অর্থনীতি

রপ্তানিতে এগিয়ে টি-শার্ট-সোয়েটার, পিছিয়ে পড়ছে শার্ট-প্যান্ট

দুই যুগের বেশি সময় ধরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ওভেন (শার্ট, প্যান্ট) জাতীয় পোশাকের আধিপত্য ছিল। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। দেশে দেশে লকডাউনের কারণে ঘরের বাইরে পরার পোশাকের চাহিদা কমে ব্যাপকভাবে। এ জাতীয় পোশাকের ক্রয়াদেশও কমতে থাকে। অন্যদিকে ব্যাপকভাবে বাড়তে শুরু করে ঘরে পরার বা নিট পোশাকের (টি-শার্ট, সোয়েটার) চাহিদা। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় নিট পোশাক রপ্তানি বাড়তে থাকায় খুশি মালিকরা।

Advertisement

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) গত চার অর্থবছরের রপ্তানি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নিটের চেয়ে ওভেনের রপ্তানি বেশি ছিল ১৪ কোটি ডলার। ওই বছর এক হাজার ৪০৪ কোটি ডলারের বা ১৪ বিলিয়ন ডলারের ওভেন পোশাকের বিপরীতে নিট পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৩৯০ কোটি ডলার বা ১৩ বিলিয়ন ডলার। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে নিটের হিস্যা (অংশ)।

২০২০-২১ অর্থবছরে নিট থেকে আসে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার। আর ওভেন থেকে আসে ১৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। পোশাক খাত থেকে মোট আয় হয় ৩১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার।

আরও পড়ুন>> জুলাই-আগস্টে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১২.৪৬ শতাংশ

Advertisement

২০২২-২৩ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি থেকে আসে চার হাজার ৬৯৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার বা ৪৬ বিলিয়ন ডলার। যা তার আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) তুলনায় ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানির আয় ছিল চার হাজার ২৬১ কোটি ৩১ লাখ ডলার বা ৪২ বিলিয়ন ডলার।

ছবি: সংগৃহীত

২০২২-২৩ অর্থবছরে নিট পণ্যের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই হাজার ৫৬০ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে দুই হাজার ৫৭৩ কোটি ৮২ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৩২১ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ওভেন পণ্যের রপ্তানি আয় আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) তুলনায় ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই হাজার ১২০ কোটি ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে দুই হাজার ১২৫ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের। ২০২১-২২ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ৯৩৯ কোটি ৮৮ লাখ ডলার।

Advertisement

অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ওভেন পোশাকের তুলনায় ৪৩৫ কোটি ডলার নিট পোশাক বেশি বিক্রি হয়েছে। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ওভেনের তুলনায় নিট পোশাক বিক্রি বেশি হয়েছে ৩৮২ কোটি ডলার।

আরও পড়ুন>> ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে বেড়েছে পোশাক রপ্তানি

প্রায় দুই যুগ ধরে প্রতি অর্থবছর পোশাক রপ্তানিতে নিটের চেয়ে ওভেনের হিস্যা বেশি ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ওভেন পোশাক বিক্রি নিটের তুলনায় ৩৬ কোটি ডলার বেশি ছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যা ছিল ২৪ কোটি ডলার। পোশাক রপ্তানি শুরুর দিক থেকেই ওভেনের অংশ বেশি ছিল। ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে ১২০ কোটি ডলারের ওভেন পোশাক রপ্তানির বিপরীতে নিটের পরিমাণ ছিল মাত্র ২০ কোটি ডলার।

নিট পোশাকের প্রধান পাঁচ পণ্য হচ্ছে- টি-শার্ট, পলো শার্ট, ট্রাউজার, সোয়েটার ও জ্যাকেট। চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) দুই মাস জুলাই ও আগস্টে ৭৯৯ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। তৈরি পোশাক খাতের মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশ আর ওভেন পোশাকের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুলাই ও আগস্ট মাসে নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৪৫৮ কোটি ডলার, আর ওভেন ৩৫৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ নিট পোশাক বিক্রি বেশি হয়েছে প্রায় ৯৯ কোটি ডলার।

এ প্রসঙ্গে ফতুল্লা অ্যাপারেলসের স্বত্বাধিকারী ফজলে শামীম এহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (করোনা পরবর্তী সময়) সারাবিশ্বেই নিট জাতীয় পোশাকের চাহিদা বাড়তে শুরু করে। এখনো সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয়ভাবে নিটের কাঁচামাল সহজলভ্য হওয়াতে এর উৎপাদন খরচ কম, মুনাফাও তুলনামূলক ভালো হওয়ায় নিট উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ওভেনের কাঁচামাল সহজলভ্য হলে এ জাতীয় পোশাক উৎপাদন বাড়বে।’

আরও পড়ুন>> বন্যা-খরায় ৬৫০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হারাবে বাংলাদেশসহ ৪ দেশ

বর্তমানে পোশাক রপ্তানি করে যে আয় হয় তা মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছর রপ্তানির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানেও নিটের হিস্যা বেশি ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছর তৈরি পোশাক থেকে পাঁচ হাজার ২২৭ কোটি ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে নিটে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা দুই হাজার ৮৪৩ কোটি ডলার আর ওভেনে ধরা হয়েছ দুই হাজার ৩৮৪ কোটি ডলার।

ছবি: সংগৃহীত

সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা বলছেন, কর হারের ভিন্নতার কারণে নিট পোশাকে মুনাফা বেশি করতে পারছেন বিক্রেতারা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা সবসময় উষ্ণভাব বজায় রয়েছে। এ কারণে অফিস ও ঘরের বাইরে নিট পোশাকের ব্যবহার বেড়েছে। এছাড়া নিটের পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্প বা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প বেশ শক্তিশালী। এর ফলে নিট জাতীয় পোশাক রপ্তানি আদেশ পাওয়ার পর ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছানোর সময় বা লিড টাইম অনেক কম লাগে।

আরও পড়ুন>> তুলা-সুতা-পাটের বর্জ্য রপ্তানি বন্ধ, বিপাকে ব্যবসায়ীরা

নিট রপ্তানি বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগামীতে ওভেনের চেয়ে নিটের চাহিদা এবং রপ্তানি আরও বাড়বে। কারণ নিটের ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে। আবার কৃত্রিম তন্তু বা ম্যানমেইড ফাইবার পোশাকের একটা বড় অংশই নিট ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত বিশ্বজুড়ে এখন ম্যানমেইড ফাইবারের পণ্যের চাহিদা ও মূল্য বেশি। ম্যানমেইড পোশাকের মূল্যও অনেক বেশি। এসব কারণে রপ্তানিতে নিটের হিস্যা আগামীতে আরও বাড়বে।

এসএম/ইএ/জেআইএম