যে কোনো বিষয়ে যদি মন্ত্রী সাহেবদের জিজ্ঞেস করেন, তারা বলবেন বা বলেন, এ নিয়ে আমরা কাজ করছি। যদি সচিব মহোদয়ের শরণাপন্ন হন, তাহলে তিনি বলবেন সরকার অনেক কাজ করছেন। যদি তিনি হন জনপ্রতিনিধির স্থানীয় অংশীজন বলবেন আমাদের সরকার উন্নয়নের নিশানতুলে চলেছে। আপনাদের চোখেই পড়ে না। আর যদি পথচারীদের জিজ্ঞেস করেন, তাহলে শুনবেন প্রকৃত সত্য।
Advertisement
ঢাকার ফুটপাতগুলো কি মানুষের চলাচলের জন্য নাকি দোকানিদের অস্থায়ী মালসামানা রাখার জন্য? আমরা হাঁটবো কেমন করে। কতো কষ্ট করে আর কতো বিপজ্জনক ফুটপাতের গর্ত, ঢাকনাবিহীন নর্দমা টপকে হাঁটতে যে হয়, তা যদি আপনারা জানতেন (আমরা জানি, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন না) তাহলে ঢাকার মানুষের হাঁটাচলা নিয়ে ফুটপাত আছে কি নেই, তা জানতে চাইতেন না।
আসলেই কি আমরা ঢাকার ফুটপাত নিয়ে আমাদের ক্ষোভ কি প্রকাশ করি? করি না, তা নয়। আমরা সিটি করপোরেশনকে গালি দিই তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে। এমনকি সরকারের কথাও টেনে এনে অনেক জানা অজানা তথ্যের উপস্থাপন করি। দুঃখ ঝেড়ে আবারো হাঁটতে থাকি সেই অনিরাপদ ও দখল হয়ে যাওয়া ফুটপাতে। কেননা, আমাকে যে প্রতিদিনই গন্তব্যে যেতে এবং ফিরে আসতে হবে।
এই যে মহানগরী ঢাকার রূপ চেঞ্জ করার পরিকল্পনামাফিক নানান রকম সড়ক, উড়ন্ত সড়ক পাতাল রেল এলিভেটেড রোড ও রেলপথ, আন্ডার পাস ওভার পাস নির্মাণ চলছে, কিন্তু কোথাও কি প্রশস্ত ফুটপাত নির্মাণ হতে দেখেছন? এমনকি অভিজাত এলাকা বলে খ্যাত গুলশান বনানীতে কিছ ফুটপাত থাকলেও তা প্রয়োজনের চেয়ে যৎসামান্য। এবং বেসরকারি হাউজিং প্রকল্পের ভেতরের সড়কেও নেই ফুটপাত। ফলে যে পথে গাড়ি চলে, রিকশা ও টেম্পোসহ অসংখ্য তিন চাকার ছোট যানবাহন চলছে, সেই পথেই পথচারীরা গা বাঁচিয়ে, জান বাঁচিয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটছে।
Advertisement
একটি গবেষামূলক রিপোর্টে কিছু তথ্য পাওয়া গেলো। দেখা যাক, সেখানে ফুটপাতের অবস্থা কেমন সেটা লেখা হয়েছে। ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন যত মানুষ চলাচল করে, তার উল্লেখযোগ্য অংশই হেঁটে গন্তব্যে যায়। বর্তমানে প্রতিদিন নগরবাসী এক স্থান থেকে আরেক স্থানে গড়ে ৪ কোটি ২০ লাখ বার যাতায়াত (ট্রিপ প্রডিউস) করে। এ যাতায়াতের ২০ শতাংশই ঘটে পথচারী চলাচলে। এমন চিত্র উঠে এসেছে ২০১৫-২০৩৫ সালের জন্য প্রণীত সরকারের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি)। তবে বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন পথচারী চলাচলের এ হার প্রায় ৩০ শতাংশ। এ দুই হিসাব আমলে নিয়ে দেখা যায়, রাজধানীতে প্রতিদিন এক কোটি বা তারও বেশিবার হেঁটে যাতায়াত করে পথচারী। রাজধানীর যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের যত বিনিয়োগ রয়েছে তার মধ্যে এ এক কোটি পথচারীর জন্য বরাদ্দ মাত্র দশমিক ২৪ শতাংশ।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর যাতায়াত ব্যবস্থায় পথচারীদের জন্য নেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। ফুটপাথ যা আছে তার বেশির ভাগই হয় অবৈধ দখলে, নয়তো ব্যবহার অনুপযোগী। অধিকাংশ ফুটপাত ও পথচারী পারাপারের জায়গাগুলো ভীষণ রকমের অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। পর্যাপ্তসংখ্যক ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস ও ওভারপাস যেমন নেই, তেমনি এসব অবকাঠামোর গুণগত মান এবং অবস্থান নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাগুলোও পথচারীবান্ধব নয়। পথচারীর জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে তা তুলনামূলক