আন্তর্জাতিক

গ্রিনহাউজ পদ্ধতিতে নেদারল্যান্ডসের অবিশ্বাস্য সাফল্য

দেশটির জনসংখ্যা খুব বেশি নয়, মাত্র ১ কোটি ৭০ লাখের মতো। দুই দশক আগেও নিজেদের জনগণের মুখে খাবার তুলে দেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগতো দেশটি। অথচ আজ তারাই হয়ে উঠেছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে দেশটি আজ কৃষিপণ্য রপ্তানি করছে পুরো পৃথিবীতে। অসম্ভবকে সম্ভব করা সেই দেশটির নাম নেদারল্যান্ডস।

Advertisement

ইউরোপীয় দেশটির আয়তনও খুব বেশি নয়, প্রায় ৪২ হাজার বর্গকিলোমিটার। কিন্তু এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি জমিই তারা ব্যবহার করছে কৃষিকাজে। ফলে আয়তনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্যের সমান হয়েও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে মার্কিনিদের পরেই অবস্থান করছে ডাচরা। কৃষি প্রযুক্তি রপ্তানিতেও শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে তারা।

কোষ-ভিত্তিক মাংস, উল্লম্ব চাষ (ভার্টিকাল ফার্মিং), বীজ প্রযুক্তি এবং দুধ ও ফসল সংগ্রহে রোবট ব্যবহারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে নেদারল্যান্ডস। পানির ব্যবহার কমানোর পাশাপাশি কার্বন এবং মিথেন গ্যাস নিঃসরণ কমানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে তাদের এই প্রযুক্তিগুলো।

আরও পড়ুন>> প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কৃষিকে যেভাবে বদলে দিচ্ছে নেদারল্যান্ডস

Advertisement

বর্তমানে ইউরোপের বৃহত্তম মাংস রপ্তানিকারক নেদারল্যান্ডস। দেশটিতে প্রতি বছর ৪০ লাখ গরু, ১ কোটি ৩০ লাখ শূকর এবং ১০ কোটি ৪০ লাখ মুরগি উৎপাদন হয়। পাশাপাশি, পশ্চিম ইউরোপের বেশিরভাগ অংশে সবজিও সরবরাহ করে তারা।

অল্প পানিতে বেশি চাষনেদারল্যান্ডসে প্রায় ২৪ হাজার একর জমিতে গ্রিনহাউজ পদ্ধতিতে ফসলের চাষ হচ্ছে। এসব গ্রিনহাউজে সার ও পানি লাগে খুবই কম। প্রথাগত পদ্ধতিতে ১০ একর জমিতে যে ফসল ফলে, তা মাত্র এক একর গ্রিনহাউজের মধ্যেই উৎপাদন করছে নেদারল্যান্ডস।

ডাচ খামারগুলো এক পাউন্ড টমেটো জন্মাতে মাত্র দেড় গ্যালন পানি ব্যবহার করে, যেখানে বিশ্বব্যাপী এর গড় ২৮ গ্যালনের বেশি। এছাড়া নেদারল্যান্ডসের গ্রিনহাউজগুলো কীটনাশকের ব্যবহার বাদই দিয়েছে বলা যায়।

দেশটির অর্ধেকের বেশি জমি আজ কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়। ডাচরা প্রায়ই বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেদারল্যান্ডস যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছিল, সেই শিক্ষাই তাদের খাদ্য উৎপাদনে মনোযোগী হতে উদ্বুদ্ধ করে।

Advertisement

এই প্রচেষ্টায় দারুণ সফল নেদারল্যান্ডস। আজ বিশ্বের শীর্ষ ২০টি কৃষিখাদ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫টিরই বড় গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে দেশটিতে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে নেসলে, কোকা-কোলা, ইউনিলিভার, কারগিল, ক্রাফট হেইঞ্জ প্রভৃতি।

ফুল-সবজি বীজের শীর্ষ সরবরাহকারীশোভাবর্ধনের গাছপালা এবং শাকসবজি বীজে বিশ্বের শীর্ষ সরবরাহকারী নেদারল্যান্ডস। দেশটির উত্তর-পশ্চিমে ‘সিড ভ্যালি’ নামে একটি এলাকা রয়েছে, যেখানে প্রতিনিয়ত নতুন জাতের সবজি ও ফুলের চাষ হচ্ছে। বিখ্যাত বীজ উৎপাদনকারী কোম্পানি এনজা জাডেনের সদর দপ্তর সেখানেই।

তিন প্রজন্মের ব্যবসা এনজা জাডেনের। একসময়ের পারিবারিক মালিকানাধীন ছোট্ট বীজের দোকান থেকে আজ উদ্ভিজ্জ প্রজননে বৈশ্বিক বাজারের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি হয়ে উঠেছে এটি। বর্তমানে ২৫টি দেশে আড়াই হাজারের বেশি কর্মচারী এবং ৪৫টি সহায়ক সংস্থা রয়েছে তাদের।

আরও পড়ুন>> শস্য না খাইয়ে যেভাবে মুরগি পালন করছে নেদারল্যান্ডসের কোম্পানি

এনজা জাডেনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাপ মাজারেউউ জানান, কোম্পানিটি কেবল গবেষণার পেছনেই বছরে ১০ কোটি ডলার খরচ করে। এর মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ১৫০টি নতুন সবজির জাত উদ্ভাবন করছেন তারা।

এনজা জাডেন সব ধরনের জলবায়ু অঞ্চলের জন্য এবং ঘরের ভেতরে-বাইরে সব ধরনের চাষের উপযোগী বীজ উৎপাদন করে। মাজারেউউ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়া আরও প্রতিকূল হয়ে উঠছে। এ কারণে আমরা টেকসই জাত উদ্ভাবনে নজর দিচ্ছি।

রপ্তানিতে রেকর্ডওয়াজেনিনজেন ইকোনমিক রিসার্চ অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকসের তথ্যমতে, ২০২১ সালে নেদারল্যান্ডস রেকর্ড ১০ হাজার ৫০০ কোটি ইউরোর কৃষিপণ্য রপ্তানি করেছে। ১৯৯৫ সালের পর থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস ও সারের ব্যবহার খুব বেশি না বাড়িয়েই ডাচ ফসল এবং পশু উৎপাদন বেড়েছে অন্তত ২০ শতাংশ।

গত বছর নেদারল্যান্ডস অন্তত ১ হাজার ২০০ কোটি ইউরোর শোভাবর্ধন পণ্য (ফুল, গাছপালা, বাল্ব এবং নার্সারি পণ্য) রপ্তানি করেছে। এরপরই রয়েছে ফল ও সবজি, তারপরে মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্য।

দেশটির মোট কৃষিপণ্য রপ্তানির এক-চতুর্থাংশ গেছে জার্মানিতে। ডাচ পণ্যের পরবর্তী তিনটি বৃহত্তম বাজার হলো বেলজিয়াম, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য। এসব দেশে বেশি রপ্তানি হয় পেঁয়াজ এবং টমেটো।

রপ্তানি খাতে ডাচদের ক্রমবর্ধমান এই আধিপত্যের জন্য দেশটির গবেষণা ও উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। গত তিন দশকে এর পরিমাণ বেড়েছে অন্তত তিনগুণ। বিপরীতে কমেছে শক্তি, পানি এবং অন্যান্য নির্ভরতা।

সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকেএএ/