দেশজুড়ে

সাত মাসের সন্তান রেখে ডেঙ্গুতে চলে গেলেন হাবিবা

পটুয়াখালী পৌরশহরের কাঠপট্টি এলাকার বাসিন্দা আল আমিন (৩২)। স্ত্রী আর সাত মাসের সন্তান নিয়ে আর পাঁচটা পরিবারের মতো স্বাচ্ছন্দ্যে চলছিল। সন্তানের ভালোবাসা আর আবেগ নিয়ে যখন দম্পতি মুগ্ধ ঠিক সে সময় হঠাৎ আল আমিনের সংসার এলোমেলো হয়ে গেলো।

Advertisement

দুদিনের ডেঙ্গু জ্বরে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন ৩২ বছর বয়সী আল আমিনের স্ত্রী ২৮ বছরের ফাতেমাতুজ জোহরা হাবিবা। গত ৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় হাবিবা পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আর বিয়ের দুবছর এক মাস ২৫ দিনে স্ত্রীকে হারিয়ে অনেকটা বাকরুদ্ধ আল আমিন।

১৭ সেপ্টেম্বর রাতে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় আল আমিনের। ৩৫ বছরের এ যুবক পৌরশহরের ২ নম্বর ওয়ার্ড এর কাঠপট্টি এলাকার বাসার সামনের সড়কেই সাত মাসের মেয়ে ওজিহাকে কোলে নিয়ে ঘুরছিলেন। আল আমিনের সঙ্গে কথা হয় হাবিবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়া এবং পরবর্তী চিকিৎসা নিয়ে।

আল আমিন বলেন, ‘৪ সেপ্টেম্বর বিকেল থেকেই হাবিবা গায়ে একটু জ্বর অনুভব করে। রাত ১০ টার দিকে জ্বর এবং মাথাব্যথা থাকায় তাকে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে ডাক্তার ডেঙ্গুর পরীক্ষা দিলে আমরা ডেঙ্গু পরীক্ষা করি। রাত ১০ টার দিকে এতে পরীক্ষার রিপোর্টে ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। তখন জ্বর ছিল ১০২। তবে হাসপাতালে সিট না থাকায় চিকিৎসকের পরামর্শে আমরা ওকে বাসায় নিয়ে আসি। সকালে প্রচণ্ড জ্বর এবং মাথাব্যথা থাকায় আবারও হাসপাতালে নিয়ে যাই।’

Advertisement

তিনি আরও বলেন, ‘দুপুর দেড়টার দিকে ডাক্তার আসে। তখন প্লাটিলেট পরীক্ষা করে দেখা যায় আছে ১ লাখ ৮৬ হাজার। চিকিৎসক বলেন- রোগীর কন্ডিশন ভালো আছে চাইলে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। সেদিন বাসায় নিয়ে এলে ৬ সেপ্টেম্বর সকালে হাবিবার প্রচণ্ড বুকে ব্যথা এবং বমি শুরু হয়। এ সময় অ্যাম্বুলেন্সে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাই। সকালে প্লাটিলেট পরীক্ষা করে দেখা যায় ২০ হাজার। তখন কোনো অবস্থাতেই বুকে ব্যথা কমছিল না এবং শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। ইসিজি ও এক্স-রে করে দেখা যায় লাঞ্চে পানি জমেছে।’

আল আমিন বলেন, ‘রিপোর্ট যখন পাই তখন বিকেল ৪টা। এ সময় আমরা সিদ্ধান্ত নেই ওকে ঢাকায় নিয়ে যাবো। তবে সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগে ও আমার কাছে মাপ চেয়ে জড়িয়ে ধরে, তখনই সব শেষ। দ্রুত নার্সদের ডাকলেও তারা তখন আসেনি, কোনো চিকিৎসক পাইনি। ইমারজেন্সিতে গিয়ে ডাক্তারদের রিকোয়েস্ট করলেও অনেক পরে তারা আসে। এসে বলে রোগী আর নেই।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে হাবিবার স্বামী বলেন, ‘২৭ জানুয়ারি আমাদের বাচ্চাটি জন্ম নেয়। সবকিছু ভালোভাবেই চলছিল। সাত মাস আট দিনেই আমার মেয়ে তার মাকে হারালো। এখন সবকিছু এলোমেলো। আমার বড় ভাইয়ের বউ এবং হাবিবার চাচাতো বোনরা আমার বাচ্চাকে দেখভাল করছে।’

তবে কেন মাত্র দুদিনেই হাবিবার এমন পরিস্থিতি হলো এ বিষয়ে কথা হয় পটুয়াখালী মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মশিউর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্লাটিলেট মূলত বাড়ে এবং কমে। তবে হাবিবার ডেঙ্গুর পাশাপাশি তার বেশ কিছু জটিলতাও ছিল। বিশেষ করে কিছুদিন আগে তিনি সন্তানের মা হয়েছেন। যে কারণে রক্তস্বল্পতাসহ কিছু জটিলতার কারণে দ্রুত তার অবস্থার অবনতি হয়েছে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়েই একজন রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করি।

Advertisement

পটুয়াখালী জেলা স্বাস্থ্যবিভাগের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত জেলায় সাড়ে চার হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আছেন ২৮৮ জন। এর মধ্যে এ পর্যন্ত জেলায় পাঁচজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

তবে পটুয়াখালী জেলা স্বাস্থ্যবিভাগের দেওয়া তথ্যের থেকেও বাস্তবে জেলায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো অবস্থাতেই রোগীর অবস্থা জটিল না হলে তাদের হাসপাতাল কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয় না। এর ফলে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের বড় একটি অংশ হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

আব্দুস সালাম আরিফ/এসজে/এএসএম