আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়টি নির্বাচন কমিশন ও সরকারের জন্য নিঃসন্দেহে অস্বস্তিকর। সরকার বিরোধী রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহল ইতোমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্তে উল্লাস প্রকাশ করছে। তারা বলছে আগামী নির্বাচন যে প্রশ্নবিদ্ধ হবে তার আগাম প্রমাণ দিয়েছে ইইউ।
Advertisement
কিন্তু বিষয়টি কী ঠিক এরকমই? ইউরোপীয় ইউনিয়ন যা বলেছে সেখানে নির্বাচনের মান নিয়ে কিছু বলা নেই। অর্থাৎ নির্বাচন অংগ্রহণমূলক হবে কিনা তার চাইতে বেশি উদ্বেগ সংঘাত নিয়ে। আসন্ন নির্বাচনে সংঘাতের শঙ্কা করে দল পাঠাতে চায় না সংস্থাটি। তবে একথাও বলেছে যে, সরকার বা নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করলে পরিপূর্ণ নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর পরিবর্তে একটি ছোট বিশেষজ্ঞ দল পাঠাতে পারে তারা।
২০০৮ সালে ইইউ'র প্রায় ৮০০ সদস্যের নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে৷ সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট বিপুল বিজয় লাভ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়র শুধু নির্বাচনের দিনই নয়, নির্বাচনের আগে ও পরে বেশ কিছুদিন বাংলাদেশে থেকে এই পর্যবেক্ষণের কাজ করেছিল। ২০১৪ সালে তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে আসেনি৷ ২০১৮ সালেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইইউ পর্যবেক্ষকরা আসেনি, যদিও সেই নির্বাচনে বিএনপি জোট গঠন করে নির্বাচন করেছিল। এবার আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে পর্যবেক্ষক দল আসছে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তার একটি প্রতিনিধিদল থাকার অর্থ হলো নির্বাচনের একটা আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। তারা কেন গত দুটি নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠালো না, এবারও কেন আসবে না সেটা বড় জিজ্ঞাসা হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত হলো। জানা দরকার এই দেশ থেকে, বিশেষ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি ইইউ-কে এমন কি নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে যে এমনটা হল?
Advertisement
সংঘাতের প্রসঙ্গ তোলা মানেই হলো হতে পারে নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নয়৷ কিন্তু সেটা তারা খোলাখুলি বলছে না। তবে একটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন থেকে। গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইসি সচিব জানান এরই মধ্যে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে ইইউ। বলেছে, বাজেট স্বল্পতার কারণে আগামী নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে পারছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
২৮টি দেশের জোট ইইউ আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বাণিজ্য জগতে প্রভাবশালী । ইইউ'র নির্বাচন পর্যবেক্ষণ দল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি প্রতিষ্ঠান৷ সবচেয়ে বড় কথা তারা আমাদের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী৷ তাদের কোনো বিরূপ মনোভাব অন্যান্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারে।
সংসদ নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকা না থাকা নিয়ে নানা বিতর্ক এবং বিভ্রান্তি রয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকার তাগিদটা এত বেশি কেন সেটা বড় আলোচনার দাবি রাখে। বিশেষ করে বিদেশি পর্যবেক্ষকের গুরুত্ব এবং তাদের অনুপস্থিতির কারণে দেশের পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো কতটা দৃঢ়তা ও আস্থার সাথে কাজটা করতে পারবে সে নিয়ে বড় সন্দেহ আছে মানুষের মাঝে।
২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোর একটি্। সেই নির্বাচনে প্রায় ছয়শ' বিদেশি পর্যবেক্ষক ছিলেন৷ তাদের বেশির ভাগই ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর৷ এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইন্সটিটিউট (এনডিআই) পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছিল এবং কমনওয়েলথের পক্ষ থেকেও পর্যবেক্ষক দল উপস্থিত ছিল৷ এর সঙ্গে ছিল স্থানীয় পর্যবেক্ষক৷ সব মিলে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার পর্যবেক্ষক ঐ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন৷
Advertisement
যদি ইইউ পর্যবেক্ষক দল না আসে তবে কী জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো টিমও আসবে না? তারা যদি না আসে তাহলে শুধু স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের দিয়ে নির্বাচনের কোনো কৃতিত্ব সৃষ্টি করা যাবে? এই প্রশ্নগুলো নির্বাচন কমিশনের সামনে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কেবলমাত্র সেখানেই তাদের পর্যবেক্ষকদের পাঠায়, যেখানে তারা একটি কার্যকর নির্বাচন হবে সেটা বুঝতে পারে। যে নির্বাচনের মাধ্যমে সে দেশের নাগরিকদের রায়ের প্রতিফলনের সম্ভাবনা দেখতে পান, যেখানে এই নির্বাচন গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় অবদান রাখবেন বলে মনে করেন। তবে কি তারা বাংলাদেশে সেই সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না?
বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বিভাজিত রাজনীতিতে আগামী নির্বাচন সম্পর্কে আগেভাগেই আন্তর্জাতিক মহলকে নেতিবাচক ধারণা দেয়া হয়েছে। তার প্রতিফলন এই সিদ্ধান্ত। সংঘাতের যে শঙ্কার কথা ইইউ বলেছে, তাও অমূলক নয়। আমরা দেখেছি ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি, তবে জামায়াত-কে সাথে নিয়ে নির্বাচন প্রতিহত করতে চেয়েছে। এবং এতে করে ব্যাপক সহিংসতা হয় দেশজুড়ে প্রায় ৬০০ স্কুলঘর পুড়ে,৩০০ এর ওপর মানুষ মারা যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতির এই এক অন্তহীন সমস্যা। সহিংসতাই এখানকার সংস্কৃতি। ফলে নির্বাচন নিয়ে একটা ভয় সবসময়ই থাকে। ইইউ সেই ভয়ের কথাটাই উচ্চারণ করেছে। আমাদের রাজনীতির পরাজয় এখানেই যে আমরা নিজেরা একটা সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি না সবার জন্য। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক কতজন হবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। যারা আসবে তারাও কতটা ক্রেডিবল হবে সে নিয়ে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। এই নির্বাচন আমাদের রাজনীতির জন্য বড় ধরনের পরীক্ষা বলেই মনে হচ্ছে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
এইচআর/এএসএম