দেশজুড়ে

লুচি-মিষ্টান্ন খেতে যে দোকানে গিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদসহ গুণীজনরা

রসনাপ্রিয় বাঙালির জিভে জল আনা স্বাদ নিয়ে ব্রিটিশ আমলে যাত্রা শুরু করা মিষ্টির দোকান ‘জলযোগ’। প্রতিষ্ঠানটি আজও ধরে রেখেছে সেই আদি স্বাদ। দেশভাগের পরও দুই বাংলার মানুষ যশোর পা রাখলে স্বাদ নিতে চান জলযোগের খাবারের। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, নিমাই ভট্টাচার্য্যসহ কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেতা যারাই যশোরে এসেছেন; জলযোগের খাবারের স্বাদ আস্বাদন করেছেন। এমনই তথ্য জানালেন জলযোগের তৃতীয় প্রজন্মের কর্ণধার সাধন বিশ্বাস।

Advertisement

আলাপচারিতায় জলযোগের ইতিহাসের ঝাঁপি খুলে ধরলেন স্বত্বাধিকারী সাধন বিশ্বাস। যেন টাইম মেশিনে চড়ে ফিরে গেলেন উনিশ শতকের শেষের দিক। জানালেন, অবিভক্ত ভারতের প্রথম জেলা যশোরের এক জমিদারের গাঁতিদার ছিলেন কালীপদ বিশ্বাস। জমিজমার খাজনা আদায় করাই ছিল তার মূল কাজ। বছরে তখন একবারই ফসল উঠত। সেই আয়ে বিশাল পরিবারকে সামলাতে গিয়ে প্রায়ই হিমশিম খেতে হতো কালীপদ বিশ্বাসকে। বাড়তি আয়ের বন্দোবস্ত করতে তাই শহরের রেলরোডের পাশে শুরু করেন চা-নাশতা আর মিষ্টি খাবারের দোকান ‘জলযোগ’। ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সেই জলযোগ এখন যশোরের খাবারের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন: বগুড়া ভ্রমণে যেসব খাবার খেতে পারেন

যশোর শহরের কোতোয়ালি থানার পাশে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সড়ক অর্থাৎ রেলরোড ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে জলযোগের। প্রধান সড়কের পাশে লাল সাইনবোর্ড ঘোষণা করছে জলযোগের অস্তিত্ব। আর নীল দরজা জানাচ্ছে সাদর আমন্ত্রণ। ছোট্ট দোকানের ভেতরে অল্প খানিকটা জায়গায় চারটা টেবিল আর বেশকিছু বসার বেঞ্চ পাতা। একপাশে হলদে রঙের আলমারির তাকে তাকে সাজানো নানা পদের মিষ্টি। তার সামনে বড় গামলায় ডাল আর ঝুড়িভর্তি গরম গরম ভাজা লুচি। এই জলযোগের খাবার।

Advertisement

গরম লুচি আর তরকারির সঙ্গে আলমারিতে সাজানো রয়েছে, ছোট চমচম, কালোজাম, ক্ষীর চমচম, ক্ষীর কালো জাম, রসগোল্লা, রাজভোগ, ছানা খেজুর, ছানা মুড়কি, ছানা পোলাও, মিহি দানা, হরেক রকম সন্দেশ, পানতোয়া, ছানা জিলাপি, রসমালাই, দই ইত্যাদি।

সাধন বিশ্বাস জানালেন, দেশ-বিদেশ; বিশেষ করে ভারতের যে কোনো প্রান্ত থেকে যশোর শহরে কেউ এলে জলযোগের মিষ্টির স্বাদ গ্রহণ না করে যান না। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেতা থেকে শুরু করে সাধারণ বাঙালি সবাই আসেন জলযোগে।

সাধন বিশ্বাসের কথার সূত্র ধরে জলযোগের ৫৭ বছরের কর্মচারী নারায়ণ কুমার বিশ্বাস জানালেন, তিনি নিজেই কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, নিমাই ভট্টাচার্য্যসহ অনেক জ্ঞানী-গুণীজনকে খাবার পরিবেশন করেছেন। ১৯৬৫ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি জলযোগে কাজ শরু করেন। আজও সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন: হারিয়ে যাচ্ছে মুখরোচক খাবার ‘সিদল’

Advertisement

জলযোগে নাশতা করতে এসেছিলেন নড়াইলের মেয়ে সৈয়দা সামিয়া রহমান শম্পা। তিনি যশোর সরকারি এম এম কলেজের অনার্সের ছাত্রী। জানালেন, ছোটভাই আল-আরাফাত হোসেন শান্ত যশোরে এসেছে। তাই তাকে জলযোগের লুচি মিষ্টি খাওয়াতে নিয়ে এসেছেন। মাঝেমধ্যেই তিনি এখানে নাশতা করতে আসেন। জলযোগের লুচি-তরকারি-মিষ্টির স্বাদ অনন্য। আর প্রথমবার জলযোগে এসে স্কুলছাত্র আল-আরাফাত হোসেন শান্তও জানালো তার ভাললাগার কথা।

