আইন-আদালত

বিচার বিভাগ নিয়ে পোস্টারিং, কী বোঝাতে চায় বিএনপি?

সুপ্রিম কোর্ট থেকে শুরু করে ৬৪টি জেলা আইনজীবী সমিতিতে ‘উই ডন্ট ওয়ান্ট বায়াস অ্যান্ড আনফেয়ার জুডিসিয়ারি’ লেখা সম্বলিত পোস্টার লাগিয়েছে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। শুধু তাই নয়, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি সম্বলিত সেই পোস্টার। এ ঘটনায় বিপরীতমুখী অবস্থানে বিএনপি ও আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা।

Advertisement

বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বলছেন, বর্তমান বিচার বিভাগ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবে প্রভাবিত। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা বলছেন, বিচার বিভাগে কারও কোনো প্রভাব নেই। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে চলছে, বিচারকরা স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। বিএনপিপন্থিদের এমন পোস্টার নিয়ে তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন! তাদের প্রশ্ন এমন পোস্টার সাঁটিয়ে কী বোঝাতে চায় বিএনপিপন্থিরা? বিচার বিভাগ যদি দলীয়করণ করা হয় তাহলে বিএনপির সময় করা হয়েছে।

গত ৭ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আশঙ্কার কথা তুলে ধরে বলেন, এক-দেড় মাসের মধ্যে হয়তো আমাকেও জেলে যেতে হতে পারে। তিনি বলেন, প্রতিদিন বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে হয়। এটি কোনো গণতান্ত্রিক দেশ হতে পারে না। তিনি বলেন, এমন বিচার ব্যবস্থা, যদি হাইকোর্ট জামিন দেন, সেটা আবার নিম্ন আদালতে আটকে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, আইন মন্ত্রণালয় একটি সেল তৈরি করেছে, সেটির কাজ দ্রুত রায় দিয়ে সাজা দেওয়া। যারা দেশের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করছে তাদের সবাইকে আদালতে যেতে হচ্ছে।

এরই প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সব জেলা বারে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবি সম্বলিত পোস্টার লাগানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

Advertisement

আরও পড়ুন> বিচার বিভাগ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে না: প্রধান বিচারপতি

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, ঢাকা আইনজীবী সমিতিসহ দেশের সব জেলা বারে এবং ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ‘উই ডন্ট ওয়ান্ট বায়াস অ্যান্ড আনফেয়ার জুডিসিয়ারি’ অর্থাৎ ‘আমরা প্রভাবিত বিচার বিভাগ চাই না’ লেখা সম্বলিত পোস্টার লাগিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের বিভিন্ন স্থানে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি সম্বলিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের এমন পোস্টার চোখে পড়ে।

জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক গাজী কামরুল ইসলাম সজল বলেন, আমাদের কথাই ওই পোস্টারে লেখা আছে। সারাদেশে বিচারের নামে প্রহসন চলছে। আদালতের পরিবেশ আজ দ্বিধা-বিভক্ত। আজ বিএনপির জন্য এক আইন প্রচলিত, অন্যদের জন্য আরেক আইন। এ কারণে আমরা বলছি, ‘উই ডিমান্ড ইমপারসিয়াল অ্যান্ড ফেয়ার জুডিসিয়ারি’ (আমরা নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিচারবিভাগ চাই)। ‘উই ডন্ট ওয়ান্ট বায়াস অ্যান্ড আনফেয়ার জুডিসিয়ারি’ (আমরা প্রভাবিত বিচার বিভাগ চাই না)।

আরও পড়ুন> তারেক-জোবায়দার সাজা/ সুপ্রিম কোর্টে আওয়ামী লীগ-বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ধাক্কাধাক্কি

Advertisement

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জাগো নিউজকে বলেন, এই পোস্টারটি মূলত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফোরামের আইনজীবীদের প্রতিনিধিত্ব করে। দেশে ১৮ কোটি মানুষ আছে, তাদের কথার প্রতিধ্বনি, তাদের যে আকুতি, কথা বলার বহিঃপ্রকাশ সেটি হলো এই পোস্টার। বাংলাদেশের মুক্তিকামী ও গণতন্ত্রপন্থি যারা আছে তাদের অ্যাডভোকেসি করছে এই পোস্টার। রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর যে অত্যাচার, অবিচার হচ্ছে এটার প্রতিবাদে এই পোস্টার।

তিনি আরও বলেন, ‘উই ডন্ট ওয়ান্ট বায়াস অ্যান্ড আন ফেয়ার জুডিসিয়ারি’ এর মানে কী? দেশের রাজনৈতিক কর্মী যারা আছে তাদের ধরতে, জুডিসিয়ারি বায়াস হিসেবে কাজ করছে। এক একটা মামলায় একদিনে ১৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে। যেটা হওয়ার কথা নয়। কোনো কোনো মামলা বছরের পর বছর হিমাগারে পড়েছিল, এই মামলাগুলো হঠাৎ করে সচল হচ্ছে। অর্থাৎ জুডিসিয়ারিকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থে। সেজন্যই ‘উই ডন্ট ওয়ান্ট বায়াস অ্যান্ড আন ফেয়ার জুডিসিয়ারি’।

