কৃষি ও প্রকৃতি

পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের এক নতুন সাফল্য

ক্যামেলিয়া কাদের

Advertisement

“পাটের গবেষণার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ এবং পাট উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে পাট সম্পদ সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে।”- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

সোনালি আঁশের সোনার দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ পাট থেকে উৎপাদিত সোনালি আঁশের দেশ হিসেবে পরিচিত। পাট বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যময় পরিবেশবান্ধব আঁশ উৎপাদনকারী অর্থকরী এবং মাঠ ফসল। পাট চাষ ও পাট শিল্পের সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাস জড়িত। যুগ যুগ ধরে বাংলার কৃষকের আর্থিক স্বচ্ছলতার শীর্ষে ছিল পাট। পাটের মাধমেই বাংলাদেশ সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে এবং কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ সম্ভবপর হয়েছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশ পাট উৎপাদন ও রপ্তানিতে বিশ্বের বুকে প্রথম স্থান দখল করেছে। এছাড়া কাঁচা পাট রপ্তানিতে দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে রয়েছে। তারপরেও বিশ্ববাজারে অতি দ্রুত বর্ধনশীল পরিবেশবান্ধব পাটপণ্যের চাহিদার পাশাপাশি রপ্তানিতেও যাতে শীর্ষস্থান দখল করতে পারে। সে জন্য মূল্য সংযোজিত প্রক্রিয়াজাতকৃত পাটপণ্য তৈরিসহ রপ্তানিতে আমাদের আরও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ছিল।

Advertisement

পাট, কেনাফ ও আঁশজাতীয় পণ্য উৎপাদনে সব সময়ই ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। কিন্তু গত চার অর্থবছরের ব্যবধানে ভারতে পাটের উৎপাদন প্রায় ৩৭ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশের উৎপাদন খুব বেশি নেতিবাচক ধারায় না থাকায় ভারতকে টপকে বিশ্বের শীর্ষ পাট উৎপাদনকারী দেশ এখন বাংলাদেশ। বৈশ্বিক পাট উৎপাদনের ৫৮ শতাংশ জোগানদাতা বাংলাদেশ। অন্যদিকে পাট, কেনাফ ও আঁশজাতীয় পণ্যের ৫৩ শতাংশের জোগানদাতা বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন: ধানের নতুন রোগ বিপিবি প্রতিরোধে করণীয় 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, এ যাবৎকালের সর্বোচ্চে পাটের উৎপাদন হয়েছিল ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে। বর্তমান অবস্থায় পরিবেশবান্ধব বস্তু হিসেবে আবারো পাটের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পাট ও পাটপণ্য শুধু পরিবেশবান্ধব ও সহজে পচনশীল নয় বরং এটি পরিবেশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে।

একদিকে সোনালি আঁশ অন্যদিকে রুপালি কাঠি মিলে অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে পাট। পাটকাঠি থেকে উচ্চমানের অ্যাক্টিভেটেড চারকোল উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। যা থেকে কার্বন পেপার কম্পিউটার ও ফটোকপির কালি, ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্ল্যান্ট, মোবাইলের ব্যাটারিসহ বিভিন্ন প্রসাধনপণ্য তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া পাট কাটিংস নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয় পরিবেশবান্ধব জুট জিওটেক্সটাইল, যা ভূমির ক্ষয় রোধক, রাস্তা নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষায় ব্যবহার হচ্ছে। পাটকাঠি দিয়ে স্বল্পব্যয়ে পেপার পাল্প তৈরি করা যায়। পাটের সুতা দিয়ে তৈরি শাড়ি, কামিজ, পাঞ্জাবি, পাপোসসহ নানা পাটজাত পণ্য ব্যাপক পরিচিত। ইতোমধ্যে বিজেআরআই’র বিজ্ঞানীরা পাট দিয়ে টিন তৈরি করেছেন এবং নাম দিয়েছেন জুটিন। ধারণা করা যাচ্ছে, এটি হবে পরিবেশবান্ধব, টেকসই এবং মানসম্মত।

Advertisement

পাট পাতা দেশের বহুল ব্যবহৃত একটি উপাদেয় শাক হিসেবে খাওয়া হয়। এ উপাদেয় শাকে আছে লাইকোপিন, যা একটি এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং যা আমাদের শরীরের কোষগুলোকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। এ শাকে আছে প্রচুর ভিটামিন সি। শুকানো পাট পাতার পানীয় চা হিসেবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিজেআরআই ২০১৬ সালে পাটের পাতা দিয়ে অর্গানিক চা উৎপাদন শুরু করে। সম্প্রতি পাটের পাতা থেকে ভেষজ গুণসম্পন্ন সবুজ চা বড় পরিসরে শুরু করতে জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে একটি কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করা হয়েছে।

