# ৪ নভেম্বর ক্রুড, ৯ নভেম্বর ডিজেল খালাসের পরিকল্পনা# প্রথম কমিশনিংয়ে ক্রুড খালাস হয়েছে ৫ ঘণ্টা# এসপিএমের সঙ্গে আটকানো জাহাজের মুরিং হোসার ছিঁড়ে যাওয়ায় বিপত্তি
Advertisement
প্রথমবার হোঁচট খাওয়ার পর এবার যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এসপিএম (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) অপারেশনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়েছে। সূচি অনুযায়ী আগামী ৪ নভেম্বর ক্রুড অয়েল এবং ৯ নভেম্বর পরিশোধিত ডিজেল খালাসের প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এজন্য আলাদা জাহাজে ক্রুড ও ডিজেল আমদানির প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত করেছে দেশে জ্বালানি আমদানি, পরিশোধন ও বিপণন নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি। ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিপিসির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি।
বর্তমানে এক লাখ টনের ক্রুড অয়েলবাহী একটি মাদার ভেসেল খালাস নিতে সময় লাগে কমপক্ষে ১১ দিন। সেখানে এসপিএম পুরোদমে চালু হলে ২৮ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিজেল ও ক্রুড অয়েলবাহী জাহাজ খালাস করা সম্ভব হবে। এতে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছে বিপিসি। তবে প্রাথমিক অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হলেও পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হতে সময় লাগবে আরও কয়েক মাস। বর্তমান অবস্থায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা আগামী বছরের ৩০ জুন।
আরও পড়ুন: ২৮-৪৮ ঘণ্টায় খালাস হবে ডিজেল ও ক্রুড অয়েল
Advertisement
এর আগে, গত ৩ জুলাই ক্রুড অয়েলের প্রথম কমিশনিং শুরুর ৫ ঘণ্টা পর বন্ধ করে দেওয়া হয়। মূলত এসপিএমের সঙ্গে আটকানো জাহাজের মুরিং হোসার (রশি) ছিঁড়ে যাওয়ায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা খালাস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। বিপিসির একাধিক সূত্র এমনটিই জানায়। এরপর সনাতন পদ্ধতিতেই লাইটারিংয়ের মাধ্যমে ‘এমটি হোরে’ নামের জাহাজ খালাস করে বিপিসি। মূলত এসপিএমের সঙ্গে আটকানো জাহাজের মুরিং হোসার ছিঁড়ে যাওয়ায় বিপত্তি তৈরি হয়। তেল খালাসের ভাসমান হোস পাইপ ফেটে গেলে সাগরে কিছুটা ক্রুড অয়েল ছড়িয়ে পড়ে।
এসপিএম প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এবং ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত জাগো নিউজকে বলেন, ‘এসপিএম প্রকল্পে ক্রুড অয়েলের প্রথম ফিলিংয়ে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। যেকোনো নতুন যান্ত্রিক প্রকল্প কমিশনিংয়ে বিপত্তি হতে পারে। তবে নতুন করে কমিশনিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আগামী ৪ নভেম্বর ক্রুড অয়েল এবং ৯ নভেম্বর ডিজেল খালাসের সিডিউল চূড়ান্ত। এখন ক্রুড ও ডিজেল আমদানির পদক্ষেপ নিচ্ছে বিপিসি।’
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) এখন ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত জ্বালানি তেল) পরিশোধন ক্ষমতা বছরে ১৫ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে নির্মাণাধীন ইউনিট-২ প্রকল্প চালু হলে ইআরএলের ক্রুড অয়েল পরিশোধন ক্ষমতা বছরে ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়াবে।
আরও পড়ুন: পাইপ লাইনে তেল খালাসে ত্রুটি, ফিরছে লাইটারিংয়ে
Advertisement
অন্যদিকে দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বছরে প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল আমদানি করতে হয়। বঙ্গোপসাগরের কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্য ৮ মিটার থেকে ১৪ মিটারের নিচে হওয়ায় অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে ক্রুড অয়েলবাহী বড় ভেসেল হ্যান্ডেল করতে পারে না চট্টগ্রাম বন্দর। যে কারণে ক্রুড অয়েলবাহী মাদার (বড়) ভেসেলগুলো গভীর সমুদ্রে নোঙর করা হয়। মাদার ভেসেল থেকে লাইটারেজ করে ক্রুড আনলোড করা হয়। লাইটারেজ ব্যবহার করে ক্রুড অয়েল আনলোড করা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। এ অবস্থায় আমদানি করা জ্বালানি খালাসে ব্যয় ও সময় বাঁচানোর পাশাপাশি নিরাপত্তা বাড়াতে উদ্যোগ নেয় সরকার। তারই ফলস্বরূপ সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) সহ পাইপলাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারির মাধ্যমে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় বিপিসি। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে সময়ক্ষেপণে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে যায় কয়েকগুণ। কয়েকবার সংশোধিত হয়ে ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট ৫ হাজার ৪২৬ কোটি ২৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকার প্রকল্পটির প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। প্রশাসনিক অনুমোদনের পর ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের (সিপিপিইসিএল) সঙ্গে চুক্তি করে বিপিসি। প্রায় দেড় বছর পর ২০১৮ সালের ১৪ মে থেকে কাজ শুরু করে ইপিসি ঠিকাদার।
