মতামত

শেখ হাসিনার রাজনীতিতে শেখ রেহানার অবদান

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট কন্যা শেখ রেহেনার আজ জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালোদিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল, যা ছিল জাতির জন্য লজ্জাকর।

Advertisement

সেই ভয়ংকর সময়ে বিদেশে অবস্থান করার কারণে বঙ্গবন্ধুর দুই আদরের কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহেনা ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। এরপর নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা তার বাবার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের রাজনীতির নেতৃত্বে আসেন, যা আমাদের জন্য ছিল পরম পাওয়া। সেই প্রিয় মানুষ ও নেত্রীকে সর্বদা সহযোগিতা ও সমর্থন করে যাচ্ছেন শেখ রেহানা।

১৯৮১ সালে সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দীর্ঘ ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে ১৭ মে ১৯৮১ সালে তিনি নিজ দেশে ফিরে আসেন। ওইদিন ঐতিহাসিক দিন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জনের পর ৭ জানুয়ারি ২০১৯ সালে চতুর্থ বারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা। এর আগে তিনি তিনবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

রাজনৈতিক জীবনের শুরুর পথটা শেখ হাসিনার খুব মসৃণ ছিল না। পরিবার হারানোর পর থেকে সবকিছু বদলে যায় এই দুই বোনের জীবনে। যে সময়ে তারুণ্যের জয়গান গেয়ে তাদের উচ্ছ্বসিত হওয়ার কথা, সেই সময় তারা দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, শপথ নিয়েছিলেন তাদের পরিবারের হত্যার বিচারের। কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে তাদের টিকে থাকার লড়াই করতে হয়েছিল। জীবন নিয়ে ভয় আতঙ্কের পাশাপাশি নোংরা রাজনীতির করাল গ্রাস তাদের তাড়া করে ফিরেছে। কিন্তু কোনো কিছুই তাদের দমাতে পারেনি। শক্ত হাতে দুই বোন সামলে নিয়েছেন সব পরিস্থিতি। সেই সংকটাপন্ন সময়ে ছোট বোন শেখ রেহানা হয়েছিলেন শেখ হাসিনার লড়াই করার অনুপ্রেরণা।

Advertisement

বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে যিনি সবসময় পাশে থেকেছেন, অভয় দিয়েছেন, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব। তেমনি ছোট বোন শেখ রেহানা জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণের জন্য মায়ের মতো করে বড় বোন শেখ হাসিনার পাশে থেকে সাহস, পরামর্শ, শক্তি ও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন সর্বদা। বঙ্গবন্ধু যেমন সবসময় দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা ভাবতেন, দেশের মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তেমনিভাবে তার দুই সুযোগ্য কন্যা তার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার লক্ষে নিয়মিত সময় ও কষ্ট করে যাচ্ছেন। শেখ রেহেনা এমন একজন মহীয়সী নারী রাজনীতিতে যার অবদান সুবিশাল। তার এই বিশাল ভূমিকা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জীবনকে করেছে আলোকিত। শেখ রেহানাকে বেগম মুজিবের প্রতিচ্ছবি হিসেবে কেউ কেউ আখ্যায়িত করছেন। তিনি সবসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর সঠিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অন্য রাজনীতিবিদদের পাশে থেকেছেন, নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।

১৫ আগস্টের ভয়াবহতা শেখ রেহানাকে যেমন দুর্বল করে তুলেছিল তেমনভাবে গড়ে তুলেছিল নতুন এক মানুষ হিসেবে। সবসময় বড় বোনের সাথে থেকে পরিবারের হত্যার বিচারের জন্য লড়াই করে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে নিজেকে রাজনীতিতে না জড়ালেও বোনের রাজনৈতিক জীবনে তার অবদান অনস্বীকার্য। দেশের বিভিন্ন সংকটময় মুহূর্তে নিজের সবটা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন এই মহান নারী। কোনোদিন তিনি কোনো রাজনৈতিক পদ নেননি। তার কোনো লোভ বা অহংকার ছিল না। শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিয়ে দেশের উন্নয়ন এবং ভালো কাজের জন্য সবসময় তিনি প্রশংসিত হবেন।

২০০১ সালে শেখ রেহানা দলীয় কার্যক্রমে নিয়োজিত হয়েছিলেন। ২০১৩ সালে লন্ডনে একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তার পরিবারের হত্যা এবং দুঃসহ সব স্মৃতির কথা বলেছিলেন। ১৯৭৯ সালের উত্তাল সময়ে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে অবস্থান করছিলেন তখন শেখ রেহানা তার পক্ষে স্টকহোমে সর্ব ইউরোপীয় বাকশালের সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছিলেন যেটা কি না তার জীবনের প্রথম রাজনৈতিক মঞ্চে রাখা বক্তব্য। সেই বক্তব্যে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘ মহাসচিব, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের প্রধানদের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচার দাবি করেন।

পরে ১৯৮০ সালে উইলিয়ামস ব্রিটিশ পার্লামেন্টে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানায় এবং তিনি আমন্ত্রণ রক্ষা করে স্যার উইলিয়ামসকে অনুরোধ করেন যাতে বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরে ১৯ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে স্যার উইলিয়ামসন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এভাবে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা একে অপরকে সাহায্য করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামিদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হন।

