আমদানি-রপ্তানি বাড়ানোর জন্য ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা করা হয়েছে অনেক আগেই। তবে রপ্তানি তো দূরে থাক, বছরে ছয় মাস শুধু ইট পোড়ানোর কয়লা আমদানির জন্য ব্যবহার হচ্ছে এ স্থলবন্দর। বছরের বাকি সময় কার্যত বন্ধ থাকে বন্দরটি। আমদানি-রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
Advertisement
ময়মনসিংহ থেকে হালুয়াঘাটের দূরত্ব প্রায় ৪৯ কিলোমিটার। হালুয়াঘাট থেকে গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের দূরত্ব সাত কিলোমিটার। গোবরাকুড়া স্থলবন্দরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বড় বড় কয়লার স্তূপ। কয়েক একর জায়গাজুড়ে কয়লার বড় বড় স্তূপ।
সরেজমিনে দেখা যায়, বন্দরে সুনসান নীরবতা। কোনো মানুষজন নেই। কয়লার স্তূপের পাশে ব্যবসায়ীদের বসার ঘর। ঘরগুলোয় তালা ঝুলছে। এরপর স্থলবন্দরের প্রশাসনিক ভবন। সেখানে গিয়েও দারোয়ান ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি।
কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে পোর্টে কোয়ারেন্টাইন অফিস প্রয়োজন হয়। আমাদের কোয়ারেন্টাইন অফিস পোর্টে নেই। ভারতীয় অংশের পোর্টেও কোয়ারেন্টাইন অফিস নেই। যে কারণে কৃষিপণ্য আমদানি-রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে, এ বন্দর দিয়ে যাতে সবধরনের পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা যায় সেই চেষ্টা করছি।
Advertisement
আরও পড়ুন: ভারত থেকে ভুট্টার ট্রাকে এলো ৪২০ কেজি জিরা
দারোয়ান বলেন, ‘এখন তো কয়লা আমদানি হয় না। তাই, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা কেউ নেই। আমি এখনই ফোন করছি। স্যার চলে আসবেন।’
গোবরাকুড়া স্থলবন্দর থেকে কড়ইতলী স্থলবন্দরের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। কড়ইতলী স্থলবন্দরে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। বড় বড় স্তূপ করে কয়লা রাখা হয়েছে। মানুষজন নেই। বন্দরের প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে।
২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কয়লা ব্যবসায়ীদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। কারণ, একটি মামলার জন্য কয়লা আমদানি বন্ধ ছিল। তবে আদালত নির্দেশনা দেওয়ার কিছুদিন পর কয়লা এসেছে। আবার কিছুদিন পরে বন্ধ হয়ে গেছে। এভাবেই কেটেছে আট বছর। ২০২৩ সালে আবার কয়লা আমদানি শুরু হয়েছে। এখন কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে।
Advertisement
প্রধান ফটকের কাছে গিয়ে সিকিউরিটি গার্ডের কাছে পরিচয় দেওয়ার পর গেট খুলে দেন। দেখা গেছে, ভেতরে আমদানি-রপ্তানির সব সুবিধা। একটু সামনেই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গাছুয়াপাড়া গ্রাম। স্থলবন্দর থেকেই ওই এলাকার ছোট ছোট ঘর দেখা যায়। ঘরগুলো আপনাকে মুগ্ধ করবে।
আরও পড়ুন: তুলা-সুতা-পাটের বর্জ্য রপ্তানি বন্ধ, বিপাকে ব্যবসায়ীরা
যেভাবে শুরু গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর
১৯৭৯ সালে কড়ইতলী ও ১৯৯৭ সালে গোবরাকুড়া শুল্ক স্টেশনের মধ্য দিয়ে ভারত থেকে কয়লা আমদানি শুরু হয়। কড়ইতলী ব্যবসায়ীদের নিয়ে কড়ইতলী কোল অ্যান্ড কোক ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন ও গোবরাকুড়া আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপ নামে দুটি সংগঠন করা হয়। এ দুটি সংগঠন কড়ইতলী-গোবরাকুড়া স্থলবন্দর নিয়ন্ত্রণ করে।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় ২০১২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। এরপর প্রায় ছয় বছর পার হলেও গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠেনি। পরে ২০১৮ সালের ১ জুলাই ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩১.১৪ একর জমির ওপর গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
চলতি বছরের ১১ মার্চ বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের আওতায় নির্মিত ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৭ মে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের গোবরাকুড়া অংশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নামাঙ্কিত উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন।
