দিন যত যাচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যাও তত বাড়ছে। দেশজুড়ে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফ্লুইড স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। কারণ ডেঙ্গুরোগীর চিকিৎসায় ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত আইভি (ইন্ট্রাভেনাস) স্যালাইন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিপুল পরিমাণ স্যালাইনের চাহিদা তৈরি হওয়ায় সারাদেশেই তৈরি হয়েছে সংকট। এতে বিপাকে পড়েছেন রোগীরা।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাধারণত ওরিয়ন ফার্মা, পপুলার ফার্মা, বেক্সিমকো ফার্মা, অপসো স্যালাইন, লিব্রা ইনফিউশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো স্যালাইন উৎপাদন করে। এরমধ্যে ওরিয়ন ফার্মা সরকারি হাসপাতালে স্যালাইন সাপ্লাই দিচ্ছে। অন্যদিকে, বেসরকারি হাসপাতালগুলো পপুলার, বেক্সিমকো ফার্মা থেকে কিছু কিছু স্যালাইন পাচ্ছে। অপসোর স্যালাইন, লিব্রার স্যালাইন বাজারে তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না।
সরেজমিনে রাজধানীর বাড্ডা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সাধারণ কোনো ফার্মেসিতে আইভি স্যালাইন খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকেই স্যালাইন কিনতে এসে ফিরে যাচ্ছেন। তবে ব্যতিক্রম দেখা গেছে হাসপাতালের ফার্মেসিতে। সেখানে স্যালাইনের সরবরাহ কম থাকলেও নির্ধারিত মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে স্যালাইন।
রাজধানীর বাড্ডার এএমজেড হাসপাতালের ফার্মেসিতে স্যালাইন কিনতে এসেছেন সাইদ হোসেন। তার সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তিনি বলেন, তার বোন ডেঙ্গু আক্রান্ত। বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। এখন আগের তুলনায় সুস্থ, তবে শরীর অনেক দুর্বল। খেতে পারছেন না। প্লাটিলেট আগের তুলনায় বাড়ছে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শে স্যালাইন দিচ্ছি। আশপাশের ফার্মেসিগুলোতে স্যালাইন পাওয়া যায়নি। পরে এক ফার্মেসির কর্মচারীর পরামর্শে এখানে এসেছি।
Advertisement
আরও পড়ুন>> মশা মেরে শেষ করা যাবে না, নিজেদের সচেতন হতে হবে: প্রধানমন্ত্রী
কথা হলে বাড্ডার ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক ও কনসালটেশন সেন্টারের পাশে অবস্থিত মইন ফার্মার স্বত্বাধিকারী মো. আবুল মনসুর বলেন, কোম্পানিগুলো সাপ্লাই দিতে পারছে না। চাহিদা থাকলেও জোগান নেই পর্যাপ্ত।
ইবনে সিনার ফার্মেসিতে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। সেখানে কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইবনে সিনা হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হলে স্যালাইন ব্যবস্থা করে দিতে হয়। কিন্তু সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর কাছে ৫০০ স্যালাইনের চাহিদা দেওয়া হলে পাওয়া যায় ৫০টি। কোম্পানিগুলো স্যালাইন সাপ্লাই দিতে পারছে না।
বাড্ডা এলাকায় ২০টির বেশি ফার্মেসি ঘুরে পাওয়া যায়নি স্যালাইন। তবে, বাড্ডা জেনারেল হাসপাতালের পাশে অবস্থিত গুড লাইফ ফার্মেসিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে ৫টি স্যালাইন আছে। দোকান কর্মচারী জানান, আমরা অনেক চেষ্টা করেও পাইনি স্যালাইন। অনেক চেষ্টার পর কোম্পানির কাছ থেকে এক কার্টন মিলেছে।
Advertisement
বাড্ডা জেনারেল হাসপাতালে এলাকার অনেক ডেঙ্গুরোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। বর্তমানে ২০ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ঠিকমতো স্যালাইন দেওয়া যাচ্ছে কি না জানতে চাইলে হাসপাতালের ম্যানেজার অভিনাস জাগো নিউজকে বলেন, আমরা কোম্পানিগুলো থেকে সাপ্লাই পেয়ে থাকি। কম পেলেও হাসপাতালে রোগীদের জন্য সংকট নেই। আমরা নির্ধারিত দামেই কোম্পানি থেকে নিচ্ছি।
বাড্ডা এলাকার এএমজেড হাসপাতালেও ডেঙ্গুরোগী ভর্তি আছে। এ হাসপাতালের ফার্মেসিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে স্যালাইনের সাপ্লাই আছে। চাহিদার তুলনায় কম সাপ্লাই দিচ্ছে। হাসপাতালের ফার্মেসিতে কর্মরত নাজমুল বলেন, আমরা কোম্পানিতে সরাসরি অর্ডার করি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অর্ডার দিচ্ছি ৫০০টি, পাচ্ছি ৪০ থেকে ৫০টি।
আরও পড়ুন>> মশা একবার উড়ে গেলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
তিনি আরও বলেন, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখি কারখানা থেকে ডিপোতেই স্যালাইন আসছে কম। সরকারি হাসপাতালগুলোতে সাপ্লাই দিচ্ছে কোম্পানিগুলো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ফার্মেসি কর্মচারী বলেন, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান মিটফোর্ড থেকে বেশি দামে স্যালাইন কিনে বেশি দামে বিক্রি করছে। এর কারণ ফার্মেসিগুলোতে স্যালাইন না দিয়ে হাসপাতালে সাপ্লাই দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। কারণ সেখানে ক্রিটিকাল রোগী ভর্তি থাকে। তাদের জন্য এ স্যালাইন বেশি জরুরি। মিটফোর্ডের কিছু ব্যবসায়ী বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে স্যালাইন সংগ্রহ করে তা খুচরা দোকানিদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে। তারাই পরে খুচরা পর্যায়ে দাম বেশি রাখে। অন্যথায় সাধারণ ফার্মেসিতে অনেক দিন ধরে স্যালাইনের সাপ্লাই নেই।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে ভর্তি রোগীরা ঠিকমতো স্যালাইন পাচ্ছেন। স্যালাইনের সংকট নেই। ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) বিভিন্ন ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানি থেকে স্যালাইন সংগ্রহ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে সাপ্লাই দিচ্ছে।
সাধারণ রোগীরা ফার্মেসি ঘুরেও স্যালাইন পাচ্ছেন না। এতে বিপাকে পড়েছেন বাসায় চিকিৎসা নেওয়া ডেঙ্গুরোগীরা। যেসব বেসরকারি বা সরকারি হাসপাতালে স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে তারা বাইরের রোগীদের কাছে বিক্রি করতে চায় না। এর কারণ হিসেবে তারা বলছে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
আরও পড়ুন: স্যালাইনে লেখা দাম থেকে এক টাকাও বেশি নেওয়া যাবে না
তবে বাজারে স্যালাইনের সংকট রয়েছে বিষয়টি মানতে নারাজ ভোক্তা অধিকার। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেছেন, সারাদেশে ডেঙ্গুরোগী বেড়ে যাওয়ায় মূল্যবৃদ্ধিসহ স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। এমনিতে কোনো সংকট নেই। কোম্পানিগুলো ২৪ ঘণ্টা উৎপাদন করছে। সংকট হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে কিছু ব্যক্তির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আশরাফ উদ্দিন বলেন, স্যালাইনের সংকট হওয়ার কথা নয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। যারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এএএম/এমএএইচ/এমএইচআর/জিকেএস