তনুর ছবিটা যতবারই দেখি, বুকের ভেতর কেমন দুমড়ে মুচড়ে যায়। এই মেয়েটির সঙ্গে আমার তিনটি মিল- আমরা দুইজনই হিজাবী, আমরা দুইজনই নারী, আমাদের দুইজনের দেশই বাংলাদেশ। আচ্ছা, তনুকে কেন খুন করা হলো? তার অপরাধটা কী? এদেশে নারী হয়ে জন্মানোই যদি অপরাধ হয়, তবে তো তনুর পরে আমার খুন হওয়ার কথা! হয়তো হবোও। আজ সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতে গিয়ে আমি যে ধর্ষকের হাতে খুন হবো না, তার নিশ্চয়তা কি আপনি দিতে পারবেন?
Advertisement
যারা বলেন, ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক দায়ী, তারা এবার কী বলবেন? তনু তো হিজাব পরতো। `ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক দায়ী` বলে যারা ধর্ষকের পক্ষে নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব করেন, তাদের কাছে যুক্তি খণ্ডানোর মতো ধৈর্য্য এবং ইচ্ছে আমার নেই। এদেশের অধিকাংশ মানুষই এখন শিক্ষিত হচ্ছেন। কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছেন পড়াশোনার পেছনে। কিন্তু প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার জন্য যে মানবিক শিক্ষা আমাদের দরকার, তা কি আমরা পাচ্ছি! পাচ্ছি না অথবা শিখছি না। এখন বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরাও তাদের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কাছে নিরাপদ নয়। পরিমলের সংখ্যা এদেশে শুধু একজন নয়, কতশত পরিমল আড়ালে থেকে যায়, তার খবর কে রাখে! সম্মান, ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া- সবকিছু ছাপিয়ে যৌনতাই যেন হয়ে উঠেছে পরম আরাধ্য!
তনুকে ধর্ষণ করলো, ধর্ষণের পরে হত্যা করলো। তাও আবার ক্যান্টনমেন্টে, নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই। কিছুদিন আগেই সংসদ ভবন এলাকায় ধর্ষণের পর হত্যা করা হলো গৃহকর্মী কিশোরী জোনিয়াকে। অপরাধীরা যেন টের পেয়ে গেছে, তাদের কিছুই হবে না! তাই পাঁচ-দশ মিনিটের পাশবিক আনন্দের জন্য ধর্ষণ আর তারপরে মেরে ফেলো! এযেন শিশুর হাতে পুতুল, মোচড় দিয়ে মুণ্ডু আলাদা করে ফেললেও কেউ কিছু বলবে না! আসলে কি তাই? মানুষ কি পুতুল? মানুষ তো মানুষই। যাকে মেরে ফেলা হলো, সেও মানুষ। যে মেরে ফেললো, তারও হাত পা চোখ নাক মুখ অবিকল মানুষের মতো! হ্যাঁ, মানুষের মতো, তবে মানুষ নয়। হাত পা চোখ নাক মুখ থাকলেই সবাই মানুষ হয় না। মানুষ হওয়ার জন্য সবচেয়ে যে জিনিসটি জরুরি তা হলো মনুষ্যত্ব। একজন শিশু যখন জন্ম নেয়, সে অপরাধী হয়ে জন্ম নেয় না। পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে সে শিক্ষা গ্রহণ করে ধীরে ধীরে মানুষ অথবা অমানুষ হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের অতিরিক্ত আহ্লাদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুশিক্ষা না পাওয়া, আইনের কার্যকারিতা না পাওয়া একজন মানুষকে ধীরে ধীরে অমানুষ করে তোলে! আর সেইসব অমানুষেরাই সুযোগ বুঝে তনুদের ধর্ষণ করে হত্যা করে।
তনু তো আমারই মতো একজন মেয়ে। আমি যেভাবে স্বপ্ন দেখি, বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করি, তনুও তো তাই করতো। তনু সংস্কৃতিকর্মী ছিল, কত নাট্যমঞ্চে সে আলোকবর্তিকা হাতে আশার আলো ছড়িয়ে গেছে, অথচ জীবনের নাট্যমঞ্চে তাকেই ধর্ষণ করা হলো, খুন করা হলো! এদেশে হাজার কোটি টাকার ব্যাংক কেলেংকারি করেও বুক ফুলিয়ে চলা যায়, দিনে দুপুরে গুম, খুন, ধর্ষণ করেও বুক ফুলিয়ে চলা যায়, অথচ তনুরা বাঁচতে পারে না! তনুদের চলে যেতে হয়! দেশটা কি তবে অমানুষের রাজ্য হয়ে যাচ্ছে! এই যে তনু চলে গেল, আমরা কিছুদিন হৈ চৈ করে ভুলে যাবো তনুর কথা। যেমন ভুলে গেছি রুমি, সিমি, ইলোরা, ইয়াসমিন, জোনিয়াদের কথা। বিচার কী হবে? ধরলাম ধর্ষকের ফাঁসি হলো, তাতেই কি পরিপূর্ণ বিচার হবে? তনুর সঙ্গে সঙ্গে যে কতগুলো স্বপ্নকে হত্যা করা হলো, তনুর মা-বাবা, প্রিয়জনের বাকি জীবনের সবটুকু শান্তি যে কেড়ে নেয়া হলো তার বিচার কে করবে! তনুর মায়ের যখন ভাত খেতে গিয়ে মনে পড়বে, মেয়েটা আমার পানির তৃষ্ণায় বুঝি ছটফট করছিল, তখন তনুর মায়ের বুকের আগুন কে নেভাবে?
Advertisement
তাহলে কি? তনুর পরে কি আমি? আমাকে ক্ষমা করবেন। আজ থেকে আমি আর নিজেকে নিরাপদ মনে করবো না। আমার চারপাশের প্রিয় পুরুষেরাই যে রাতের আঁধারে হায়েনা হয়ে উঠবে না, তার নিশ্চয়তা আমি কার কাছ থেকে পাবো! `খাবার ঢেকে না রাখলে মাছি তো পড়বেই`, অথবা `খোলা খাবারে কুকুর মুখ দেবেই` বলে যে পুরুষেরা যুক্তি দেখান; তাদের জেনে রাখা উচিৎ, নারী কোনো খাদ্যবস্তু নয় এবং পুরুষও মাছি কিংবা কুকুরের মতো কোনো প্রাণি নয়। নারী-পুরুষ উভয়েই মানুষ। তাই মানুষ হয়ে মানুষের নিরাপত্তাটুকু নিশ্চিত না করতে পারলে আপনি কীসের মানুষ! আমার এই লেখাটির শিরোনাম মিথ্যে হোক। তনুর পরে আর কোনো নারী যেন এমন খবরের শিরোনাম না হয়। আর কারো স্বপ্ন যেন এভাবে ধুলোয় না মিশে যায়।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
এইচআর/পিআর
Advertisement