Advertisement

বাংলার প্রতিটি মানুষের জন্য আধুনিকতম জীবন যাপন নিশ্চিত করা, জাতি হিসেবে বাঙালি যেন সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা পায় সেই লক্ষ্যে কাজ করা, বাঙালিকে এক আদর্শ জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে পাশে আছেন। রাজনীতি সচেতন এই মানুষটি নিজেকে রাজনীতিতে না জড়ালেও যে আড়াল থেকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়া যায় তা দেখিয়ে দিয়েছেন, যা খুবই ইতবাচক। শেখ রেহানা আর দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন, জাতির প্রয়োজনে সর্বদা নিয়োজিত থাকুন, জন্মদিনে এই আমাদের প্রত্যাশা। শুভ জন্মদিন সুযোগ্য শেখ রেহানা।

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম হামলাটি হয় ২১ আগস্টে। ২১ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা তার গাড়িতে করে ফিরেছিলেন, তখন তার রক্তমাখা মুখ দেখে শেখ রেহানা ভেঙে পড়েছিলেন। সেই দুর্বিষহ স্মৃতির কথা শেখ রেহানা এখনও ভুলতে পারেননি বলে মনে হচ্ছে। ২১ আগস্টের মতো দুর্বিষহ সময়েও শেখ রেহানা নিজে ত্যাগ শিকার করে দেশের স্বার্থের জন্য শেখ হাসিনার পাশে থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন। এক মুহূর্তও তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একা বোধ করতে দেননি, সবসময় পাশে থেকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন, সাহস জুগিয়েছেন।

শুধু তাই নয় পরে বাংলাদেশ এক/এগারো অধ্যায়ে পৌঁছালে আওয়ামী লীগের মধ্যে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল তিনি পর্দার আড়ালে থেকে সেই ফাটল রোধ করেছিলেন। ২০০৭-২০০৮ সালে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান কর্তৃক জরুরি অবস্থা চলছিল, তখন শেখ হাসিনা গৃহবন্দি ছিলেন, তখন দলকে একত্রিত করে রাখার জন্য এমন একজন মানুষের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। সেই সময় শেখ রেহানা শক্ত হাতে দলের হাল ধরেছিলেন। পরবর্তীসময়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের অবদান থেকেই বোঝা যায় সেইদিনের শেখ রেহানার দলের জন্য অবদান ঠিক কতটুকু। কারণ সেই ১/১১ দুঃসময় কাটার পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগের অবদান অনস্বীকার্য। শেখ রেহানা সেই দলটিকেই ভেঙে ছিন্ন হওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলেন গভীর মমত্ব ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।

২০০৮ সালে বাংলাদেশের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তখন শেখ রেহানা বোনকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে সহযোগিতা করেন। অতি সাধারণ ভাবে জীবনযাপন করতে পছন্দ করেন তিনি। বিশেষ কিছুই যেন তিনি নিতে চান না। এমনকি ব্রিটেনেও তিনি পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চলাচল করেন। যে কেউ চাইলেই খুব সহজে তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। এতো সরলভাবে তিনি তার বোনের পাশে থেকে গেছেন সবসময়।

আমাদের চারপাশে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা দেশ ও দেশের নাগরিকের স্বার্থে আড়াল থেকে কাজ করে যায়। ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশের চিন্তায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে। এমন একজন মানুষের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলেন শেখ রেহানা। বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনার পাশাপাশি শেখ রেহানার অসামান্য অবদান রয়েছে। রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠার পর ও কি সহজ সাবলীল জীবনধারা অনুসরণ করেন তিনি। অথচ সুস্থ রাজনৈতিক ধারার আন্দোলন সংগ্রামে তিনি এক ইতিবাচক শক্তির উৎস।

তিনি সত্যের নির্মলতম আদর্শকে রক্ষা করা এক জ্বলন্ত প্রদীপ। জাতির পিতার কন্যা তিনি অথচ তার জীবনটা সহজ হয়নি। জীবনের অনেকটা পথ রীতিমতো লড়াই করে কাটাতে হয়েছে। জীবন যুদ্ধের সৈনিক হয়ে জীবনের হাল ধরতে হয়েছে। আশ্রয়হীন পরিবেশে নিরাপত্তা ছাড়া দেশে দেশে ঘুরতে হয়েছে। নানা কাজের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করতে হয়েছে। তবুও দমে যাননি, থেমে যাননি জীবন যুদ্ধে।

বড় বোন শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দলের নেতৃত্ব হাতে তুলে নিয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণের সর্বোচ্চ চেষ্টায় নিয়োজিত ছোট বোন তখন বড় বোনের দুই সন্তান জয় ও পুতুলের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার বোন যেন তাদের বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে এই ব্যাপারে তারা সোচ্চার, সংগ্রামী। জননেত্রী শেখ হাসিনা যেমন স্বপ্ন দেখেন সুন্দর একটি বাংলাদেশের তেমন করে তিনিও সেই স্বপ্নের এক প্রধানতম ধারক ও বাহক।

বাংলার প্রতিটি মানুষের জন্য আধুনিকতম জীবন যাপন নিশ্চিত করা, জাতি হিসেবে বাঙালি যেন সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা পায় সেই লক্ষ্যে কাজ করা, বাঙালিকে এক আদর্শ জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে পাশে আছেন। রাজনীতি সচেতন এই মানুষটি নিজেকে রাজনীতিতে না জড়ালেও যে আড়াল থেকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়া যায় তা দেখিয়ে দিয়েছেন, যা খুবই ইতবাচক। শেখ রেহানা আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন, জাতির প্রয়োজনে সর্বদা নিয়োজিত থাকুন, জন্মদিনে এই আমাদের প্রত্যাশা। শুভ জন্মদিন সুযোগ্য শেখ রেহানা।

লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক,হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ,জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম