জাতীয়

রেলে যুক্ত হচ্ছে আরও পণ্যবাহী কোচ, লক্ষ্য আয় বাড়ানো

প্রতি বছরই বাংলাদেশ রেলওয়েকে কোটি কোটি টাকার লোকসান গুনতে হয়। নিয়মিত ভ্রমণসহ ঈদ ও বিভিন্ন উৎসবে যাতায়াতের জন্য মানুষের প্রধান পছন্দ রেলপথ। ট্রেনে ভ্রমণে টিকিট পেতে যাত্রীদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। এরপরও বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনে আসছে ব্রিটিশ আমলে চালু দেশের জনপ্রিয় এই গণপরিবহন ব্যবস্থা।

Advertisement

শুধু মানুষের যাতায়াতই নয়, বাংলাদেশে সড়কপথের যোগাযোগ ব্যবস্থার মান যখন ভালো ছিল না, তখন দাপ্তরিক চিঠিপত্র বা মালামাল পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম ছিল রেলওয়ে। গ্রাম থেকে শহরে বা শহর থেকে গ্রামে সহজে ও দ্রুত পণ্য পরিবহনের জন্য বিশেষ মেইল ট্রেন চলাচল করতো। সীমিত রেলপথ, অল্প কিছু ট্রেন থাকায় মানুষের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সবাই যাতায়াত করতে পারতেন না। তবে তখন থেকেই প্রতিটি ট্রেনে মালামাল পরিবহনে একটি করে আলাদা লাগেজ ভ্যান (পণ্যবাহী কোচ) থাকতো।

রেলের আয়ের অন্যতম এবং লাভজনক উৎস ছিল পণ্য পরিবহন। লাগেজ ভ্যান সংকটে সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে না পারা, পণ্য পরিবহন উপযোগী বগি না থাকার পাশাপাশি উন্নত সড়ক যোগাযোগ, বিমান, নৌপথসহ আধুনিক বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস চালুর পর রেলের আয়ের অন্যতম এই সেবা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকেন দেশের মানুষ। কমতে থাকে রেলে পণ্য পরিবহনের আয়। তবে রেলের লোকসান এড়িয়ে আয় বাড়াতে পণ্য পরিবহনের জন্য ২০১৭ সালে ‘রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন’ প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। এতে প্রতিটি ট্রেনে একটি করে বগি বা লাগেজ ভ্যান যুক্ত করতে ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কিনছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে ৭৫টি লাগেজ ভ্যান এসেছে।

রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর) প্রথমে ২০টি লাগেজ ভ্যান যুক্ত হচ্ছে। আরও ২০টি লাগেজ ভ্যান কমিশনিংয়ের পর্যায়ে রয়েছে। রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এসব লাগেজ ভ্যান উদ্বোধন করবেন।

Advertisement

আরও পড়ুন>> পণ্যপরিবহনে রেলে যুক্ত হবে ১৫০টি লাগেজ ভ্যান

রেলের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রীবাহী আন্তঃনগর ট্রেনে পণ্য পরিবহন সেবার জন্য প্রতিটি ট্রেনে একটি করে লাগেজ ভ্যান যুক্ত হবে। কম সময়ে স্বল্প খরচে প্রান্তিক এলাকায় পৌঁছে যাবে মালামাল। এতে বাড়বে রেলের আয়।

রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন রেলপথের দূরত্ব ও মালামাল পরিবহনের ওপর নির্ভর করছে কেমন আয় হবে। তবে শুরুতে কম হলেও যতই এটির ব্র্যান্ডিং হবে ততই এর আয় বাড়তে থাকবে।

লাগেজ ভ্যানের বর্তমান অবস্থা

Advertisement

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে রেলের ৪১টি মিটারগেজ ও ১০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান রয়েছে। রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। পণ্য পরিবহন ও যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে আধুনিক, নিরাপদ এবং গুণগত মানসম্মত রোলিং বহরে স্টক যুক্ত করার পাশাপাশি পুরোনো লাগেজ ভ্যানের মানোন্নয়নে কাজ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তারই অংশ হিসেবে নতুন লাগেজ ভ্যান যুক্ত করা হচ্ছে। পুরোনো লাগেজ ভ্যানগুলোর অধিকাংশই মালামাল পরিবহনের উপযোগী নয়। বর্তমানে ১৬টি লাগেজ ভ্যান চলমান। লাগেজ ভ্যানগুলোর অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পেরিয়ে যাওয়ায় আয় কমেছে রেলের।

