>>পাউবোর তালিকাভুক্ত নদী ৩৩টি >> তালিকার বাইরে রয়েছে আরও নদী >> অনেক খরস্রোতা নদীও বিলুপ্তির পথে
Advertisement
বর্ষণমুখর দিনগুলোতে যখন চারদিক পানি থৈ থৈ করে তখনও পঞ্চগড়ের বেশিরভাগ নদীতে পানির দেখা মেলে না। একসময়ের খরস্রোতা এসব নদী এখন বিলুপ্তির পথে। জেলার বিভিন্ন নদীর বুক চিরে জেগে উঠেছে ফসলের মাঠ। বছরজুড়ে এসব নদীতে ধান ও বাদাম চাষ করা হচ্ছে।
পঞ্চগড় নদীমাতৃক অঞ্চল। এখানে ছোট-বড় অনেক নদী ছিল। নদীকেন্দ্রিক অনেকের জীবন-জীবিকা ছিল। কিন্তু এখন খোঁজ করতে গেলে সব নদী পাওয়া যাবে না। অনেক নদী দখল হয়ে গেছে। কোথাও আবার গোটা নদী এলাকায় আবাদ করা হচ্ছে।
সরকারি তথ্যে পঞ্চগড়ে তালিকাভুক্ত ৩৩টি নদীর কথা বলা হলেও বাস্তবে জেলার নদীর সংখ্যা নিয়ে ব্যাপক গরমিল রয়েছে। স্থানীয় নদী গবেষক ও পরিবেশবিদদের দাবি, পঞ্চগড়ে ৩৩টি নয়; আরও বেশি নদী রয়েছে। অনেক নদী তালিকাভুক্ত করা হয়নি। আবার অনেকের দাবি, কালের বিবর্তনে নদীর সংখ্যা কমে গেছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি নদী।
Advertisement
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পঞ্চগড়ে বিভিন্ন নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের অভ্যন্তরে। তেঁতুলিয়া উপজেলা হয়ে এসব নদী পঞ্চগড়ে প্রবাহিত। এরমধ্যে মহানন্দা, করতোয়া, ডাহুক, রণচণ্ডি, তীরনই অন্যতম। তেঁতুলিয়ার একসময়ের প্রমত্তা বেরং নদী এখন মৃতপ্রায়। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দাবি, নদীটির দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৫০ মিটার। কিন্তু বর্তমানে এর দৈর্ঘ্য ৮ মিটার এবং প্রস্থ ১০-১৫ মিটারের বেশি হবে না। এ নদীতে এখন সারা বছর ধানচাষ করা হয়।
আরও পড়ুন: সংজ্ঞা জটিলতায় দেশের বেশির ভাগ নদীই আজ ধ্বংস: বাপা
বেরং নদীর উৎসমুখ ভারতের দার্জিলিং জেলায়। কয়েক বছর আগেও বেশ পানি ছিল বেরং নদীতে। পানি সেচকাজে ব্যবহার করতে স্থানীয় এলজিইডি নদীতে একটি স্লুইস গেটও নির্মাণ করে। খনন করা হয় নদী। কিন্তু বর্তমানে নদীটি দিয়ে সরু ড্রেনের মতো পানি প্রবাহিত হয়।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকা দিয়ে বয়ে চলা তেঁতুলিয়া উপজেলার মহানন্দা নদীতেও তেমন পানিপ্রবাহ নেই। প্রায় ১৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মহানন্দা নদীর উত্তর-পশ্চিমে ভারতের বাঁধ নির্মাণের ফলে তাদের প্রয়োজনে পানি ছেড়ে দেয়। আবার ইচ্ছা হলে আটকে রাখা হয়। এসব কারণে জেলার বেশিরভাগ নদী এখন বিলুপ্তির পথে। শুধু তাই নয়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে গেছে তেঁতুলিয়া উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায়।
Advertisement
বেরং নদীর মতো পরিণতি হয়েছে জেলার ছোট-বড় সব নদীর। একসময়ের প্রবাহমান তীরনই, চাওয়াই, ভেরসা, তালমা, টাঙন, ডাহুক, নাগর নদীসহ অন্য নদীগুলো শুকিয়ে গেছে। কোথাও দখল, কোথাও বালু ও পাথর উত্তোলনের ফলে নদীর গতিপথ বদলে গেছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, পঞ্চগড়ে তালিকাভুক্ত নদীর সংখ্যা ৩৩টি। এরমধ্যে ৮-১০টি নদীর উৎসমুখ ভারতের অভ্যন্তরে। উৎসমুখে ভারতের তিস্তা-মহানন্দা, গজলডোবা ও ফুলবাড়ী ব্যারেজ নামে বাঁধ নির্মাণ এবং একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে বছরজুড়েই পানিশূন্য থাকে জেলার বেশিরভাগ নদী। বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকা দিয়ে বয়ে চলা তেঁতুলিয়া উপজেলার মহানন্দা নদীতেও তেমন পানিপ্রবাহ নেই। প্রায় ১৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মহানন্দা নদীর উত্তর-পশ্চিমে ভারতের বাঁধ নির্মাণের ফলে তাদের প্রয়োজনে পানি ছেড়ে দেয়। আবার ইচ্ছা হলে আটকে রাখা হয়। এসব কারণে জেলার বেশিরভাগ নদী এখন বিলুপ্তির পথে। শুধু তাই নয়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে গেছে তেঁতুলিয়া উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায়। কৃষির পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব।