তিনি বলেন, পোস্টারে যাদের ছবি দেওয়া হয়েছে, তারা দলের প্রধান এবং ভিকটিমও বটে। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার মামলায় নিম্ন আদালতে সাজা ছিল ৫ বছরের উচ্চ আদালতে এসে তা বেড়ে হলো ১০ বছর। অন্যদিকে, তারেক রহমানের মামলায় নিম্ন আদালতে কোনো সাজাই ছিল না, তাকে ১০ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। অথচ মানুষ উচ্চ আদালতে আসেন দণ্ড থেকে মুক্তি নিতে।

কেন এই পোস্টার লাগানো হলো জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী মো. কামরুল ইসলাম সজল জাগো নিউজকে বলেন, বাস্তবতা হলো প্রতিটি মুক্তিকামী জনগণের দাবি একটাই সেটা পোস্টারের মধ্যে আছে।

তিনি বলেন, ‘উই ডন্ট ওয়ান্ট বায়াস অ্যান্ড আন ফেয়ার জুডিসিয়ারি’ এই প্রসঙ্গটি কখন এসেছে যখন বায়াস জাজমেন্ট হয়েছে, ফেয়ারনেস থাকছে না জাজমেন্টে, সে কারণেই আমাদের পোস্টার। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত বিচার বিভাগ, আইনবিভাগ ও পুলিশ যারা রয়েছে তাদের আচরণ একাকার হয়ে গেছে। বিচার বিভাগের কাছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী হলে এক ধরনের বিচার পাচ্ছেন। আবার সরকারি দলের নেতাকর্মী হলে আরেক ধরনের বিচার পাচ্ছেন। সে কারণে আমাদের মৌলিক দাবি হলো আমরা ‘আনফেয়ার জুডিসিয়ারি’ চাচ্ছি না, বায়াস জাজমেন্ট চাচ্ছি না, আমরা ফেয়ার জাজমেন্ট চাচ্ছি। ফেয়ার জাজমেন্ট হলে যদি আমরা ক্ষতিগ্রস্তও হই তাও মেনে নেবো।

আরও পড়ুন> পুলিসি বাধা উপেক্ষা করে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের বিক্ষোভ মিছিল

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কাজী নজিবুল্লাহ হিরু জাগো নিউজকে বলেন, যে মামলাগুলোর বিচার হচ্ছে বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়ার মামলা, কমপক্ষে ১৭ থেকে ১৮ বছর আগের। আমাদের তো বলাই আছে বিচার বিলম্ব মানে ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করা। তাদের তো আরও দ্রুত বিচার চাওয়া উচিত ছিল। জুডিসিয়ারির ওপর সবারই আস্থা থাকতে হবে। বরং জুডিসিয়ারিকে যদি কোনোভাবে বিতর্কিত করা হয় তা বিএনপি করেছিল।

তিনি আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নাম করে সে সময় প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে পছন্দের লোককে সরকার প্রধান করবেন সেজন্য তারা জুডিসিয়ারিকে প্রভাবিত করেছিল। এখন বিচার বিভাগ স্বাধীন। তাদের পোস্টার লাগানো রাজনৈতিক কৌশল বলেও মনে করেন তিনি।

‘বাস্তবতা হলো প্রতিটি মুক্তিকামী জনগণের দাবি একটাই সেটা পোস্টারের মধ্যে আছে। উই ডন্ট ওয়ান্ট বায়াস অ্যান্ড আন ফেয়ার জুডিসিয়ারি’ এই প্রসঙ্গটি কখন এসেছে যখন বায়াস জাজমেন্ট হয়েছে, ফেয়ারনেস থাকছে না জাজমেন্টে, সে কারণেই আমাদের পোস্টার। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও পুলিশ যারা রয়েছে তাদের আচরণ একাকার হয়ে গেছে। বিচার বিভাগের কাছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী হলে এক ধরনের বিচার পাচ্ছেন। আবার সরকারি দলের নেতাকর্মী হলে আরেক ধরনের বিচার পাচ্ছেন।’

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট এসএম মনির জাগো নিউজকে বলেন, এটা পলিটিক্যাল। বিএনপির পক্ষ থেকে পোস্টার লাগালেই হবে না। বিচার বিভাগ এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন। এখন বিচারক নিয়োগ করার জন্য আলাদাভাবে পরীক্ষা নিয়ে বিচার বিভাগ থেকে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়। দলীয় কোনো প্রভাব সেখানে নেই। বিচার ও রায়ের ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই আসে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তারা বিচারকাজ করতে দেয়নি। তখন বিচারের ওপর প্রভাব ফেলেছিল বিএনপি।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির জাগো নিউজকে বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা ভিন্ন খাতে নিয়ে চার্জশিট দিয়েছিল, বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করে। এখন বিচার বিভাগ স্বাধীন নিরপেক্ষভাবে বিচার করছে, এসব পোস্টার লাগানো তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। এখন আদালতে শুধু আওয়ামী লীগের বিচারক না সব দলের বিচারকই রয়েছেন। কাজেই এসব বলে লাভ নেই, বিচার বিভাগ প্রভাবিত। বিচার বিভাগে কারও কোনো প্রভাব নেই।

এফএইচ/এসএনআর/এসএইচএস/এমএস