প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর ২০২০ সালের ৬ জুলাই প্রথম দফায় সংশোধিত হয়ে ব্যয় বাড়ে এক হাজার ১৪২ কোটি টাকা। পরে মাতারবাড়ী চ্যানেল ঝুঁকিমুক্ত করতে প্রায় দেড় কিলোমিটার পাইপলাইন সমুদ্রতটের ৩০ ফুট গভীরে বসানো হয়। এর ফলে দ্বিতীয় দফায় আরও ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ে। ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে তৃতীয় দফায় ১৯৬ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ৭ হাজার ১২৪ কোটি টাকায়। গত অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ডলার সংকটের প্রভাব পড়ে এসপিএম প্রকল্পে। এ অবস্থায় চতুর্থ দফায় প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ৪র্থ দফার এ সংশোধনীতে প্রায় এক হাজার ২১৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৪১ কোটি টাকায়। যদিও কাজের শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।
আরও পড়ুন: এক জাহাজ তেল খালাসে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ২ দিন
বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে জি টু জি ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে প্রকল্পটি। এতে বৈদেশিক সহায়তা দিচ্ছে চায়না এক্সিম ব্যাংক।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পে এসপিএম নির্মাণের পাশাপাশি মহেশখালীর মাতারবাড়ী উপকূলে ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি ক্রুড অয়েল স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পে রয়েছে ৩০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি ডিজেল স্টোরেজ ট্যাংক। পাশাপাশি মহেশখালীতে তৈরি করা হয়েছে পাম্প স্টেশন, স্কাডা সিস্টেম এবং ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম। প্রকল্পের মূল কাজের অংশ হিসেবে মোট ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে অফশোরে ১৪৬ কিলোমিটার এবং অনশোরে পাইপলাইন রয়েছে ৭৪ কিলোমিটার।
প্রকল্পে কুতুবদিয়া চ্যানেল এবং মাতারবাড়ী অ্যাপ্রোচ চ্যানেল অংশে ডিপ পোস্ট ট্রেন্সিং পদ্ধতিতে চারটি পাইপলাইন সমুদ্রতটের ৩০ ফুট গভীরে স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া মহেশখালীর ধলঘাটায় একটি, চট্টগ্রামের গহিরায় একটি, ডাঙ্গারচরে একটি ব্লক বাল্ব স্টেশন এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে মাইক্রোওয়েভ রিলে টাওয়ারের কাজও শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, গত ৩ জুলাই এসপিএম প্রকল্পে ফার্স্ট ফিলিং কার্যক্রমের সময় বৈরী আবহাওয়ার কারণে সাগর উত্তাল ছিল। যে কারণে এসপিএমের সঙ্গে জাহাজটিকে আটকে রাখা মুরিং হোসার ছিঁড়ে গেলে বাধে বিপত্তি।
আরও পড়ুন: বছরে খালাস হবে ৯ মিলিয়ন টন তেল, বাঁচবে ৮০০ কোটি টাকা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, এসপিএম এবং জাহাজটি একটি মুরিং হোসারের মাধ্যমে সাগরের বয়ার সঙ্গে স্থিরভাবে আটকে রাখা হয়। এরপর ভাসমান হোস পাইপের মাধ্যমে এসপিএমের মাধ্যমে জাহাজ থেকে খালাস করা হয় তেল। কিন্তু ৩ জুলাই সকাল সোয়া ১০টায় এসপিএম অপারেশন শুরু হয়। বিকেল তিনটার কিছু সময় পরে মুরিং হোসারটি ছিঁড়ে যায়। এতে তেল খালাসের ভাসমান হোস পাইপটি ফেটে গিয়ে তেল সাগরে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে এসপিএম অপারেশন বন্ধ হয়ে যায়।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, কিছু তেল সাগরে পড়লেও তা ছড়াতে দেওয়া হয়নি। সাগরে পড়া ভাসমান তেল প্রকল্পের নিজস্ব ম্যাকানিজমের মাধ্যমে তুলে নেওয়া হয়। তবে কী পরিমাণ তেল সাগরে পড়েছে, সে তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
আরও পড়ুন: অর্থপাচার হয়, বিপিসি কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. লোকমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগামী নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এসপিএম কমিশনিং শুরু হবে। এবার ক্রুড এবং ডিজেল- দুটোই কমিশনিং হবে। সফল কমিশনের পর এসপিএমের পুরোপুরি অপারেশন শুরু হলে ২৮ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিজেল ও ক্রুড অয়েলবাহী জাহাজ খালাস করা সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘ইস্টার্ন রিফাইনারির ৩০ লাখ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল পরিশোধনের আরেক প্রকল্প ইআরএল-২। শিগগির ইআএল-২ প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হতে পারে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ইস্টার্ন রিফাইনারির ক্রুড পরিশোধন ক্ষমতা বেড়ে ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়াবে। এতে এসপিএম প্রকল্পের ভালো সুফল পাওয়া যাবে। পাশাপাশি এসপিএম দিয়ে তেল খালাসে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার মতো সাশ্রয় হবে।’
এমডিআইএইচ/কেএসআর/এএসএম