আঁশ ছাড়াও কেনাফ বীজ থেকে ভোজ্যতেল এবং মেস্তার মাংসল বৃতি (শ্বাস) থেকে জ্যাম, জেলি, আচার প্রস্তুতির ব্যাপক সম্ভাবনা বিদ্যমান। জাতীয় বীজ উন্নয়ন বোর্ড ২০১০ সালে বিজেআরআই মেস্তা-২ (সবজি মেস্তা-১) একটি উন্নত মেস্তা জাত উদ্ভাবন করে, যা চুকুর হিসেবে সারাদেশে পরিচিত। চুকুরের তৈরি যে কোনো খাবার অন্যসব খাবারের তুলনায় বেশি পুষ্টিসম্পন্ন। চুকুরের তৈরি চা মানুষের উচ্চ রক্তচাপ কমায় এবং এ চা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক পরিচিত। চুকুর দিয়ে উৎপাদিত চা, জ্যাম, জেলি, আচার ইত্যাদি বাজারজাত করা গেলে পাল্টে যাবে দেশের অর্থনীতির চিত্র।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব পাটের ভিত গড়েছেন বঙ্গবন্ধু 

মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় পাটের রয়েছে বিরাট অবদান। প্রতি ১ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করলে ১৫ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং ১১ টন অক্সিজেন পরিবেশকে দেয়। এতে কার্বন পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ করে নিঃসরণ হ্রাসে পাট চাষ বিশেষ ভূমিকা রাখে। পরিবেশবিদদের মতে, একটি দেশে মোট ভূমির তুলনায় ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন। পাট একটি আঁশ উৎপাদনকারী মাঠ ফসল, যা বনভূমির ন্যায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে ভূমিকা রাখতে পারে। পাট ফসল ১০০ দিনে হেক্টর প্রতি বা তার পরিপ্রেক্ষিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করে পৃথিবীকে তার পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করে। অন্যদিকে প্রতি হেক্টর পাট ফসল ১০০ দিন সময়ে ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে।

পাটকাঠি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় পরিবেশকে বন উজারের হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করা যায়। সম্প্রতি পাট ও পাটজাত বর্জ্যের সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব পলিব্যাগ উদ্ভাবন করেছে পরমাণু শক্তি কমিশন, যা দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে মাটিতে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। পরিবেশবান্ধব সরকার ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার আইন ২০১০’ এবং ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা ২০১৩’ এর মাধ্যমে ১৭টি পণ্য যে কোনো পরিমাণ সংরক্ষণ ও পরিবহনে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। পরিবেশকে পলিথিন ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচাতে হলে আমাদের পাটের ব্যবহার সম্প্রসারণ করতে হবে।

পাট ফসলের মূল মাটির ১০-১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরিস্তরের সৃষ্টি শক্ত প্লাউপ্যান ভেঙে দিয়ে এর নিচে তলিয়ে যাওয়া অজৈব খাদ্য উৎপাদন সংগ্রহ করে মাটির ওপরের স্তরে মিশিয়ে দেয়। ফলে অন্য অগভীর মূলি ফসলের পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। এছাড়া পাট ফসল কর্তনের পর পাট গাছের গোড়াসহ শেকড় জমিতে থেকে যায়। যা পরে মিশে জৈব সারে পরিণত হয়। এতে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সময় সারের খরচ কম লাগে। এজন্য যে জমিতে পাট উৎপন্ন হয়, ওই জমিতে পরে অন্য ফসলের ফলন ভালো হয়। পাট জাগ দেওয়ার পর ছালের আঁশ ভিন্ন অন্য নরম পচে যাওয়া অংশ, জাগের ও ধোয়ার তলানি এবং পাট পচা পানি উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহার উপযোগী।

সর্বোপরি পাটই হতে পারে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের এক নতুন সাফল্য। তাই আসুন আমরা পরিবেশবান্ধব এ পাট ফসল চাষাবাদ করি। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের সোনালি ব্যাগসহ পাটপণ্যসমূহ ব্যবহারে এগিয়ে আসি। সবুজ পরিবেশ গড়ে তুলি। জীব-জগৎকে সংরক্ষণ করি।

লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ক্রপ ম্যানেজমেন্ট শাখা, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ।

এসইউ/জিকেএস