আরও পড়ুন: ৪ বছরেও অধরা ১৯ কেজি সোনা লুটের রহস্য
বন্দরের সীমানা প্রাচীর, অভ্যন্তরীণ সড়ক, ওপেন স্ট্যাক ইয়ার্ড, পার্কিং ইয়ার্ড, ৪০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ওয়্যারহাউজ, অফিস ভবন, ডরমেটরি ভবন, ব্যারাক ভবন ও পাওয়ার হাউজ, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, টয়লেট কমপ্লেক্স, আমদানি-রপ্তানি পণ্যের সঠিক পরিমাপের লক্ষ্যে ১০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন চারটি ডিজিটাল ওয়েব্রিজ স্কেলসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর দিয়ে প্রধানত কয়লা ও পাথর আমদানি হচ্ছে। তাছাড়া তাজা ফলমূল, গাছপালা, বীজ, গম, রাসায়নিক সার, চায়না ক্লে, কাঠ, চুনাপাথর, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, ফুল ঝাড়ু, ডাব, হলুদ, কাজুবাদাম, তেঁতুল, তিল, সরিষা, ভুসি, চালের গুঁড়া, গবাদিপশু ও মাছের পোনা আমদানির অনুমোদন রয়েছে। রপ্তানির অনুমোদন রয়েছে সিমেন্ট, প্লাস্টিক পণ্য ও শিশুখাদ্য।
যেভাবে চলছে বন্দরের কার্যক্রম
ভুটানসহ ভারতের সেভেন সিস্টারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে হালুয়াঘাটের গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। লক্ষ্য ছিল ভুটান-ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কয়লা, পাথর, মসলা, পেঁয়াজ, রসুন, বাঁশ, পোশাকসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি-রফতানি করা। কিন্তু এখন এ বন্দরের কার্যক্রম শুধু কয়লা আমদানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কয়লা আমদানির কার্যক্রম চলে ছয় মাস। বছরের বাকি সময় বন্দর থাকে কার্যত বন্ধ।
আরও পড়ুন: ১১০০ কোটি টাকায় প্রশস্ত হচ্ছে বারইয়ারহাট-রামগড় সড়ক
স্থলবন্দর সূত্র জানায়, গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর দিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬৯ হাজার ৬৮৮ মেট্রিক টন কয়লা আমদানি করা হয়েছে। জানুয়ারিতে ১৪ হাজার ১৫২ মেট্রিক টন, ফেব্রুয়ারিতে ১২ হাজার ৭৫৩ মেট্রিক টন, মার্চে ১৪৫ মেট্রিক টন, এপ্রিলে ১১ হাজার ৬২১ মেট্রিক টন, মে মাসে ১৫ হাজার ২৩৪ মেট্রিক টন এবং জুনে ১৭ হাজার ৭৮৩ মেট্রিক টন কয়লা আমদানি করা হয়েছে।
গোবরাকুড়া স্থলবন্দরের মাসুদ ট্রেড লিমিটেডের মালিক মাসুদ করিম শান্ত জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কয়লা ব্যবসায়ীদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। কারণ, একটি মামলার জন্য কয়লা আমদানি বন্ধ ছিল। তবে আদালত নির্দেশনা দেওয়ার কিছুদিন পর কয়লা এসেছে। আবার কিছুদিন পরে বন্ধ হয়ে গেছে। এভাবেই কেটেছে আট বছর। ২০২৩ সালে আবার কয়লা আমদানি শুরু হয়েছে। এখন কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে।’
গোবরাকুড়া আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের মহাসচিব অশোক সরকার অপু জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের অন্য পাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্য দিয়ে পণ্য আমদানি করতে হয়। এলাকাটা জঙ্গলের মতো হওয়ায় আমদানি করতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। যে কারণে শুধু কয়লা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছি। তবে, ফলমূল, মসলাজাতীয় কিছু পণ্য আমদানির চেষ্টা চলছে।
আরও পড়ুন: দুই মাস ধরে অচল বেনাপোল চেকপোস্টের স্ক্যানার মেশিন
গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত শুধু কয়লা আমদানি হয়েছে। অন্য কোনো পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়নি।
তিনি বলেন, বছরের বাকি ছয় মাস এখানে কোনো কাজ থাকে না। এ সময় শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা বেকার হয়ে পড়েন।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে পোর্টে কোয়ারেন্টাইন অফিস প্রয়োজন হয়। কোয়ারেন্টাইন অফিস আমাদের পোর্টে নেই। ভারতীয় অংশের পোর্টেও কোয়ারেন্টাইন অফিস নেই। যে কারণে কৃষিপণ্য আমদানি-রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে, এ বন্দর দিয়ে যাতে সবধরনের পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা যায়সে ই চেষ্টা করছি।
এসআর/এসএইচএস/জেআইএম