আয় বাড়াতে প্রকল্পের উদ্যোগ

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১ জুলাই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ‘রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন’ প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। সরকার ২০১৮ সালের ২৬ জুন পণ্য পরিবহন ও যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে আধুনিক, নিরাপদ এবং গুণগত মানসম্মত রোলিং বহরে স্টক যুক্ত করার লক্ষ্যে তিন হাজার ৬০২ কোটি সাত লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন প্রকল্পের (রোলিং স্টক সংগ্রহ) অনুমোদন দেয়।

আরও পড়ুন>> পণ্য পরিবহনে ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কিনছে রেলওয়ে

এর মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) দুই হাজার ৮৩৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ঋণ দেবে। এ প্রকল্পের আওতায় নতুন করে অত্যাধুনিক ১২৫টি লাগেজ ভ্যান সংযোজন করা হবে। এর মধ্যে ৭৫টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান সংযোজনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ব্রডগেজে ১০টি রেফ্রিজারেটর আর মিটারগেজে ১৬টি রেফ্রিজারেটর থাকবে। শুরুতে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ধরা হয়। পরে তা বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছিল।

জানা গেছে, লাগেজ ভ্যান সংগ্রহের জন্য ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট বাংলাদেশ রেলওয়ে ও চীনের মধ্যে দুটি চুক্তি সই হয়। ২০২২ সালের জুলাই থেকে লাগেজ ভ্যান বাংলাদেশে পৌঁছানোর কথা থাকলেও এখনো সব লাগেজ আসেনি, এসেছে মাত্র ২০টি।

যেসব ট্রেনে যুক্ত হচ্ছে লাগেজ ভ্যান

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, চীন থেকে ৭৫টি লাগেজ ভ্যান আমদানি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রথম লটের ২০টি লাগেজ ভ্যান বিভিন্ন ট্রেনে ব্যবহার, লোডিং, আনলোডিং স্টেশন নির্ধারণ করেছে পরিবহন বিভাগ। ২০টি লাগেজ ভ্যানের মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ১৩টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে তিনটি যুক্ত হবে। বাকি চারটি স্পেয়ার হিসেবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও লালমনিরহাট ইয়ার্ডে থাকবে। প্রথম চালানে আসা ৩০টি লাগেজ ভ্যান দিয়ে পণ্য পরিবহন সেবা চালু হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে ভারী ও ফ্রিজিং মালামাল পরিবহনে উন্নতমানের লাগেজ ভ্যানও যুক্ত হবে।

সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা-সিলেট রুটে পারাবাত এক্সপ্রেস, চট্টগ্রাম-সিলেট রুটের পাহাড়িকা ও উদয়ন, চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ রুটের বিজয় এক্সপ্রেস, ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ রুটের ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস, ঢাকা-ভূঞাপুর রুটের জামালপুর এক্সপ্রেস, ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটের কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস, ঢাকা-মোহনগঞ্জ রুটের হাওর এক্সপ্রেস, চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটের মহানগর এক্সপ্রেস, ঢাকা-সিলেট রুটের জয়ন্তিকা ও উপবন ট্রেনে একটি এবং চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটের চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেনে দুটি লাগেজ ভ্যান যুক্ত হবে।

ঢাকা-সিলেট রুটে পারাবাত এক্সপ্রেস ট্রেনের লাগেজ ভ্যানে ঢাকা ও সিলেট থেকে পণ্য তোলা ও নামানো যাবে। পাহাড়িকা ও উদয়নে চট্টগ্রাম, সিলেট, শ্রীমঙ্গল স্টেশন, বিজয় এক্সপ্রেসে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, গৌরীপুর, কিশোরগঞ্জ ও ভৈরববাজার, ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেসে ঢাকা, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহবাজার, ইসলামপুর বাজার, জামালপুর এক্সপ্রেসে ঢাকা, তারাকান্দি, জামালপুর, সরিষাবাড়ী, কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসে ঢাকা, নরসিংদী, ভৈরববাজার, কিশোরগঞ্জ, হাওর এক্সপ্রেসে ঢাকা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, মোহনগঞ্জ, মহানগর এক্সপ্রেসে চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা, লাকসাম, জয়ন্তিকা ও উপবনে ঢাকা, সিলেট, শায়েস্তাগঞ্জ, চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, ভৈরববাজার, ফেনী ও লাকসাম স্টেশন থেকে পণ্য তোলা ও নামানো যাবে।