আরও পড়ুন: আড়িয়াল খাঁ নদের তীর সংরক্ষণ-ড্রেজিং ব্যয় বাড়লো সাড়ে ১৪ কোটি টাকা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেলার অভ্যন্তরে প্রবাহিত ১০টি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও এগুলো স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকাভুক্ত নয়। ঘোড়ামারা, চিলকা, টাঙন, যমুনা, রণচণ্ডী, সিংগিয়া, রসেয়া নদীসহ জেলার ৩৩টি নদী সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত হলেও এর বাইরে আরও নদী রয়েছে।
আমাদের বাড়ির পাশেই করতোয়া নদীতে একসময় বেশ পানি ছিল। আমরা মাছ ধরতাম, গোসল করতাম। নদীর পানি সেচসহ অনেক কাজে লাগতো। এখন নদী থেকে বালু আর পাথর উত্তোলন করা হয়। কোথাও আবার গোটা নদীতে ধান আবাদ হয়। যে যার মতো করে দখল করে আবাদ করছে।
ভারত থেকে বেয়ে আসা মহানন্দা, করতোয়া, ডাহুক, তীরনই, রনচণ্ডী নদীর মধ্যে মহানন্দা নদী বাংলাদেশ ও ভারতে সীমানা ছুঁয়ে আবারও তেঁতুলিয়া উপজেলা হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। এছাড়া বেশিরভাগ ছোট-বড় নদী বিভিন্ন স্থানে করতোয়া নদীতে মিশেছে। করতোয়া নদী পঞ্চগড় থেকে দিনাজপুর হয়ে বগুড়ায় বয়ে গেছে। এ নদীর তীরে গড়ে উঠেছে পঞ্চগড় জেলা শহর। তবে করতোয়া ও ডাহুক নদী থেকে অব্যাহত পাথর ও বালু উত্তোলনের ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বদলে যাচ্ছে। করতোয়ার শহর অংশ দখল এবং ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নদীর পানিপ্রবাহ।
তেঁতুলিয়ার ডাহুক নদী দখল করে স্থাপনা করা হয়েছে। সদর উপজেলার তালমা নদীও দখল করে ভরাট করা হয়েছে। এ নদীতে একটি রাবার ড্যাম (বাঁধ) বসানো হলেও ড্যামটি কৃষকের কাজে আসে না। বোদার পাথরাজ নদটি বিভিন্ন স্থানে দখল হচ্ছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীতে।
আরও পড়ুন: বিএসএফের বাধা, ফেনী নদীতে বসানো যাচ্ছে না ব্লক
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আজহারুল ইসলাম জুয়েল জাগো নিউজকে বলেন, পঞ্চগড়ের বিভিন্ন নদী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় নেই। বর্ষায় পানি থাকে এমন কয়েকটি নদীর মধ্যে রয়েছে তেঁতুলিয়ার বুড়াবুড়ি এলাকার পাইকানি নদী, অমরখানা এখাকার শালমারা নদী, উপজেলা সদরের হাড়িভাসা ইউনিয়নে আত্রাই, বোদা বাজারের ঝিনাইকুড়ি নদী। এগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় নেই। এর বাইরে আমাদের প্রচেষ্টায় বোদা উপজেলার সাকোয়ার হাতুড়ি নদী বছরদুয়েক আগে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, পঞ্চগড়ে নদীর সঠিক পরিসংখ্যানে গরমিল রয়েছে। আমরা চাই পঞ্চগড়ে নদী নিয়ে সঠিক একটি জরিপ হোক। তালিকার বাইরে থাকা নদীগুলো তালিকাভুক্ত না করলে দখলের মাধ্যমে বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ময়দানদীঘি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রভাষক এবং পরিবেশবিদ শেখ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘পঞ্চগড় নদীমাতৃক অঞ্চল। এখানে ছোট-বড় অনেক নদী ছিল। নদীকেন্দ্রিক অনেকের জীবন-জীবিকা ছিল। কিন্তু এখন খোঁজ করতে গেলে সব নদী পাওয়া যাবে না। অনেক নদী দখল হয়ে গেছে। কোথাও আবার গোটা নদী এলাকায় আবাদ করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, কালের বিবর্তনে অনেক সময় নদীও হারিয়ে যায়। সেগুলো আর নদী থাকে না। তবে সরকারিভাবে এসব নদী চিহ্নিত করে দখলমুক্ত করা উচিত। খননসহ এসব নদী আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করা দরকার।
আরও পড়ুন: ইছামতীর তীরে ২০০ বছরের পুরোনো নৌকার হাট
তেঁতুলিয়ার ভজনপুর এলাকার করতোয়া পাড়ের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের বাড়ির পাশেই করতোয়া নদীতে একসময় বেশ পানি ছিল। আমরা মাছ ধরতাম, গোসল করতাম। নদীর পানি সেচসহ অনেক কাজে লাগতো। এখন নদী থেকে বালু আর পাথর উত্তোলন করা হয়। কোথাও আবার গোটা নদীতে ধান আবাদ হয়। যে যার মতো করে দখল করে আবাদ করছে।’
এ বিষয়ে কথা হয় পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের তালিকা অনুযায়ী জেলায় ছোট-বড় ৩৩টি নদী রয়েছে। এরমধ্যে ১০-১২টি নদীতে পানিপ্রবাহ রয়েছে। তবে সম্প্রতি নদী খননের ফলে করতোয়াসহ বেশ কয়েকটি নদীতে পানিপ্রবাহ বেড়েছে। এসব নদীতে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের তালিকার বাইরে আরও নদী থাকতে পারে। এজন্য নদীর প্রকৃত তালিকা নিয়ে আমরা কাজ করছি। কাজ শেষে নদী নিয়ে যথাযথ পরিসংখ্যান দেওয়া যাবে।
এসআর/এসএইচএস/জেআইএম