দেশজুড়ে

কৃষকের অজ্ঞতায় উর্বরতা হারাচ্ছে জমি

পাবনা জেলায় সিংহভাগ কৃষি জমির উর্বরতা কমে গেছে। এতে করে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাচ্ছেন না চাষিরা। জমিতে দিন দিন ফসল উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। জমিতে অনুমান নির্ভর সার প্রয়োগের ফলে মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

Advertisement

এছাড়া একই জমিতে একই ফসল বার বার চাষ, অপরিকল্পিতভাবে অতিরিক্ত সার প্রয়োগ ও কীটনাশক ব্যবহার করায় মাটি বিষিয়ে উঠেছে। সেই বিষক্রিয়া জনস্বাস্থ্যের ওপরও পড়েছে। মাটি পরীক্ষা করে সুষম সার প্রয়োগের মাধ্যমে এ অবস্থার উত্তরণ ঘটতে পারে বলে জানিয়েছেন মৃত্তিকা বিশেষজ্ঞরা।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পাবনার আঞ্চলিক গবেষণাগার সূত্রে জানা গেছে, পাবনার ৯ উপজেলায় ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮০ হেক্টর কৃষিজমি রয়েছে। এই কৃষিজমি উঁচু, মাঝারি উঁচু, মাঝারি নিচু, নিচু, অতি নিচু জমি হিসেবে ৫ রকমের মাটি দ্বারা গঠিত। মাটির এই বৈশিষ্ট্যের কারণে সুজানগর ও সাঁথিয়া উপজেলায় পেঁয়াজ, ঈশ্বরদী ও আটঘরিয়া উপজেলায় সবজি এবং সদর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর ও বেড়া উপজেলায় ধান ও কালাইয়ের চাষ বেশি হয়।

দেশে সবজি উৎপাদনে শীর্ষ জেলাগুলোর মধ্যেও অন্যতম পাবনা। পেঁয়াজ উৎপাদনে পাবনা জেলা দেশের শীর্ষস্থানে। দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। পাবনা জেলা থেকেই উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টন যা মোট উৎপাদনের এক চতুর্থাংশ। আর পাবনা জেলার সাঁথিয়া-সুজানগর উপজেলা থেকে উৎপাদন হয় প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ টন। সে হিসাবে সারা দেশে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের এক পঞ্চমাংশ উৎপাদিত হয় পাবনার সাঁথিয়া ও সুজানগর উপজেলা থেকে।

Advertisement

চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেঁয়াজের উৎপাদন আগের চেয়ে কমে গেছে। যে জমিতে দুই দশক আগে বিঘা প্রতি ফলন হতো ৭০ মণ সেই জমিতে এখন উৎপাদন হয় ৪০ মণ। এভাবে ধান, পাট ও সবজি সব ফসলেরই ফলন কমে যাচ্ছে। অথচ চাষিরা আগের চেয়ে অনেক ভালো মানের বীজ বা উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড বীজ বপন বা চারা রোপণ করে থাকেন।

পাবনার কিছু এলাকায় কৃষকরা নিজ উদ্যোগে কম্পোস্ট সার তৈরি করছেন। এ সার ব্যবহার করেও ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।

সাঁথিয়া উপজেলার বামনডাঙ্গা গ্রামের কৃষক সাগর হোসেন বলেন, গত মৌসুমে তিনি দুই বিঘা জমিতে ধান রোপণ করেছিলেন। ঠিকমতো সার ও কীটনাশক দিয়েছেন। কিন্তু ধানের শীষ বের হওয়ার পরই তা শুকিয়ে যায়।

জসীম উদ্দিন নামের আরেক কৃষক বলেন, মাটির গুণাগুণ তিনি বোঝেন না। বৈজ্ঞানিক উপায়ে সার-কীটনাশক কেমন মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে তাও জানেন না। অন্যদের দেখে ও নিজের আন্দাজ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করেন। এতে ফসলের গাছ দ্রুতই বেড়ে ওঠে। কিন্তু সে তুলনায় ফলন বাড়ে না।

Advertisement

সুজানগর উপজেলার দহেরপাড়া গ্রামের চাষি আ. বাতেন, শহীদুল ইসলাম, আতাইকুলা থানার বামনডাঙ্গা গ্রামের চাষি আ. রদি মোল্লা জানান, আগে কম সার ব্যবহার করেই বেশ ভালো ফলন পেতেন। কিন্তু এখন অতিমাত্রায় সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেও ফলন বাড়ছে না। শাক, সবজি, ধান, গমসহ প্রতিটি রবিশস্য বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচও বেড়েছে।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পাবনার গবেষকরা জানান, বেশি ফসলের আশায় জমিতে অপরিকল্পিতভাবে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করায় পাবনা জেলার ৯০ শতাংশ জমির উর্বরতা শক্তি কমে গেছে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ জমির উর্বরতা শক্তি নিম্ন থেকে নিম্নতর স্তরে নেমে গেছে। ভারসাম্যহীনভাবে মাটিতে বেড়েছে বা কমেছে আর্সেনিক, হাইড্রোজেন, ফসফরাস, নাইট্রোজেন ও দস্তা।

সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলার পেঁয়াজচাষ প্রধান এলাকার বেশ কিছু মাঠের জমির উপাদান পরীক্ষা করে তিনি জানান, কোনো জমিতেই কোনো উপাদান সঠিক মাত্রায় নেই। কোনো উপাদান রয়েছে খুব বেশি আবার কোনো উপাদান রয়েছে একবারে কম মাত্রায়।

