ করবো। বাকি সময়ের মধ্যে বিমানবন্দর পরিচালনায় যাবতীয় কার্যক্রম নেওয়া হবে।
টার্মিনাল উদ্বোধনের কতদিন পর যাত্রীরা টার্মিনাল ব্যবহার করতে পারবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মফিদুর রহমান বলেন, উদ্বোধনের দিন একটি উড়োজাহাজ তৃতীয় টার্মিনালের পার্কিং অ্যাপ্রোনে রাখা হবে। এখন ইক্যুইপমেন্টগুলো বসানোর কাজ চলছে। তবে সফট ওপেনিংয়ের পর এয়ারলাইন্সগুলো নতুন পার্কিং অ্যাপ্রোন ও ট্যাক্সিওয়ে ব্যবহার করতে পারবে। আগামী বছরের শেষ দিকে যাত্রীরা টার্মিনালটি পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারবেন।
২০১৭ সালে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি হাতে নেয় সরকার। তবে নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানি সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। বাকি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এই নির্মাণকাজ করছে জাপানের মিতসুবিশি ও ফুজিতা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং।
বেবিচক সূত্র জানায়, এখন শাহজালাল বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১ ও টার্মিনাল-২ এর অ্যাপ্রোনে ২৯টি উড়োজাহাজ রাখা যায়। ৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটার আয়তনের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে অ্যাপ্রোনে আরও ৮ থেকে ১০টি উড়োজাহাজ রাখা যাবে। ফলে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করে রাখা যাবে। নতুন টার্মিনালে ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজের ব্যবস্থা থাকবে। এর মধ্যে আগামী অক্টোবরে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ চালু করা হবে। বহির্গমনের জন্য মোট চেক-ইন কাউন্টার থাকবে (১৫টি সেলফ সার্ভিস চেক-ইন কাউন্টারসহ) ১১৫টি।
আরও পড়ুন>> অক্টোবরে একাংশ উদ্বোধন, বছরে সেবা পাবেন ১ কোটি যাত্রী
এছাড়া ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ কাউন্টারসহ বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকবে ৬৬টি। আগমনীর ক্ষেত্রে পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় চেক-ইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি কাউন্টার থাকবে। তৃতীয় টার্মিনালে আগমনী যাত্রীদের জন্য ১৬টি লাগেজ বেল্ট থাকবে। অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগেজের জন্য থাকবে চারটি আলাদা বেল্ট।
বেবিচক জানায়, থার্ড টার্মিনালের নিচতলায় থাকবে ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম। দ্বিতীয় তলায় থাকবে বহির্গমন লাউঞ্জ, ক্যানটিন ও বোর্ডিং ব্রিজ। থাকবে সুপরিসর ডিউটি ফ্রি শপ এবং বহির্গমন লাউঞ্জ।
শাহজাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য কাস্টমসের একটি হল ও ছয়টি চ্যানেল তৈরির কাজ চলমান। এর মধ্যে তৃতীয় টার্মিনালের দক্ষিণ প্রান্তে তিন হাজার ৬৫০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে ভিভিআইপি ও ভিআইপি যাত্রীদের জন্য আলাদা বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। এছাড়া গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তৃতীয় টার্মিনালের সঙ্গে বহুতল কার পার্কিং ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে ১ হাজার ৩৫০টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে।
এখন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনালে দিনে ৩০টির বেশি উড়োজাহাজ সংস্থার ১২০-১৩০টি প্লেন উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। প্রতিদিন এসব উড়োজাহাজের প্রায় ২০ হাজার যাত্রী বিমানবন্দরের দুটি টার্মিনাল ব্যবহার করেন। এ হিসেবে বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রীর সেবা দেওয়ার সুযোগ আছে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে আরও ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প সূত্র জানায়, নতুন টার্মিনাল ভবনের বহির্গমন পথে ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল বা ই-গেট থাকবে। যেখানে যাত্রীরা নিজেরাই ইমিগ্রেশন করাতে পারবেন। তাদের আর ইমিগ্রেশন পুলিশের মুখোমুখি হতে হবে না। তবে নিজেরা করতে না চাইলে তাকে সহযোগিতা করতে ৫৬টি বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টারও প্রস্তুত থাকবে। সেখানে ইমিগ্রেশন করবে ইমিগ্রেশন পুলিশ। এছাড়া যেসব যাত্রী অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে ঢুকবেন তাদের জন্য পাঁচটি ই-গেট থাকবে। পাশাপাশি থাকবে ৫৪টি অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন কাউন্টার।
তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধনের বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী জাগো নিউজকে বলেন, সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের আদলেই শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। এ টার্মিনালে বিশ্বের অন্য বিমানবন্দরের মতো সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। এখন টার্মিনালটি উদ্বোধনে আগামী ৭ অক্টোবর সময় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজনে যাবতীয় কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে।
এমএমএ/এএসএ/এএসএম