যৎসামান্য। আবার প্রধান সড়কগুলোয় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভারের মতো অবকাঠামো তৈরি করতে গিয়ে সংকুচিত করে ফেলা হচ্ছে পথচারীদের হাঁটার পথ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তথ্য বলছে, ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন যত মানুষ চলাচল করে, তার ৩০ শতাংশ হেঁটে গন্তব্যে যায়। আর প্রতিদিন অন্তত আড়াই কিলোমিটার হাঁটে ৩৫-৪০ শতাংশ সড়ক ব্যবহারকারী। যদিও যোগাযোগ অবকাঠামোগুলো পথচারীবান্ধব না হওয়ায় পথচারীরাই দুর্ঘটনায় পড়ে বেশি। ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ৭১ দশমিক ৭২ শতাংশ পথচারী।
আমরা ঢাকা মহানগরে পরিচ্ছন্ন দখলমুক্ত হাঁটার উপযোগী ফুটপাত চাই। এই দাবি গণদাবি এটা মনে রাখতে হবে। যতগুলো কর্তৃপক্ষ এই সড়ক ও ফুটপাত নির্মাণের জন্য, তাদের মধ্যে সেতু ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়ই বেশি। কিন্তু ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মহোদয় প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের দমনে ও দলনে যতটা তৎপর, তার ১০ শতাংশও যদি সড়ক ও ফুটপাত নির্মাণে উৎসাহী হতেন, তাহলে এই মহানগরের গরিব গোবেরো মানুষেরা অনেকটাই আশার আলো দেখতে পেতো।
Advertisement
যারা বাসে বা অন্য যানবাহন ব্যবহার করেন, তাদের চেয়ে কি খুবই কম পথচারীর সংখ্যা? মোটেই না। তারপরও সড়ক নির্মাণ, সড়ক প্রশস্তকরণ, ফ্লাইওভার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, বিআইটি প্রভৃতি উচ্চ সুবিধার যাতায়াত ব্যবস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছেন সরকার তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, তার চেয়ে কতো কম টাকা ব্যয় করছে পথচারীদের হাঁটার জন্য, সেটা তুলনামূলক আলোচনা বা চিত্র দেখে বোঝা যায়।
আরএসটিপি ও বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের হিসাবের গড় করলে এ মহানগরে মিনিমাম ১ কোটি মানুষ হেঁটে গন্তব্যে যাওয়া আসা করে। প্রতিদিন প্রায় আড়াই কিমি হাঁটে ৩০/৩৫ শতাংশ মানুষ। ঢাকার পথ পথচারীবান্ধব না হওয়ার পরও এই বিপুল পরিমাণ মানুষের জন্য অবকাঠামো বা ফুটপাত নির্মাণের ব্যয় মাত্র শূন্য দশমিক ২৪ শতাংশ। তার মানে ওই পরিমাণ অর্থ কোনোভাবেই উন্নয়নের জন্য যৎসামান্যও নয়।
আবার বিদ্যমান ফুটপাত উদ্ধার করে পথচারীদের ব্যবহারের জন্য নিরাপদ করবে তারও কোনো আয়োজন নেই। অর্থাৎ সরকারের উন্নয়ন উর্বর মস্তিষ্কে ফুটপাতের কোনো ছবি/ছাপ নেই। ফলে ওই খাতে তারা কোনো ব্য়য় বরাদ্দ রাখার কথা ভাবেন না। এই যে উন্নয়নের চিন্তা ও পরিকল্পনাকে কেবল সড়কে গাড়ি চলাচলের কথা ভাবছেন, এই মহানগরীর কতো জনকে তারা পরিবহন করতে পারবেন? এই চিন্তাভাবনার ডালপালা ধরে আলোচনা করলে বোঝা ও চেনা যায় রাজনীতিক ও রাজনৈতিক সরকারের জনবান্ধব সাংস্কৃতিক চেতনা। অর্থাৎ তারা যতোটা না জনবান্ধব, তার চেয়ে শতগুণ বেশি উন্নয়ন প্রচারণায় মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্যের তাবেদার।
এটা আরও বোঝা যায় যখন মেট্রোরেলের একটি লাইনের কয়েক কিলো পথ তৈরির পরই তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করানো হয়। একই ঘটনা ঘটেছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নিয়েও। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ওই বাস র্যাপিড ট্রানজিট এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরই মাননীয়াকে দিয়ে উদ্বোধন করানো হলো। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে তো আর শেষ নয়, তাহলে এই অসমাপ্ত অংশ কেন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হলো?
