রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগের ২৬তম শাখা সম্মেলন ১৮ সেপ্টেম্বর। গত কমিটির মতো এবারও কি রাজশাহীর স্থানীয়দের হাতেই থাকবে রাবি শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ দুটি পদ- এ নিয়ে চলছে রাজশাহী জেলা বা অঞ্চলের বাইরের পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীদের জল্পনা-কল্পনা।
Advertisement
তথ্য বলছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে রাজশাহীর বাসিন্দাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ রাজশাহী জেলা বা অঞ্চলের বাইরে থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই পদের নেতৃত্বে আসতে পারছেন না। ফলে সারাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে এলেও ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থাকছে শুধুই লোকালদের হাতে।
অন্যদিকে স্থানীয়রা নেতৃত্বে থাকায় ক্যাম্পাসে অছাত্র ও বহিরাগতদের প্রভাব বাড়ছে। বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে মাদক কারবার, চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিংসহ নানা অপকর্ম করছেন। এরপরও লোকাল বা স্থানীয় পরিচয় দিয়ে বীরদর্পে ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা।
যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি না হওয়ায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের শীর্ষ পদগুলো পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন রাবি শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিগত কয়েক বছরের সমীকরণে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্বাহী কমিটিতে দু-একজন নেতাকর্মী পদ পেলেও তাদের অবস্থান তালিকার একদম নিচের সারিতে।
Advertisement
আরও পড়ুন: অছাত্র-চাঁদাবাজরা হতে চান রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক!
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্বশেষ ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেয়েছেন রাবি ছাত্রলীগের মাত্র একজন নেতা। তাও আবার সবার শেষের সহ-সম্পাদক পদটি। রাবি শাখা ছাত্রলীগ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইউনিট হলেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পাওয়ার মতো নেতা এখানে খুব একটা তৈরি হচ্ছে না।
জানা গেছে, আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর রাবি ছাত্রলীগের সম্মেলন। এ সম্মেলনের মাধ্যমে দীর্ঘ সাত বছর পর নতুন নেতৃত্ব পেতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। তবে এবারও শীর্ষ দুই পদে আলোচনায় আছে ডজন খানেক লোকাল নেতার নাম। বাইরের জেলা থেকে আসা কয়েকজন নেতৃত্বের দৌড়ে থাকলেও শীর্ষ দুই পদে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অতীতে রাজশাহীর বাইরে থেকে যারা রাবি ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এমন অনেকেই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে নেতৃত্ব দিয়ে এখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিক। তার বাড়ি বগুড়ায়। তিনি রাবি ছাত্রলীগের ১৯তম কমিটিতে (১৯৯৭-২০০২) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য।
Advertisement
মাগুরা-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাড়ি মাগুরায়। তিনি রাবি ছাত্রলীগের ১৮তম কমিটিতে (১৯৯৪-৯৭) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর এপিএসের দায়িত্ব পালন করেছেন। এমন আরও অনেকেই রাবি ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যারা রাজশাহীর বাইরের জেলার বাসিন্দা। পরবর্তী সময়ে তারা জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতি করছেন।
বর্তমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম সদস্য আবু হোসাইন বিপু। তিনি রাবি ছাত্রলীগের ২৩তম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী।
এদিকে, রাবি ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটিতে সভাপতির দায়িত্ব পান গোলাম কিবরিয়া। তার বাড়ি রাজশাহী মহানগর সংলগ্ন বুধপাড়া এলাকায়। অন্যদিকে, সাধারণ সম্পাদক হন ফয়সাল আহমেদ রুনু। তার বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটাতে।
১৯৬২ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাবি ছাত্রলীগের ২৫টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৯৬২ সাল থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ছাত্ররা রাবি ছাত্রলীগের হাল ধরেছেন। কিন্তু ২০০০ সালের পর সেটা ক্রমান্বয়ে কমে উত্তরাঞ্চল তথা বৃহত্তর রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: প্রক্সিকাণ্ডে জড়িত রাবি ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার
