অর্থনীতি

দেশের সমস্ত সর্বনাশের মূল সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা

‘গত এক বছরে গোটা পৃথিবীতে দ্রব্যমূল্য লাগামে আনা সম্ভব হয়েছে। আমাদের পাশের দেশ শ্রীলঙ্কা। মূল্যস্ফীতি ছিল ৪৯ শতাংশ। দেউলিয়া হয়ে গেলো প্রায়। সরকার পতন ঘটলো। শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এখন ৫ শতাংশ। এটি রীতিমতো মিরাকল। কিন্তু বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছে সে দেশের সরকার। অথচ, অনুকূলে থেকেও আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।’

Advertisement

বলছিলেন, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রথম উপাচার্য ছিলেন। মূল্যস্ফীতি, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা ও করণীয় নিয়ে কথা হয়ে জাগো নিউজের।

বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন নিশ্চয়। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা কীভাবে দেখছেন?

আরও পড়ুন>> খাদ্যপণ্য ক্রেতার নাগালের বাইরে, মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ১২.৫৪ শতাংশ

Advertisement

‘সাধারণ মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে এর জন্য আসলে গবেষণা করার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু আমি কেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, বাজার পরিস্থিতির কারণে সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য উচ্চ থাকার কারণে গরিব মানুষের কষ্ট হচ্ছে এটি স্বীকৃত।’

সরকার এর জন্য বৈশ্বিক সংকটকেও দায়ী করছে- ‘গত এক বছরে গোটা পৃথিবীতে দ্রব্যমূল্য লাগামে আনা সম্ভব হয়েছে। আমাদের পাশের দেশ শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে গেলো প্রায়। সরকার পতন ঘটলো। শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ। এটি রীতিমতো মিরাকল।’

শ্রীলঙ্কায় সম্ভব হলো কীভাবে?

‘পলিসি গ্রহণ করতে পারলে এবং বাস্তবায়ন করতে পারলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। আবেগ বা রাজনৈতিক প্রভাবে নয়, যারা জানেন, বোঝেন তাদের নীতিগুলো যুক্ত করে সমাধানে আসতে হবে। তাতে কেউ বিরাগভাজন হলেও কিছু করার থাকবে না।’

Advertisement

কী নীতি হতে পারে?‘প্রথমত, ৯/৬ সুদের হারটা দীর্ঘদিনের। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে পারে না। পৃথিবীর যেখানেই মূল্যস্ফীতি কমিয়েছে, সেখানেই সুদের হারটা বাড়তে দিয়েছে। জোর করে বাড়ানোর দরকার নেই। বাড়তে দিতে হয়।

আরও পড়ুন>> বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমছে মূল্যস্ফীতি, বাড়ছে বাংলাদেশে

দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার জায়গায় অনেক কিছু বলার আছে, করার আছে। এক মিনিটে আপনাকে সব বোঝানো সম্ভব নয়।

তৃতীয়ত, সঞ্চয়পত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা। সঞ্চয়পত্র হচ্ছে জনসাধারণের কাছ থেকে সরকারের প্রত্যক্ষভাবে টাকা ধার করা। সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হলে ক্রয় ক্ষমতাটা সরকারের হাতে চলে যায়। তখন মূল্যস্ফীতি কমে। সঞ্চয়পত্রের ওপর লভ্যাংশ কমিয়ে এবং লভ্যাংশের ওপর আয়কর বসানো ছিল বিশ্বব্যাংকের একটি খারাপ পরামর্শ। এ কারণেই মানুষ সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সরকার এখন কিছুটা রিভাইস করছে, যা ভালো উদ্যোগ বলে মনে করি। এটি আরও সহজ করা দরকার যাতে সরকার জনসাধারণের কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে ধার করার সুযোগ পায়।

সরকার অতিমাত্রায় ব্যাংক ঋণ নিচ্ছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকার ক্রমাগতভাবে ঋণ নিতে থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগের জায়গাটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত এক বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে খুব বেশি বেশি ধার করেছে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেওয়া মানেই মূ্ল্যস্ফীতি বাড়া। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব কোনো টাকা নেই। এই ঋণ নেওয়া একেবারে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

আরও পড়ুন>> শ্রীলঙ্কায় ১০ মাসে মূল্যস্ফীতি কমলো ১০ গুণ, জনগণের স্বস্তি

সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে অনেক কিছুই বলা হয়, সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। কিন্তু সিন্ডিকেট ভাঙার ব্যাপারে কোনো সমাধান হয় না। মূলত, সিন্ডিকেট ভাঙা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আজ হোক কাল হোক সিন্ডিকেট আমাদের ভাঙতেই হবে। ১৯৭৪ সালে যে সিন্ডিকেট সর্বনাশ করেছিল এখন তারা আরও সক্রিয়। সিন্ডিকেটের কারণেই ওই সময় দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছিল। এখনো তাই করছে। দেশের সমস্ত সর্বনাশের মূল সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা।’

এখন মানুষ নীরব দুর্ভিক্ষে আছে বলে কেউ কেউ বলেন। আপনি কী বলবেন?

‘না। আমি এটি বিশ্বাস করি না। এটি আলাদা বিষয়। ১৯৭৪ সালের পরিস্থিতি থেকে শিখে জনবন্ধু শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে একটি নীতি গ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালে ভয়াবহ বন্যা হলো। সব তলিয়ে গেলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য কিনে মজুত করলেন। পরে ৯ মাসব্যাপী ভিজিডি কার্ডের মাধ্যমে দেড় কোটি মানুষের কাছে বিরতণ করলেন। কোনো দুর্নীতি হলো না। শাহ এসএম কিবরিয়া নেতৃত্ব দিলেন। মতিয়া চৌধুরী কৃষিমন্ত্রী ছিলেন। আমি তখন বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নর। শেখ হাসিনার সরকার এমন নীতি গ্রহণ করতে পারেন। প্রচুর মজুত আছে। এখনো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

সুদের হার ঠিক করা, বৈদেশিক মুদ্রার সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেট ভেঙে দিলে সাধারণ মানুষ মুক্তি পাবে। আমি এক নিবন্ধে লিখেছি, পাঁচজনের আমদানি লাইসেন্স থাকলে তা বাতিল করে ৫০ জনকে দিতে হবে। অনেকে আমার ওপর রাগান্বিত হলেন। সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে এমন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। সরকার সবই জানে, কে কত মজুত করে অতিমুনাফা অর্জন করছে।’

এএসএস/এএসএ/এমএস