আরও পড়ুন>> আজ বাড়তি ভালোলাগা কাজ করছে: লোকো মাস্টার এনামুল

এছাড়া পশ্চিমাঞ্চলের ঢাকা-রংপুর রুটের রংপুর এক্সপ্রেস, ঢাকা-কুড়িগ্রাম রুটের কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ও ঢাকা-লালমনিরহাট রুটের লালমনিরহাট এক্সপ্রেস ট্রেনে একটি করে লাগেজ ভ্যান যুক্ত হবে।

নতুন মাত্রায় যাত্রা করবে রেল

রেলে আয় বাড়াতে নতুন মোড়কে যাত্রীবাহী ট্রেনে একটি করে লাগেজ ভ্যান যুক্ত করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এতে রেলের লোকসান কাটিয়ে লাভজনক অবস্থায় যেতে ২০১৭ সালে নতুন এই পরিকল্পনা গ্রহণ করে রেল মন্ত্রণালয়। এতে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্য পরিবহন করা যাবে বিভিন্ন অঞ্চলে।

চলতি মাসে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছিলেন, মালামাল পরিবহনের জন্য প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনে লাগেজ ভ্যান যুক্ত করা হচ্ছে। এতে কৃষকরা তাদের পণ্য সরবরাহ করতে পারবেন। একই সঙ্গে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লাগেজও যুক্ত হবে। রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর) এ লাগেজ ভ্যান উদ্বোধন করা হচ্ছে।

লাগেজ ভ্যান পরিচালনা ও পণ্য পরিবহনে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে রেলের পরিবহন ও বাণিজ্যিক বিভাগ।

আরও পড়ুন>> সেপ্টেম্বরেই শুরু হচ্ছে পাবনা-ঢাকা সরাসরি ট্রেন চলাচল

এ বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, স্বল্প সময় ও কম খরচের কারণে রেলে পণ্য পরিবহনে মানুষের আগ্রহ ছিল বেশি। নানা সংকটে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে না পারায় একটা সময় গ্রাহকরা রেলে পণ্য পরিবহন থেকে দূরে সরে যান। সেই অবস্থা থেকে ফিরে আসতে পর্যাপ্ত লাগেজ ভ্যান আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় রেলওয়ে। প্রথম চালানে ২০টি লাগেজ ভ্যান এসেছে। আরও ২০টি কমিশনিংয়ের পর্যায়ে রয়েছে। ক্রমান্বয়ে ভারী ও ফ্রিজিং মালামাল পরিবহনে উন্নতমানের লাগেজ ভ্যানও যুক্ত হবে। এগুলো দিয়ে পণ্য পরিবহন সেবা চালু হবে।

তিনি বলেন, সড়কপথের চেয়ে রেলে পরিবহন খরচ কম ও সহজ হওয়ায় ব্যবসায়ী, প্রান্ত্রিক চাষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যবসায়ীরা সহজে দেশের বিভাগ, জেলা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে মালামাল পৌঁছাতে পারবেন। এতে সবাই লাভবান হবেন।

রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সুজিত কুমার বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের পশ্চিমাঞ্চলে রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটে মিটার গেজে তিনটি ট্রেন আছে। এই তিনটা ট্রেনে লাগেজ ভ্যান যুক্ত হচ্ছে। দীর্ঘদিন লাগেজ ভ্যান না থাকায় নতুন করে প্রচারণা চলছে। আশা করা যায় আমরা অনেক মালামাল পাবো। এক বছরে কত টাকা আয় হবে এটা এখন বলা দুরূহ। এটা নির্ভর করতেছে ব্যবসায়ীরা কি ধরনের মালামাল পরিবহন করে তার ওপর। নিরাপদ, সাশ্রয়ী হওয়ায় মালামালে লাগেজ ভ্যান বুক হবে আশা করছি।

আরএসএম/ইএ/জেআইএম