আবার বিআরটির আরও একটি প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা আছে, যার কাজ এখনো শুরু হয়নি। এই যে হাফহার্টেড বা কোয়ারটারহার্টেড কাজ শেষ করেই তা খুলে দিয়ে চলাচলকারীদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা টিভিতে দেখানো হচ্ছে, ওই যাত্রীরা অবশ্যই জনগণের অংশ কিন্তু তাদের চেয়ে ৯৯ শতাংশ মানুষ জানেই না যে ঢাকায় কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে এবং সেই টাকাটা তাদেরই ঘাড়ের তুলে দেওয়া বৈদেশিক ঋণে।
‘সাসটেইনেবল ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্টস ফর ঢাকা সিটি’ শীর্ষক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার অংশীজনদের জন্য বর্তমানে সরকার যত ব্যয় করছে, সেখানে পথচারীর জন্য বরাদ্দ মাত্র দশমিক ২৪ শতাংশ।
রাজধানীতে ছয়টি মেট্রোরেলের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে সরকার। আরএসটিপির হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় মোট ট্রিপের ৮ শতাংশ বহনে সক্ষম হবে মেট্রোরেল। এ মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য ব্যয় হচ্ছে ২৬৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা ঢাকায় যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে চলমান বিনিয়োগের ৬২ দশমিক ৬৬ শতাংশ বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত একটি বাস র্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) কাজ চলমান। আরেকটি বিআরটি রয়েছে পরিকল্পনাধীন অবস্থায়। এ দুই বিআরটি ঢাকায় মোট ট্রিপের ৪ শতাংশ বহন করতে সক্ষম হবে। বিআরটি দুটি নির্মাণে খরচ হবে ২৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা ঢাকায় চলমান বিনিয়োগের ৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। (ব.বা/২০ সেপ্টেম্বর,২৩)
কত টাকা আর কত লোক ওই সব ব্যয়বহুল সড়ক ব্যবহার করবে, তার চিত্র তো আমাদের গবেষকরা দেখাচ্ছেন। অথচ ওই ডেভেলপমেন্টের এক কিয়দংশও যদি সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও অবিচ্ছিন্নভাবে হাঁটার জন্য ফুটপাত নির্মিত হতো, তাহলে গরিব মানুষদের জন্য তা হতো খুবই ভালো একটি পদক্ষেপ পরিকল্পনা। হতো তা ব্যালান্স একটি পরিকল্পনাও। আবার ওই সব ট্রেন, বাসে যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, তা গরিবের জন্য অনেক বেশি। বাস র্যাপিড ট্রানজিটে যাতায়াতের জন্য এতো বেশি ভাড়া অবিবেচকের মতো। গণমানুষ বহন করতে পারে, এমন পরিমাণ নির্ধারণ করাই হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রধান দায়িত্ব।
আমরা ঢাকা মহানগরে পরিচ্ছন্ন দখলমুক্ত হাঁটার উপযোগী ফুটপাত চাই। এই দাবি গণদাবি এটা মনে রাখতে হবে। যতগুলো কর্তৃপক্ষ এই সড়ক ও ফুটপাত নির্মাণের জন্য, তাদের মধ্যে সেতু ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়ই বেশি। কিন্তু ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মহোদয় প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের দমনে ও দলনে যতটা তৎপর, তার ১০ শতাংশও যদি সড়ক ও ফুটপাত নির্মাণে উৎসাহী হতেন, তাহলে এই মহানগরের গরিব গোবেরো মানুষেরা অনেকটাই আশার আলো দেখতে পেতো।
যে সব আশা আর স্বপ্ন রচনা করে আমরা বেঁচে আছি, তার কিছু অংশ তারা মেহনতি, খেটে খাওয়া রোজগেরে মানুষের জন্য চিন্তা করাটাই রাজনীতিকদের পবিত্র দায়িত্ব। সেই দায়িত্বের বিষয়টি কি রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রীরা ভুলে গেছেন?
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম