২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে কুষ্ঠমুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আশানুরূপ হারে কমছে না কুষ্ঠরোগী। সীমান্তবর্তী অনেক জেলায় নিয়মিত শনাক্ত হচ্ছে কুষ্ঠরোগী। দেশের এমনই সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রেড জোন দশটি জেলার মধ্যে মেহেরপুর একটি।
Advertisement
অবহেলিত এই রোগটি নির্মূলে বেশি বেশি সার্চিং প্রোগ্রামের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকদের। এনজিও ও বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে নতুন পরিকল্পনাও নিচ্ছে সরকার।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় বর্তমানে ৩২ জন কুষ্ঠরোগীর চিকিৎসা চলমান রয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৫৩ জন কুষ্ঠরোগী জেলায় শনাক্ত হয়েছেন। যার মধ্যে ৬৫ জন কুষ্ঠরোগী ভয়াবহ অবস্থায় শনাক্ত হন।
মূলত ভারতের সঙ্গে লাগোয়া সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে কুষ্ঠ রোগের প্রকোপ বেশি। প্রতি লাখ জনসংখ্যায় ৫ এর অধিক কুষ্ঠোরোগী থাকলে সেই এলাকাকে লাল চিহ্নিত (রেডজোন) হিসেবে গণনা করছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এমনই লাল চিহ্নিত দশটি জেলার মধ্যে একটি সীমান্তবর্তী জেলা মেহেরপুর। প্রতিনিয়ত কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হচ্ছে জেলাটিতে। এরইমধ্যে ছয় জন কুষ্ঠরোগী পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। অবহেলিত এই রোগটির ভয়াল থাবা কেড়ে নিয়েছে তাদের স্বাভাবিক জীবন। স্বাভাবিক চর্ম সমস্যা মনে করে অবহেলাই হয়েছে তাদের জন্য কাল। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে ভালো হলেও সারা জীবনের জন্য বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন চিহ্ন। তাছাড়া নিয়মিত ওষুধ সেবনে কুষ্ঠ ভালো হলেও রয়েছে সামাজিক নানা বাধা।
Advertisement
কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন আত্মীয়-স্বজন এমনকি নিজ পরিবারের থেকেও। চিকিৎসার পাশাপাশি এসব জেলায় কুষ্ঠরোগী পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ার দাবি রোগীদের।
মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলার সীমান্তবর্তী সোনাপুর মাজপাড়া গ্রামের সেনারুল ইসলাম (৩৮)। তিনি বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় তিনি কোন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তা বুঝতে পারেননি। কয়েক মাস পর তার পা অস্বাভাবিক হলে ডাক্তারের কাছে গেলে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত বলে জানতে পারেন। দীর্ঘ এক বছর চিকিৎসায় তিনি বর্তমানে সুস্থ।
তিনি আরও বলেন, এই রোগে আক্রান্ত হলে সমাজ এড়িয়ে চলে। সমাজের ভেতরে থেকেও বিছিন্নতা। শারীরিক যন্ত্রণার সঙ্গে মানসিক কষ্ট বয়ে বেড়াতে হয়। মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলার খানপুর গ্রামের আব্দুস সামাদ (২৮) প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা না নেওয়ার কারণে এখন আর বামচোখে দেখেন না। তিনি বলেন, শরীরে কোনো সমস্যা না হওয়ায় এই রোগকে প্রাথমিক অবস্থায় গুরুত্ব দিইনি। যার কারণে আমার এই অবস্থা। এই রোগে আক্রান্ত হলে সহমর্মিতাতো দূরে থাক, সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেকে চিকিৎসা নিতেও ভয় পান।
আরেক কুষ্ঠরোগী মেহেরপুর শহরের ক্যাশবপাড়ার মাফিজুল ইসলাম (৩২) সামাজিক বিছিন্নতার কারণে প্রথমে এই রোগ দীর্ঘদিন প্রকাশ করেননি। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক বছরের চিকিৎসায় তিনি বর্তমানে সুস্থ। তিনি বর্তমানে সকল কাজ করতে পারন।
Advertisement
মেহেরপুর পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অলোক কুমার দাস জানান, ভারতের সঙ্গে লাগোয়া সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে কুষ্ঠ রোগের প্রকোপ বেশি। বিভিন্ন সময় ভারত থেকে কুষ্ঠরোগীর অনুপ্রবেশ হচ্ছে। কুষ্ঠ একটি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক ব্যাধি যা মাইক্রোব্যাক্টেরিয়াম লেপ্রি দিয়ে হয়ে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়ায় অনুভূতিহীন দাগ দেখা দেয়, যা হালকা লালচে এবং তামাটে বর্ণের হয়ে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি চিহ্নিত করে চিকিৎসা না নিলে অঙ্গহানি হতে পারে।
মেহেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. জাওয়াহেরুল আনাম সিদ্দিকী জানান, দারিদ্র্যপীড়িত ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরত পরিবারের কুষ্ঠরোগ বেশি দেখা যায়। এছাড়া আক্রান্তের অতীত ঘটনা রয়েছে এমন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রোগটি বেশি দেখা যায়। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে কুষ্ঠ ছড়াই। এ রোগের জীবাণু বহুদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকে। সচেতনতার অভাব ও রোগটি সম্পর্কে ডাক্তারকে না জানানো এর চিকিৎসার প্রধান বাধা। এরইমধ্যে রোগটি শনাক্ত করতে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সাস্থ্য বিভাগ।
তিনি আরও জানান, এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে স্বাস্থ্যবিভাগ। এ লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারিভাবে কাজ করা হচ্ছে। এজন্য রোগ শনাক্তকরণ, বিনামূল্যে ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে। যারা কুষ্ঠরোগে সম্পূর্ণ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তাদের প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
এফএ/এএসএম