এদিকে, ২০০৪ সালের পর থেকে রাজশাহী বিভাগের আট জেলার ছাত্রলীগের কর্মীরা রাবি শাখার গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। ২০১০ সালের পর পদগুলোর বণ্টন আরও সংকুচিত হয়ে রাজশাহী জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ২০১৩ সালের পর থেকে বর্তমান ছাত্রলীগের কমিটিতে যারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন, তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকার। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ২৫তম কমিটির শীর্ষ দুই পদ রাজশাহী জেলা থেকে আরও সংকীর্ণ হয়ে মহানগরের অভ্যন্তরে চলে আসে।
এ নিয়ে আসন্ন সম্মেলনেও শীর্ষ দুই পদ পাওয়া নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী নয় রাজশাহীর বাইরে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে রাজনীতিতে জড়ানো ছাত্রলীগকর্মীরা। তারা বলছেন, ক্যাম্পাসে ভালো অবস্থান থাকলেও স্থানীয় বাসিন্দা না হওয়ায় নেতৃত্বের দৌড়ে পিছিয়ে তারা। স্থানীয়ভাবে প্রভাব রয়েছে- এমন প্রার্থীদের শীর্ষ পদগুলোতে রাখা হয়।
পদের দৌড়ে এবারও এগিয়ে স্থানীয়রা১৮ সেপ্টেম্বর সম্মেলনে পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে আলোচনায় আছেন কাজী আমিনুল হক (লিংকন)। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেহেরচন্ডি এলাকার বাসিন্দা। শাহিনুল সরকার ডনের বাসা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বুধপাড়ায়। আসাদুল্লাহ-হিল-গালিবের বাসাও মহানগরীর ভদ্রা এলাকায়। সাকিবুল হাসান বাকির বাসা ক্যাম্পাসঘেঁষা বিনোদপুরে। আর মেহেদী হাসান মিশুর বাড়ি রাজশাহীর কাটাখালী পৌর এলাকায়। সম্মেলনে ৯৪ জন প্রার্থীর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকার স্থানীয় আরও অন্তত পাঁচজন পদপ্রত্যাশী রয়েছেন।
রাজশাহীর বাহির থেকে দৌড়ে এগিয়ে আছেন মেজবাহুল ইসলাম। তারা বাসা দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলায়। তাওহীদুল ইসলাম দুর্জয়ের বাসা কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায়। মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর বাসা জয়পুরহাট সদর উপজেলায়। ফয়েজ আহমেদের বাসা সিলেটে। এছাড়া আরও তিন-চারজন পদপ্রত্যাশী রয়েছেন যাদের বাড়ি রাজশাহীর বাইরে।
রাবি ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবু। তার বাসা জয়পুরহাটে। তিনি ২৬তম শাখা ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজশাহীর স্থানীয় বা বাহিরের বিষয়টি বিবেচ্য হবে না বলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আগামী দিনে রাবি ছাত্রলীগকে আরও বেশি সংগঠিত করে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারবেন তেমন যোগ্য প্রার্থীদেরই মূল্যায়ন করা হবে বলে আমরা শতভাগ আশাবাদী।
রাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, রাজশাহীর বাইরের ছেলেরা যদি যোগ্য থাকে, তাহলে সমতার ভিত্তিতে অবশ্যই তাদের নেতৃত্বে আনা উচিত। অর্থের বিনিময়ে নয়, যোগ্যদের নেতৃত্বে আনতে হবে। সামনে জাতীয় নির্বাচন, এ মুহূর্তে যদি ভালো নেতৃত্ব না আসে এবং ছাত্রলীগকর্মীদের মধ্যে হতাশা কাজ করে, তাহলে নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে।
আরও পড়ুন: চবিছাত্রকে জিম্মি করে রাবি ছাত্রলীগ নেতাদের চাঁদাবাজির অভিযোগ
২৩তম রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইন বিপু জাগো নিউজকে বলেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা টেনে আনা দলের জন্য ক্ষতিকারক। প্রার্থী যদি যোগ্যতাসম্পন্ন হয় তাহলে আঞ্চলিকতার জন্য কেন বাদ পড়বে? ছাত্রলীগের শীর্ষ পদের জন্য যারা যোগ্য তাদের হাতেই নেতৃত্ব তুলে দেওয়া উচিত বলে আমি করি। এক্ষেত্রে স্থানীয় বা অন্য কোন অঞ্চলের বাসিন্দা এটা বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত নয়।
তবে স্বচ্ছ ইমেজ রয়েছে এমন যোগ্য নেতাকর্মীরাই শীর্ষপদের জন্য বিবেচিত হবেন সেখানে আঞ্চলিকতা কোনো বিষয় নয় বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের কাছে যারা গ্রহণযোগ্য; শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য যাদের দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব ও স্বচ্ছ ইমেজ রয়েছে এবং যারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আপসহীন দুর্গ হিসেবে গড়ে তুলবে তারাই রাবি ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসবে।
এমআরআর/জেআইএম