২৫ বছর ধরে জলযোগে নাশতা করেন খালধার রোড এলাকার ব্যবসায়ী মাসুদুর রহমান জসিম। তিনি বললেন, জলযোগের লুচি-তরকারির স্বাদ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। তাই প্রায় প্রতিদিনই এখানে নাশতা করতে আসেন।

আরেক ব্যবসায়ী বরান্দিপাড়া এলাকার শেখ ফরহাদ আহমেদ বললেন, শুধু স্বাদ নয়; জলযোগের খাবার স্বাস্থ্যসম্মতও। এই লুচি-তরকারি খেয়ে কখনও বদহজম হয় না। জলযোগের শত বছরের ঐতিহ্য তার খাবারের মধ্যে ধরে রেখেছে।

প্রতিষ্ঠাতা কালীপদ বিশ্বাসের হাত ধরে যাত্রা শুরু করা জলযোগ তার ছেলে অজিত বিশ্বাসের হাত ঘুরে এখন তৃতীয় প্রজন্ম সাধন বিশ্বাসের হাতে। ব্রিটিশ আমল থেকেই ব্যবসায় সাহায্য করতেন কালীপদ বিশ্বাসের ছেলে ও সাধন বিশ্বাসের বাবা অজিত কুমার বিশ্বাস। সাধন বিশ্বাসের বয়স যখন ১০-১২, তখন থেকেই বাবার সঙ্গে নিয়মিত দোকানে আসতেন তিনি। তার বাবার আমলের অনেক কর্মচারী এখনো কাজ করছেন তার অধীনে।

সাধন বিশ্বাস জানালেন, প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ গরম লুচি আর তরকারির সঙ্গে ছোট চমচম, কালোজাম, ক্ষীর চমচম, ক্ষীর কালোজাম, রসগোল্লা, রাজভোগ, ছানা খেজুর, ছানা মুড়কি, ছানা পোলাও, মিহি দানা, হরেক রকম সন্দেশ, পানতোয়া, ছানার জিলাপি, রসমালাই, দই ইত্যাদি মিষ্টান্নের স্বাদ গ্রহণ করতে আসেন।

কালীপদ বিশ্বাসে সময় এত পদের মিষ্টি ছিল না এখানে। শুরুতে শুধু লুচি, ডাল, চা আর অল্প কয়েকপদের মিষ্টি তৈরি হতো। ব্রিটিশ ভারতের যেসব ব্যবসায়ীরা দূর-দূরান্ত থেকে যশোরে আসতেন তাদের জলযোগের ব্যবস্থা হতো এখানেই। রেলস্টেশনের কাছাকাছি হওয়ায় ভিড় লেগেই থাকত দোকানে।

আরও পড়ুন: হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী হাওয়াই মিঠাই

সাধন বিশ্বাস আরও জানান, যশোরের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের বাড়িতে বিয়ে বা বড় কোনো অনুষ্ঠানের খাবার মেন্যুতে বিশেষ স্থান পায় জলযোগের মিষ্টি। সীমানা ভাগ হলেও ওপার বাংলায় এখনো কদর কমেনি জলযোগের নলেন গুড়ের সন্দেশের। বেড়াতে আসা পর্যটক বা এপারের আত্মীয়-স্বজনের হাতে করে প্রায়ই ওপারে পৌঁছায় খাঁটি ছানা আর গুড়ের সুগন্ধিযুক্ত এই সন্দেশ।

অতীতের মতো এখনো জলযোগে সকালে বা বিকেলে টেবিলে জায়গা পেতে অপেক্ষা করতে হয়। শতবছরের ঐতিহ্য ধারণ করে জলযোগ খাবারের দামও রেখেছে সাধ্যের মধ্যে। এখানে প্রতিটি লুচি সাত টাকা, ডাল-তরকারি প্রতি প্লেট ১৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। এছাড়া মিষ্টান্নের মধ্যে ছোট চমচম ২৮০ টাকা কেজি, কালোজাম ২৮০ টাকা কেজি, ক্ষীর চমচম ৩৪০ টাকা কেজি, ক্ষীর কালোজাম ৩৪০ টাকা কেজি, রসগোল্লা ৩০০ টাকা কেজি, রাজভোগ ৩০০ টাকা কেজি, ছানা খেজুর ৩২০ টাকা কেজি, ছানা মুড়কি ৩২০ টাকা কেজি, ছানা পোলাও ৩২০ টাকা কেজি, মিহি দানা ৩৬০ টাকা কেজি, হরেক রকম সন্দেশ ৪৬০ টাকা থেকে ৪৮০ টাকা কেজি, পানতোয়া ৩২০ টাকা কেজি, ছানার জিলাপি ৩০০ টাকা কেজি, রসমালাই ৪৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

বাপ-দাদার আমলের সুনাম ধরে রেখে জলযোগকে এগিয়ে নিতে চান সাধন বিশ্বাস।

মিলন রহমান/এমআরআর/জিকেএস