গবেষকরা জানান, সম্প্রতি মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পাবনা বিভিন্ন অঞ্চলের মাটির শ্রেণি এবং বৈশিষ্ট্য অনুসারে ৩৮৬টি নমুনা পরীক্ষা করে দেখতে পায় শতকরা ৯০ শতাংশ জমিই দ্রুত হারিয়ে ফেলছে উর্বরতা শক্তি। প্রায় শতভাগ বাণিজ্যিক জমিতেই পাওয়া যায়নি পরিমিত মাত্রার জৈব পদার্থ। অতি নিম্ন এবং নিম্ন মাত্রার জৈব পদার্থ পাওয়া গেছে ৫০ শতাংশ জমিতে। এছাড়া অধিকাংশ মাটিতেই হাইড্রোজের সক্রিয়তা, ফসফরাস, নাইট্রোজেন, দস্তাসহ সব উপাদানই ভারসাম্যহীন।

গবেষকরা জানান, জমিতে বোরণ কম লাগে কিন্তু তা মাটির জন্য অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যায় চাষিরা ওইসব উপাদান প্রয়োগের বেলায় অজ্ঞ। ফলে কিছু উপাদান প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম থেকে যাচ্ছে।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, পাবনার গবেষকরা জানান, চাষিরা মাটি পরীক্ষা না করে তাদের অনুমান নির্ভর সার প্রয়োগ করছেন। এতে দেশে সার বেশি লাগছে। সারের ওপর চাপ পড়ছে।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পাবনার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা জানান, মাটিতে কিছু উপাদান অতি উচ্চ মাত্রায় রয়েছে। কিন্তু চাষি বছরের পর বছর একই সার প্রয়োগ করে চলেছেন। এমনকি ভালো ফসলের আশায় চাষি আরও বেশি মাত্রায় অপ্রয়োজনীয় সার দিয়ে চলেছেন।

গবেষকরা জানান, একটি ফসলি জমিতে পটাশ আর ফসফরাস বা সালফার যতটুকু দেওয়া হয় তা কিছুটা উদ্বৃত্ত থেকে যায়। কিন্তু চাষি এসব উপাদান প্রত্যেক ফসলের ক্ষেত্রেই উপুর্যপরি প্রয়োগ করতেই থাকেন। এক্ষেত্রে তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মাটি বিষাক্ত হয়ে যায়। জমির ফসলহানি হচ্ছে আর মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরতা। এতে চাষির আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা আরও জানান, কৃষকেরা অধিক ফলনের আশায় ভারসাম্যহীনভাবে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছেন। এতে মাটিতে ফসফরাস ও গন্ধক সারের উচ্চমাত্রা তৈরি হয়েছে। ঈশ্বরদী এবং গাজনার বিল বিধৌত সুজানগর আর আটঘরিয়া উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণির মাটি পরীক্ষা করে অধিকাংশ মাটিতেই পাওয়া গেছে উদ্বেগজনক মাত্রার ফসফরাস, জিংক ও আর্সেনিক। সবজিপ্রধান ঈশ্বরদী উপজেলার ১২৮ স্থানের মাটির নমুনা পরীক্ষা করে ৬২ শতাংশ জমিতে উচ্চমাত্রায় ফসফরাস, ২৩ শতাংশ জমিতে উচ্চমাত্রায় পটাশিয়াম ও ৪৯ শতাংশ জমিতে উচ্চমাত্রায় সালফার পাওয়া গেছে। বেড়েছে আর্সেনিক ও জিংকের মাত্রা। যা বিষাক্ত করে তুলছে মাটি এবং উৎপাদিত শাক সবজিসহ ফসলকেও। ফলে জমির পাশাপাশি এসব উপাদান মানব শরীরেরও ক্ষতি করছে।

গবেষকরা বলছেন, মাটিতে ভারসাম্যহীনভাবে আর্সেনিক ও দস্তা বাড়ায় শুধু যে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, উৎপাদিত ফসল খাদ্য হিসেবে গ্রহণের পর তা প্রভাব ফেলছে মানুষের শরীরেও। যার অন্যতম লক্ষণ উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ক্যানসার।

পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আকসাদ আল মাসুর আনন জানান, মাটিতে ক্ষতিকর পদার্থ থাকলে ফসলের মাধ্যমে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এতে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

পাবনায় দোতলা কৃষির উদ্ভাবক কৃষিবিদ সাদেক জানান, লাগামহীন এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে মানুষ যেমন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে অনুরূপভাবে কৃষিতে কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সার এবং কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটিও স্থায়ীভাবে হারিয়ে ফেলছে উর্বরতা শক্তি। জমির উর্বরতা শক্তি রক্ষার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করলে কৃষি উৎপাদনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক গবেষণাগার, পাবনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মামুন আল আহসান চৌধুরী বলেন, মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারের বিকল্প নেই। অধিকাংশ কৃষকই মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই যত্রতত্র সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করছেন। তবে পাবনায় গবেষণাগার হওয়ায় চাষিরা সহজেই মাটি পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন। আশার কথা, মাটি পরীক্ষায় চাষিদের আগ্রহ বাড়ছে। অনেক চাষি এখন মাটি পরীক্ষার ফলাফলের রিপোর্টের ভিত্তিতে সার প্রয়োগ করছেন।

এফএ/এমএস